আওয়ামী লীগ নেতা-এমপি পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

পঙ্কজ দেবনাথ
পঙ্কজ দেবনাথ। ছবি: সংগৃহীত

বরিশাল-৪ (হিজলা মেহেন্দীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ থেকে প্রথম নমিনেশন নিয়েই নির্বাচিত হন। দুই মেয়াদে এই সংসদ সদস্য এই আসনের এমপি হলেও নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মতে, এমপির কর্মকাণ্ডে খোদ উপজেলা আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ তিনি প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন ও তাদের মধ্যে বেশ কিছু প্রার্থীকে জিতিয়ে এনেছেন। এছাড়া স্থানীয় মেয়রকে কোপানোর হুমকি দিয়ে পুলিশের ওসির সঙ্গে তার কথোপকথন সম্প্রতি ভাইরাল হয়।

এর আগে গত চার বছরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে চারটি খুন, শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনা ছাড়াও নির্বাচন স্থগিত, নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুরসহ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকেও স্বীকার করা হয়েছিল।

বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি এস এম আক্তারুজ্জামান গত ৩০ জুন বিদ্যানন্দপুর ও আন্ধারমানিক নির্বাচনে ভোটের দিন বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য নিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন।

এসময় তিনি বলেছিলেন নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে যা যা করণীয় তিনি তাই করবেন। এর আগে উত্তর ও দক্ষিণ উলানিয়া নির্বাচনে ব্যাপক হাঙ্গামায় দুই দফায় নির্বাচন স্থগিত থাকে।

সম্প্রতি মেহেন্দীগঞ্জে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি চরম আকার ধারণ করে। গত ২৮ আগস্ট এমপি বিরোধী গ্রুপের সঙ্গে এমপি পক্ষের গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় ৮ জন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে এমপি পক্ষের লোকজন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে প্রতিপক্ষের ৫ জনকে কোপানোর অভিযোগ ওঠে। পরে তাদের বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এই ঘটনায় বরিশালের এসপি ওয়াহিদুল ইসলামের নির্দেশে চার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে বাসে আগুন দিয়ে পোড়ানোর অভিযোগ আ. লীগের

মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি ও বরিশাল জেলা পরিষদের প্রশাসক মইদুল ইসলাম ২০১৭ সালের ২৩ মে জেলা পরিষদ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, ২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর শাহবাগে নিজের মালিকানাধীন বিহঙ্গ পরিবহনে তার (পঙ্কজ দেবনাথ) মদদে পেট্রল বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এতে বাসের চালকসহ ১১ জন নিহত হন। সংবাদ সম্মেলনে এই বক্তব্য তখন ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে।

দলীয় কর্মীকে পেটানো

মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার কাজিরহাট থানা আওয়ামী লীগের সহপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সঞ্জয় চন্দ্র সাংবাদিক সম্মেলন করে তার ওপর হামলা করে তিন দফা নির্যাতন চালিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ করেন কয়েক মাস আগে।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১৭ সালের ৫ মার্চ, পঙ্কজ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করেছিলাম। এতে এমপি ক্ষিপ্ত হয়ে তার লোক দিয়ে ওই বছরের ২০ এপ্রিল নির্যাতন চালিয়ে আমার দুই পা ও একটি হাত ভেঙে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে ছিনতাই মামলা দিয়ে কোর্টে চালান দেন। তার পরের বছর ২০১৮ সালের ১২ জুন আমাকে নতুন ডাক বাংলোতে ধরে নিয়ে মারধর করে বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দেয়। এ ঘটনায় আমি পঙ্কজ দেবনাথকে ১ নম্বর আসামি করে মামলাও করেছি। এরপর তারা ২০২০ সালে আবার আমাকে মারধর করে এলাকাছাড়া করেন।' 

মেয়রকে কোপানোর নির্দেশ

মেহেন্দীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামাল খানকে কোপানোর নির্দেশ দেওয়ার একটি অডিও ক্লিপ গত জুলাই মাসে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। মেহেন্দীগঞ্জ ওসির সঙ্গে এই কথোপকথনের পরে ওসিকে বদলি করা হয়। এই ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচিও করে।

সম্পত্তির মালিক

কাজিরহাট থানা আওয়ামী লীগের সহপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সঞ্জয় চন্দ্র বলেন, আমি চাই তার দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করা হোক। যতদূর জানি, তার ধানমন্ডিতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, উত্তরায় ১০ তলা বাড়ি, মালিবাগে গার্মেন্টস, পরিবহন ব্যবসা, গ্রামে বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে।

পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ইলিশঘাট, বালুমহাল বাণিজ্যের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আয় করার অভিযোগ করেন। স্থানীয়দের মতে বছরে বালুমহাল ও ইলিশঘাট থেকে শত কোটি টাকার বেশি আয় হয়ে থাকে। এই আয়ের একটি অংশ নিয়েই এখানে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক গোলযোগ হয়।

দলের অভ্যন্তরে কোন্দল সৃষ্টি

হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জে স্থানীয় আওয়ামী লীগ দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি এমপির অনুসারী অপরটি জেলা আওয়ামী লীগ অনুসারী। পঙ্কজের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছেন। দলীয় প্রার্থীকে নির্যাতন করেছেন। দলের বাইরে আলাদা একটি বলয় তৈরি করেছেন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের সন্তোষ

মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র কামাল খান বলেন, সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথকে আওয়ামী লীগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেকেই খুশি হয়েছেন। আমরা নেত্রীর (দলের সভাপতি শেখ হাসিনা) সিদ্ধান্তে বিশ্বাসী। উপজেলায় তিনি (সংসদ সদস্য) যা করেছেন তা আমরা বিভিন্ন সময়ে আমাদের নেতাদের জানিয়েছি।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, পঙ্কজ দেবনাথের কারণে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ঘটনায় দল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।

'আমরা তার কর্মকাণ্ড দলে তুলে ধরেছি,' তিনি জানান।

শিগগির মেহেন্দীগঞ্জের রাজনীতিতে পালাবদল আসন্ন বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের এক বর্ষিয়ান নেতা।

পঙ্কজ দেবনাথের বক্তব্য

আওয়ামী লীগের সব পদ থেকে অব্যাহতির পর গতকাল ডেইলি স্টার পঙ্কজ দেবনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে কয়েক মাস আগে তিনি ডেইলি স্টারকে হামলার প্রসঙ্গে বলেছিলেন তার এ বিষয়ে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তিনি তখন 'রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের' অভিযোগ করেন।

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

8h ago