আবার স্কুলে যেতে চায় আলিফ
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বনপারিল গ্রামের শিশু মোহাম্মদ আলিফকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে তার পরিবার। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় বোন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে পায়ের হাঁটুতে সামান্য চোট পাওয়া ১১ বছরের এই শিশুটি।
গত ৪ মাসে তার চিকিৎসায় ব্যয় হয়েছে পরিবারটির সঞ্চিত সব টাকা। আর্থিক সংকটে সুচিকিৎসা পাওয়ার অনিশ্চয়তায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন শিশুটির স্বজনরা।
শিশু আলিফের পরিবার, তার বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোহাম্মদ আলিফ ওরফে আবির নতুন পালড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তার বাবা মোস্তফা কামাল কুয়েত প্রবাসী এবং মা আকলিমা বেগম গৃহিনী। বাবা-মায়ের ২ সন্তানের মধ্যে আলিফ বড়। ছোট বোনটির বয়স ৪ বছর।
প্রবাসী মোস্তফা কামাল তার সঞ্চয়ের সব টাকা ইতোমধ্যেই খরচ করে ফেলেছেন আলিফের চিকিৎসায়। ছুটি শেষে তার কুয়েতে ফেরার সময় হয়ে গেছে। কিন্তু একমাত্র ছেলের এমন অবস্থায় এখন কী করবেন তা নিয়ে দিশেহারা তিনি।
আলিফের পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, গত ২৪ এপ্রিল বিদ্যালয়ের বেঞ্চের সঙ্গে ধাক্কা লেগে বাম পায়ের হাঁটুতে চোট পায় আলিফ। এর ৯ দিন পর তার পা ফুলে যায়। আঘাত পাওয়ার ১৬ দিন পর আলিফকে নেওয়া হয় পার্শ্ববর্তী জামশা এলাকার ডা. মাসুদ রানার চেম্বারে। চিকিৎসক আলিফের পায়ের এক্সরেতে দেখতে পান, হাড় ফেটে গেছে। আলিফের পায়ে ব্যান্ডেজ করা হয়। এর ১৫ দিন পর পায়ের ব্যান্ডেজ খুলে পুনরায় এক্সরের রিপোর্ট দেখে ডা. মাসুদ জানান, এখনও কিছুটা ফাটা রয়েছে। তিনি বলেন, ওষুধ খেলে এবং সাবধানে চলাফেরা করলে ঠিক হয়ে যাবে।
তবে সুস্থ হয়নি আলিফ। এরপর মানিকগঞ্জ জেলা শহরে চিকিৎসা করিয়েও কাজ না হলে তাকে নেওয়া হয় ঢাকার নবাবগঞ্জ বাগমারার প্যারাগন হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসক শিশুটিকে দেখে দ্রুত তাকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) নেওয়ার পরামর্শ দেন।
আলিফের পরিবার জানায়, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে ৭ দিন ঘুরেও চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে অবশেষে তাকে নেওয়া হয় বেসরকারি প্রাইম হাসপাতালে। সেখানকার একজন চিকিৎসকের পরামর্শে জরুরিভিত্তিতে আলিফের পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয় সাভারের স্পেশালাইজড হাসপাতালে।
অস্ত্রোপচারের পর পায়ের অংশবিশেষ বায়োপসি করা হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে ২টি প্রতিষ্ঠানে বায়োপসি করে ২টি রিপোর্টেই ধরা পড়ে, তার হাড়ে ক্যানসার হয়েছে।
মহাখালী ক্যানসার হাসপাতালে গত ১৮ জুন আলিফকে প্রথম কেমো দেওয়া হয়। শারীরিক যন্ত্রণায় সে আর কেমো নিতে চাচ্ছে না। এরই মধ্যে কিছুটা মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেছে সে।
দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে শিশু আলিফ বলছিল, 'আমার তো কোনো দোষ নাই। আমি কেন এতো কষ্ট করুম। চলাফেরা করবার পারি না, স্কুলে যাইবার পারি না, মাঠে খেলবার পারি না। সারাদিন খালি শুইয়া থাকা লাগে। আমারে ভালো কইরা দেন, আমি আবার স্কুলে যামু, মাঠে যাইয়া খেলুম।'
আলিফের মা আকলিমা বেগম বলেন, 'কত জায়গায় নিয়া ডাক্তার দেখাইলাম, কত টাকা খরচ করলাম। কিছুই হইতাছে না। আমার ছেলে এখন ডাক্তারের কাছে যাইতে চায় না। ছেলেটা খাইতে চায় না, হাঁটতে পারে না। চোখের সামনে এইভাবে ছেলেডা আমার শেষ হইয়া যাইতেছে। আমি আর সহ্য করতে পারতেছি না। আপনারা একটু দেখেন না, কিছু করা যায় কি না।'
আলিফের বাবা মোস্তফা কামাল বলেন, 'আমি কুয়েতে থাকি। করোনার সময়টা ভালো যায়নি। হাতে যা ছিল সব টাকা শেষ করেও ছেলেকে সুস্থ করতে পালাম না। আমার কুয়েতে ফেরার সময় হয়ে গেছে। ছেলেকে এই অবস্থায় রেখে কীভাবে যাব?'
নতুন পালড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুন নাহার বলেন, 'আলিফ নিয়মিত স্কুলে আসতো। হঠাৎ তার অনুপস্থিতিতে আমরা আলিফের বাড়িতে গিয়ে দেখি, সে শয্যাশায়ী। আলিফের আরও উন্নত চিকিৎসা দরকার। কিন্তু ওর পরিবারের পক্ষে চিকিৎসার ব্যয়ভার আর বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। আলিফের চিকিৎসায় সবার সহযোগিতা দরকার।'
আলিফকে ক্যানসারের চিকিৎসার পাশাপাশি দ্রুত মানসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত বলেও মনে করছেন মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. লুৎফর রহমান।
Comments