পাবনা মানসিক হাসপাতালে খাদ্য-ওষুধ সংকটে চিকিৎসাসেবায় নৈরাজ্য

রোগী ভর্তি বন্ধ ও ভর্তি রোগীদের ছেড়ে দেয়ার আদেশ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রত্যাহার
পাবনা মানসিক হাসপাতাল
পাবনা মানসিক হাসপাতাল। ছবি: সংগৃহীত

খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ সংকটে মানসিক রোগের চিকিৎসায় দেশের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল পাবনা মানসিক হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

গত প্রায় ২ মাসের বেশি সময় ধরে চলা সংকটে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গত রোববার বিশেষায়িত এ হাসপাতালে রোগী ভর্তি বন্ধ ও ভর্তি রোগীদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে অফিস আদেশ দেওয়ার পর নড়ে বসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে পাবনা মানসিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গতকাল সোমবার রোগী ভর্তি বন্ধ করার আদেশ প্রত্যাহার করলেও সংকট এখনো কাটেনি।

সরেজমিনে পাবনা মানসিক হাসপাতালে দেখা গেছে, ভর্তিচ্ছু অনেক রোগীকেই ফিরে যেতে হয়েছে। এ ছাড়া, অনেক রোগীকে ইতোমধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে গত রোববারের আদেশ প্রত্যাহারের পর সংকট থাকলেও এখন রোগী ভর্তি প্রক্রিয়া চলমান আছে।

পাবনা মানসিক হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হাসপাতালের খাদ্য সরবরাহকারী এক ঠিকাদারের মামলার পর পাবনার এক আদালত গত জুনে পাবনা মানসিক হাসপাতালের খাদ্য, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার জন্য নিয়মিত দরপত্র প্রক্রিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

এতে করে গত ২ মাসের বেশি সময় ধরে হাসপাতালে খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ বন্ধ আছে। জরুরিভিত্তিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্থানীয়ভাবে কমিটি করে বাকিতে খাদ্যসামগ্রী কিনে হাসপাতালে রোগীদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেও নিয়মবহির্ভূতভাবে খরচ বেড়ে যাওয়ায় গতকাল হাসপাতালে রোগী ভর্তি বন্ধের আদেশ দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. রতন কুমার রায়ের সই করা আদেশে তা বলা হয়।

অফিস আদেশে বলা হয়েছে, আদালত হাসপাতালের টেন্ডার কার্যক্রমে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করায় রোগীদের খাবার সরবরাহের জন্য ঠিকাদার নিযুক্ত হয়নি। এ ব্যাপারে একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ায় খাবার সরবরাহ চলমান রাখা সম্ভব নয়। তাই পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগী ভর্তি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হলো। একই সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের পর্যায়ক্রমে বাড়িতে পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কনসালট্যান্ট ও ওয়ার্ড ডাক্তারদের নির্দেশ দেওয়া হলো।

তবে এ নির্দেশ দেওয়ার পরদিন সোমবার রোগী ভর্তি বন্ধের আদেশ প্রত্যাহার করে আবারও অফিস আদেশ জারি করে রোগী ভর্তি চলমান থাকার কথা জানানো হয়েছে।

পাবনা মানসিক হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. রতন কুমার রায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ও চলমান সমস্যা নিরসনের আশ্বাস পাওয়ার সাপেক্ষে পূর্বের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ বন্ধ থাকায়, গত ২ মাস সমাজসেবা দপ্তর থেকে ওষুধ নিয়ে ও হাসপাতালের স্টোরের ওষুধ দিয়ে আবাসিক রোগীদের চিকিৎসা দিতে পারলেও বহির্বিভাগের রোগীদের ওষুধ সরবরাহ কমিয়ে দিতে হয়েছে।

তবে ওষুধের বিষয়টি কোনোভাবে ম্যানেজ করা গেলেও প্রায় ৫০০ রোগীর প্রতিদিন ৪ বেলা খাবার যোগাতে হিমশিম খেতে হয়েছে।

গত ২ মাসের বেশি সময় ধরে বাকিতে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে এসে রোগীদের খাবার ব্যবস্থা করলেও ইতোমধ্যে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়তে হয়েছে বলে জানান তিনি।

হাসপাতাল পরিচালক বলেন, 'বিনা টেন্ডারে ভাউচারের মাধ্যমে বছরে ১০ লাখ টাকার বেশি খরচ করার বিধান নেই। কিন্তু, গত ২ মাসে খাবার বাবদ প্রায় ৩৭ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হওয়ায় প্রশাসনিক জটিলতায় পড়ার আশঙ্কায় এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।

সরেজমিনে হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, গত রোববারের আদেশ ফিরিয়ে নেওয়া হলেও অধিকাংশ রোগী ভর্তি হতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন। অনেককে আবার ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়েকে ভর্তির জন্য নিয়ে এসে হাসপাতালের বহির্বিভাগে দেখানো হলে মেয়েকে ভর্তি করতে পারেননি সাইফুরা বেগম।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ৩ মাসের চিকিৎসায় ওষুধ ও ইনজেকশন দেওয়ার প্রেসক্রিপশন দিয়ে একটি মাত্র ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

এ দিকে, সিরাজগঞ্জের আবাসিক রোগী বিল্লাল হোসেনের স্ত্রী চায়না বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত রোববার হাসপাতাল থেকে ফোন করে বলা হয়েছে রোগী ছেড়ে দেওয়া হবে।'

ভর্তির মাত্র ২ মাস পর পুরোপুরি সুস্থ না হলেও রোগীকে বাড়ি নিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে। ৩ মাসের ওষুধ লিখে দেওয়া হলেও হাসপাতাল থেকে মাত্র একটি ওষুধ দেওয়া হয়েছে।

পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডা. রতন কুমার রায় ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মানসিক রোগীকে তাৎক্ষণিক ভর্তি করতে হবে এমন নয়। যাদের প্রয়োজন হবে তাদেরই ভর্তি করা হবে।'

হাসপাতালের চলমান সংকট নিরসনে কাজ করা হচ্ছে বলে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'ইতোমধ্যে দরপত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা খারিজ করেছে আদালত। তবে আদালতের আদেশ এখনো হাতে পৌঁছায়নি।'

তিনি বলেন, 'আদালতের আদেশ পাওয়ার পর খাদ্য-ওষুধ কেনার জন্য আবারও দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। তবে এজন্য আরও কয়েকদিন সময় লাগবে। ফলে সংকট সহসাই কাটছে না।'

এ দিকে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সাইক্রিয়াট্রিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাফকাত ওয়াহিদকে হাসপাতালের নতুন পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

গত সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছে।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. শফিউর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাবনা মানসিক হাসপাতালের সংকটের বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর ভালোভাবে অবগত। সেখানে ঠিকমতো চিকিৎসাসেবা দিতে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। আশা করি, শিগগিরই সব ঠিক হয়ে যাবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

2h ago