করোনাকালে চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনায় ৩০ কোটি টাকার দুর্নীতি

প্রতীকী ছবি।

করোনা মহামারির প্রথম ৪ মাসে রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলো অস্বাভাবিক দামে চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনেছে বলে উঠে এসেছে এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল দেখতে পেয়েছেন যে এই ধরনের অনিয়মের কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মহামারির প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যয় করা ৩২০ কোটি ২৩ লাখ টাকার মধ্যে অন্তত ২৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা লোকসান করেছে সরকার।

২০২০ সালের মার্চের শুরুতে দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়।

চলতি বছরের জুনে গত বাজেট অধিবেশনে নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি সংসদে উপস্থাপন করা হয়।

দ্য ডেইলি স্টারের হাতে আসা নিরীক্ষা প্রতিবেদনটির অনুলিপি অনুযায়ী, রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত কুয়েত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল ২টি ইসিজি মেশিন কিনেছিল প্রতিটি ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা দামে। অথচ, সেই সময় এর বাজার দর ছিল ১ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল এক সরবরাহকারীর কাছ থেকে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকায় একটি হাই-ফ্লো অক্সিজেন থেরাপি ডিভাইস কিনেছিল। সেই সময় এর দাম ছিল ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা।

মুগদা জেনারেল হাসপাতাল একটি ভিডিও ল্যারিঙ্গোস্কোপ কিনেছে ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকায়, যার বাজার দর ছিল ১ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।

প্রতিবেদনে রাজধানীর ১৫টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মেডিকেল ও সার্জিক্যাল পণ্য (এমএসআর) এবং কোভিড-১৯ কোয়ারেন্টিন বাবদ খরচেও একই রকম আর্থিক অনিয়ম পাওয়া গেছে।

ওষুধ ও প্যাথলজিক্যাল আনুষঙ্গিক কেনায় ব্যয় ও সেগুলোর বাজার দরের মধ্যে পার্থক্য দেখা গেছে।

উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে কুয়েত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের মেরোপেনেম ১ গ্রাম ইনজেকশন কেনার হিসাবটি। এটি একটি উচ্চমানের অ্যান্টিবায়োটিক, যা গুরুতর সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

এর বাজার দর যখন ১ হাজার ৩০০ টাকা ছিল, তখন হাসপাতালটি ২ হাজার ২১০ টাকা দরে ১ হাজার এবং ১ হাজার ৯৫৫ টাকা দরে সাড়ে ৬ হাজার ইনজেকশন কেনে। এই ১ ওষুধ কিনতেই সরকারের ৫১ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা লোকসান হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ অ্যান্ড হসপিটাল কর্তৃপক্ষ ইকোকার্ডিওগ্রাফি পেপার ও রিএজেন্ট কেনা বাবদ ১৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা খরচ করেছে। এই খরচ বাজার দরের চেয়ে অনেক বেশি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

নিরীক্ষায় শহরের বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে চিকিত্সকসহ সংশ্লিষ্টদের জন্য কোয়ারেন্টিন বিল দেওয়ার ক্ষেত্রেও অনিয়মের বিষয়টি উঠে এসেছে।

মুগদা জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এশিয়া হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের সঙ্গে তাদের ৪৫টি রুমের জন্য প্রতিদিন রুমপ্রতি ২ হাজার ৯৫০ টাকায় চুক্তি করেছে।

কিন্তু, ২০২০ সালের ২৩ এপ্রিল থেকে ১৭ মের মধ্যে হোটেলটিকে প্রতিদিন অতিরিক্ত ১৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে আরও কিছু রুম ভাড়ার জন্য। প্রতিবেদন অনুযায়ী, হোটেলে এমন কোনো রুম ছিলই না।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঢাকার হোটেল নিউইয়র্ককে অতিরিক্ত ৬ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে।

ক্রয় ও বাজার দরের পার্থক্য এবং কোয়ারেন্টিন বিলের অসামঞ্জস্যকে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ক্রয় সম্পর্কে শোনা দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও অক্ষমতাকেই প্রতিফলিত করে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যদি কোনো চিকিৎসক (হাসপাতাল পরিচালক) সত্যিই এই কেনাকাটা থেকে অর্থের অপব্যবহার করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই তাদের শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু, তাদের দোষারোপ করার আগে বাস্তবতা যাচাই করা আবশ্যক। কারণ, চিকিৎসকরা প্রায়শই সিন্ডিকেটের সামনে অসহায় হয়ে পড়েন।'

তিনি জানান, বিদ্যমান সরকারি ক্রয় পদ্ধতিতে অনেক ত্রুটি রয়েছে, যা সংশোধন করা প্রয়োজন।

অধ্যাপক আবদুল হামিদ বলেন, 'আমরা গবেষণা করে দেখেছি যে অনেক দক্ষ চিকিৎসক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিতে চান না। অনেক হাসপাতালের পরিচালক অডিট ঝামেলা এড়াতে বরাদ্দকৃত অর্থও খরচ করতে চান না।'

'চিকিৎসকদের অনেকের সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত দক্ষতার অভাব রয়েছে। প্রায়শই তারা সঠিকভাবে দরদাম করতে পারেন না', বলেন তিনি।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও অডিট) মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন জানান, ২০২১ সালের অডিট রিপোর্টে উল্লেখিত ২৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ছাড়াও তারা আরও ১০ কোটি টাকার অডিট আপত্তি পেয়েছেন।

গত বুধবার ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমরা অডিট আপত্তির অর্ধেকের উত্তর পেয়েছি এবং সেগুলো সুপারিশসহ অডিটর জেনারেলের কার্যালয়ে পাঠিয়েছি।'

'অসঙ্গতি করে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। একইসঙ্গে আমাদের বিবেচনা করতে হবে যে কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা ও সময়মতো চিকিৎসা সরবরাহ নিশ্চিত করা করোনা মহামারির শুরুতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল', যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
Kudos for consensus in some vital areas

Kudos for consensus in some vital areas

If our political culture is to change, the functioning of our political parties must change dramatically.

3h ago