মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

অনিয়ম-দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত পাবনা মানসিক হাসপাতাল

পাবনা মানসিক হাসপাতাল
পাবনা মানসিক হাসপাতাল। ছবি: সংগৃহীত

মানসিক রোগীদের সুচিকিৎসার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতাল ১৯৬০ এর দশক থেকে সেবা দিয়ে আসলেও বর্তমানে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত দেশের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতালটি।

গত কয়েক বছর ধরেই সংকট ও অনিয়ম নিয়ে বারবার সমালোচিত হলেও সম্প্রতি খাবার ও ওষুধ সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় রোগী ভর্তি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশে সে আদেশ প্রত্যাহার করা হয়।

ঘটনার প্রায় একমাস কেটে গেলেও এখনো খাবার ও ওষুধ সরবরাহের ঠিকাদার নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি। ধার-বাকিতে চালছে দেশের অন্যতম প্রধান এ হাসপাতাল।

পাবনা মানসিক হাসপাতাল
চিকিৎসকের অভাবে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হন পাবনা মানসিক হাসপাতালের রোগীরা। ছবি: স্টার

অনুসন্ধানে নানান অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র দেখা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে, ৫০০-শয্যার বিশেষায়িত এ হাসপাতালটির চিকিৎসাসেবা, ব্যবস্থাপনা দেশের আর সব সরকারি হাসপাতালের চেয়ে ভিন্ন হলেও বরাদ্দ একই। ফলে সংকটের সুযোগ নিয়ে বাড়ছে অনিয়ম ও দুর্নীতি।

তারা আরও জানান, অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে রোগীদের ৩ বেলা খাবারের জন্য দৈনিক বরাদ্দ ১২৫ টাকা। একই বরাদ্দে মানসিক হাসপাতালের রোগীদের দিনে ৪ বেলা খাবার দিতে হয়। 'খাবারের বরাদ্দ কম থাকায়' নিম্নমানের খাবার পরিবেশনের অভিযোগ রয়েছে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে।

পাবনা মানসিক হাসপাতালের খাবার তালিকা দেখে জানা গেছে—রোগীদের সকালে নাস্তা, দুপুর ও রাতের ভারি খাবার এবং রাতের হালকা নাস্তা দেওয়া হয়।

প্রতি বেলার খাবারে রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ পুষ্টিকর খাবার পরিবেশনের কথা থাকলেও বছরের পর বছর একই ধরনের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

মাছ, মাংস, ডিম, সবজিসহ পুষ্টিকর খাবারের তালিকা টাঙানো আছে। প্রতিদিন দেওয়া হচ্ছে পাঙ্গাশ মাছ, ব্রয়লার মুরগি ও অল্প পরিমাণে সবজি। রাতের নাস্তায় ২টি বিস্কুট। এ সবের বেশিরভাগই রোগীরা খেতে পারেন না বলে জানা গেছে।

'প্রতিদিন অনেক খাবারই ফেলে দিতে হয়' উল্লেখ করে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, 'রোগীরা স্রেফ বেঁচে থাকার জন্য এসব খেতে বাধ্য হন।'

কথা হয় বাগেরহাটের এক রোগীর স্বজনদের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই রোগীর বড় ভাই ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ছোট ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মাথায় আঘাত পেয়ে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করি।'

'গত বছর তাকে ভর্তির ৩ মাস পর চলতি বছরের শুরুর দিকে সে কিছুটা ভালো হওয়ায় বাড়িতে নিয়ে আসি। হাসপাতালের খাবার জন্য তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে,' যোগ করেন তিনি।

পাবনা মানসিক হাসপাতাল
পাবনা মানসিক হাসপাতালে রোগীদের খাবার। ছবি: স্টার

'হাসপাতালে যে খাবার দেওয়া হতো তার বেশিরভাগই আমার ভাই খেতে পারত না। দিনের পর দিন তাকে খাবার কষ্ট করতে হয়েছে,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'ইচ্ছা থাকলেও বাইরে থেকে খাবার কিনে দেওয়া সম্ভব ছিল না। এখানে বাইরের খাবার গ্রহণ করা হয় না। ফলে, অনেক দিন সে শারীরিকভাবে দুর্বল ছিল।'

পাবনার সুজানগর উপজেলার এক ব্যবসায়ী কয়েক বছর আগে মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে পরিবার তাকে ২ দফায় প্রায় এক বছর এই হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছে।

ওই রোগীর স্ত্রী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার স্বামী প্রথম দফায় ৩ মাস হাসপাতালে সাধারণ ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন। খুব একটা উন্নতি না হওয়ায় ২০২০ সালের শেষের দিকে আবারও তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।'

'প্রথম দফার অভিজ্ঞতা থেকে এবার ভর্তির সময় স্বামীকে সাধারণ ওয়ার্ডে না রেখে পেইং বেডে রাখা হয়। প্রতিদিন বাইরে থেকে খাবার কিনে আনতে হতো। প্রতি মাসে অনেক খরচ হলেও তা করতে হয়েছে। হাসপাতালে যে খাবার দেওয়া হয় তার বেশিরভাগই খাওয়ার উপযুক্ত নয়।'

পাবনা মানসিক হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার আব্দুল বারী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মানসিক হাসপাতালের কোন রোগীকে বাইরের খাবার দেওয়ার সুযোগ নেই। ২ বার নাস্তা ও ২ বার ভারি খাবার পুষ্টিগুণ বজায় রেখে পরিবেশনা করা হচ্ছে।'

হাসপাতালের খাবারের মান নিয়ে অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'মানসম্মত খাবারই পরিবেশন করা হচ্ছে। খাবার সরবরাহের সব দায়িত্ব ঠিকাদারের।'

পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাফকাত ওয়াহিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যে বরাদ্দ দেওয়া রয়েছে তা দিয়ে প্রতিদিন ৪ বেলা খাবার পরিবেশন করতে হিমশিম খেতে হয়। ইচ্ছা থাকলেও খাবারে বৈচিত্র্য আনা যায় না।'

তিনি আরও বলেন, 'একই ধরনের খাবার পরিবেশন করা হলেও পুষ্টিগুণ ঠিক রেখেই তা রোগীদের দেওয়া হয়। খাবারের মান নিয়ে কেউ অভিযোগ করেননি।'

সামান্য বরাদ্দের যে খাবার দেওয়া হয় তা নিয়েও রয়েছে জটিলতা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, একই প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর ধরে পাবনা মানসিক হাসপাতালে খাবার সরবরাহের ঠিকাদারি পাচ্ছে।

মানসিক হাসপাতালের নিকটবর্তী এলাকার ৩ ভাই—এইচ এম আরেফিন, এইচ এম ফয়সাল ও এইচ এম রেজাউলের প্রতিষ্ঠানগুলো খাবার কাজ করে আসছে।

তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও তারা আমলে নেননি বলে জানিয়েছেন কয়েকটি সূত্র। খাবার সরবরাহে অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলেও এখনো তারাই এ কাজ করে যাচ্ছেন।

এইচ এম রেজাউল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিয়ম মেনেই মানসিক হাসপাতালে খাবার সরবরাহের কাজ করে যাচ্ছি।'

'প্রতি বছর যখন দরপত্র দেওয়া হয় তখন অনেকেই শিডিউল কেনেন, দরপত্রে অংশ নেন। সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ায় আমরাই কাজ পাই। এখানে কোনো অনিয়ম করা হয়নি,' যোগ করেন তিনি।

কীভাবে প্রতিবছর ওই ৩ প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হচ্ছে তা জানতে চাইলে হাসপাতাল থেকে সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

বারবার সর্বনিম্ন দরদাতা হয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালে কাজ পাওয়া ওই ৩ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সম্প্রতি মামলা করেছে দুদক।

'বাজারমূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত দামে' দরপত্র দিয়ে কাজ পাওয়া ওই ৩ প্রতিষ্ঠান খাবার সরবরাহ করে ২০১৭-১৮ সালে প্রায় ৮৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে—এমন অভিযোগে দুদক ওই ৩ ভাই, মানসিক হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ডা. তন্ময় প্রকাশ বিশ্বাস ও জেলা মার্কেটিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করে।

মামলার বিষয়ে রেজাউল বলেন, 'নিয়ম মেনেই কাজ করেছি। আইনিভাবে মামলা মোকাবিলা করা হবে।'

অনিয়মের অভিযোগে পাবনা মানসিক হাসপাতালের খাবার ও ওষুধ সরবরাহ নিয়ে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হলে ওই ৩ ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান রোজ এন্টারপ্রাইজ আদালতে মামলা করে। ফলে, খাবার ও ওষুধ সরবরাহের দরপত্রের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, গত জুনের পর নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দিতে না পারায় খাবার সরবরাহ বন্ধ হয়ে রয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গত জুলাই থেকে কমিটি করে রোগীদের জন্য বাকিতে খাবার কিনছে।

অনুমোদন ছাড়া বিপুল অংকের টাকা এভাবে খরচ করায় বিপাকে পড়ে অবশেষে গত সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হঠাৎ রোগী ভর্তি বন্ধ ও ভর্তি রোগীদের রিলিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ডা. রতন রায়।

ডা. রতন রায় ডেইলি স্টারকে বলেন, '১০ লাখ টাকার বেশি খরচ করা যায় না। ৩ মাস বাকিতে খাবার কিনতে প্রায় ৪০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এ টাকার অনুমোদন পাওয়া নিয়ে সংশয় ছিল বলে সে সময় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পরদিনই সে আদেশ প্রত্যাহার করা হয়।'

মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, 'মানসিক হাসপাতালের দরপত্র প্রক্রিয়া পরিবর্তন করে ই-টেন্ডার করার উদ্যোগ নেওয়ায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ না পাওয়ার আশঙ্কা থেকে এ মামলা করে থাকতে পারে।'

এ ঘটনার পর আদালত মামলা খারিজ করে দেওয়ায় এখন দরপত্র আহবানে বাধা নেই বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাফকাত অয়াহিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঠিকাদার নিয়োগের দরপত্র আহবানের প্রক্রিয়া চলছে। দ্রুত তা শেষ হবে।'

সূত্র আরও জানিয়েছে, বিশেষায়িত এ হাসপাতালে চিকিৎসকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকায় যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। আধুনিক চিকিৎসা ও রোগ নিয়ে গবেষণার সুযোগ এখানে নেই।

সূত্র মতে, ৫০০-শয্যার এ হাসপাতালে সব সময়ে ৪৮০ জনের বেশি রোগী ভর্তি থাকলেও চিকিৎসক রয়েছেন ১০ জন। তাদের মধ্যে ২ জন প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত।

হাসপাতালের ডেন্টাল ইউনিট, অ্যানেসথেসিয়া, সাইকো থেরাপিসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ বন্ধ আছে। চিকিৎসক না থাকায় রোগীদের প্রয়োজনীয় 'ইলেকট্রোকনভালসিভ থেরাপি' দেওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মাসুদ রানা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মানসিক রোগীদের দাঁতে সমস্যা নিয়মিত ব্যাপার। দীর্ঘদিন এ পদে লোক না থাকায় আমাদেরকেই দাঁতের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। শুধু ওষুধ দিয়ে রোগীদের সুস্থ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সাইকো থেরাপি। তাও সম্ভব হচ্ছে না।'

হাসপাতালের প্রধান সহকারী আহসান হাবিব ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুধু চিকিৎসক নয়, কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ ৬৪৩টি পদের বিপরীতে ১৭৬টি পদ শূন্য।'

'লোকবল সংকটের কারণে অকুপেশনাল থেরাপিসহ অন্যান্য সেবার সুযোগ ইচ্ছা থাকলেও সবসময় নিশ্চিত করা যায় না,' যোগ করেন তিনি।

'দালালের খপ্পরে মানসিক হাসপাতাল'

সূত্র আরও জানায়, হাসপাতালে দালালের প্রভাব কমছে না। রোগী ভর্তি ও চিকিৎসা নিতে দূর থেকে আসা ব্যক্তিরা দালালে খপ্পরে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দালালদের অনেকেই হাসপাতালে ভর্তির নামে রোগীদের স্থানীয় ক্লিনিকে নিয়ে হয়রানি করছেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে অনেক দালালকে আটক করে। তারা কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে আবারও দালালির কাজ শুরু করে। তাদের সঙ্গে যোগ হয় আরও নতুন দালাল। মানসিক হাসপাতালে কর্মরতদের মধ্যেও অনেকেই দালালদের সঙ্গে যুক্ত আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাফকাত ওয়াহিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি হাসপাতালের বাইরের বিষয়। স্থানীয় প্রশাসনকে সব সময় জানানো হয়। ক্লিনিকের বিষয়টি দেখে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।'

পাবনার সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্বাস্থ্য বিভাগ অভিযান শুরু করেছে। অনেক অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অভিযান অব্যাহত আছে। অনিয়মের অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।'

 

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

5h ago