বড় ফার্মগুলোর ‘কারসাজিতে’ই বেড়েছিল ডিমের দাম

ডিম

ডিম উৎপাদনকারী বড় ফার্মগুলো কমিশন এজেন্টের মাধ্যমে মূল্য কারসাজি ও নিলাম প্রক্রিয়ায় নিজেদের নিয়োগকৃত এজেন্ট ব্যবহার করে ডিমের দাম বাড়িয়েছে। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের (ডিএনসিআরপি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

গত ৯ আগস্ট থেকে দেশে ডিমের দাম বাড়তে শুরু করে এবং ১৩ আগস্ট দাম দেশের ইতিহাসে 'সর্বোচ্চ' পর্যায়ে পৌঁছায়।

সাধারণত পাইকারি ব্যবসায়ীরা ১৫ থেকে ২০ পয়সা লাভে প্রতিটি ডিম বিক্রি করলেও গত ৯ থেকে ১৩ আগস্ট তারা ডিমপ্রতি ২ টাকা ৭০ পয়সা লাভ করেছেন বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, ডিম ও লাইভ চিকেনের ক্ষেত্রে মূল্য কারসাজির মাধ্যমে কতিপয় বড় ফার্ম ও মধ্যস্বত্বভোগী লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শত শত প্রান্তিক খামারি ও সাধারণ ভোক্তা।

এতে আরও বলা হয়েছে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে ডিমপ্রতি পরিবহন ব্যয় ৩ থেকে ৪ পয়সা বেড়েছে। এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা ডিমপ্রতি দাম বাড়িয়েছে ২ টাকা ৭০ পয়সা। আর ব্যবসায়ীরা ক্রয়-বিক্রয় রশিদ সংরক্ষণ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করায় ভোক্তারা প্রতারিত হয়েছেন।

হঠাৎ করে অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়ার কারণে গত ১৮ থেকে ২৪ আগস্ট দেশব্যাপী ডিম ও ব্রয়লার মুরগির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সেই অভিযান থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতেই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থাটি।

সংস্থাটির মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের সই করা প্রতিবেদনটিতে কারসাজির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে গত ৩০ আগস্ট তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর সম্প্রতি ডিমের দাম ডজনে ৩০-৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে কোথাও কোথাও ১৬০ টাকা হয়েছে। তবে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার খুচরা বাজারে প্রতি ডজন ডিম ১২০ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রয়োজনীয় রশিদ, কাগজপত্র ছাড়াই ডিমের ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে বলে জানায় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

সংস্থাটি ওই প্রতিবেদনে বলেছে, ডিমের ক্রয়মূল্য যাই হোক না কেন, ডিম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সমিতিগুলো মোবাইল ফোনে মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে বাজার সে সময় অস্থিতিশীল করে তুলেছিল।

'ব্যবসায়ীরা অর্গানিক ডিমের মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে নিজেরাই ডিমের গায়ে সিল দিয়ে বেশি মূল্যে সাধারণ ডিম বিক্রি করছে। আর কিছু ব্যবসায়ী নিজেদের মধ্যে ভুয়া কেনাবেচা দেখিয়ে (ভুয়া রশিদ সংরক্ষণ) লাইভ চিকেনের মূল্য বাড়িয়েছেন', প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ডিম ব্যবসায়ী সমিতিগুলোর বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

এতে বলা হয়েছে, ২২ আগস্ট এফবিসিসিআইয়ের অফিসে ডিম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সবাইকে নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কাজী ফার্ম, বিডার ফয়সাল ও তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি ডিমের মূল্যবৃদ্ধির জন্য সুস্পষ্টভাবে দায়ী বলে আলোচনায় বেরিয়ে আসে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, এরপর ২৪ আগস্ট ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তাদের সভাকক্ষে ডিম উৎপাদনকারী, বিক্রয় প্রতিনিধি, ডিলার ও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা করে। এর আগে ২৩ আগস্ট কাজী ফার্ম পরিদর্শনকালে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা তাদের তালিকাভুক্ত এজেন্টদের ২৪ আগস্ট তাদের কার্যালয়ের সভায় উপস্থিত থাকতে নির্দেশনা দেন। কিন্তু, সভায় কোনো এজেন্ট উপস্থিত ছিলেন না।

সভায় কাজী ফার্মের পরিচালক কাজী জাহিন হাসান জানান, ফয়সাল ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী ফয়সাল শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় সভায় আসেননি। ফয়সাল নিয়ম মেনেই নিলাম কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন এবং কোনো অন্যায় করেননি।

তবে, ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিমের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ফয়সালের যোগসাজশের বিষয়টি গোপন করার চেষ্টা করেছেন কাজী জাহিন হাসান।

এতে আরও বলা হয়েছে, একই দিন ফয়সাল ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে জানান, তিনি সুস্থ আছেন। ভবিষ্যতে তিনি সতর্ক থাকবেন জানিয়ে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার আবেদন করেন। কাজী ফার্ম ফয়সালকে উপস্থিত না করে এ বিষয়ে তথ্য গোপন করে অনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করেছে।

গত ২৪ আগস্ট ঢাকার কারওয়ান বাজারে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পোল্ট্রি খাতের ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা সভায় ডিএনসিআরপি মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, 'জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধির অজুহাতে ডিম ও পোল্ট্রি খাত সংশ্লিষ্ট একটি মহল "কারসাজি" করে অস্বাভাবিকভাবে মূল্য বাড়িয়েছে।'

এরপর ভোক্তা অধিকারের অভিযানসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার তদারকি ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির 'ডিম আমদানি করা হতে পারে' বলে ঘোষণার ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে ডিমের দাম কমতে থাকে। ১ সপ্তাহের মধ্যেই দাম কমে আবার আগের মূল্যে দাঁড়ায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল কাজী ফার্মের পরিচালক কাজী জাহিন হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কেউ কেউ দাবি করছে যে, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ডিমের মূল্য নির্ধারণ করে দাম বাড়ানো হয়েছিল এবং সরকারি কর্মকর্তারা পাইকারি ডিমের বাজার পরিদর্শন করে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করার পর দাম কমেছে। কিন্তু, এটি সঠিক নয়। তেজগাঁওয়ের ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে বা অন্য পোল্ট্রি কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশ করে কাজী ফার্মসের পক্ষ থেকে ডিমের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে বলেও কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। এটিও সত্য নয়।'

'কাজী ফার্মস ঢাকা, সিলেট, রংপুর, ফরিদপুর ও বগুড়ায় বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ লাখ ডিম বিক্রি করে থাকে। প্রতিটি কেন্দ্রেই ডিম নিলাম হয়। সব বড় পোল্ট্রি কোম্পানিগুলো সম্মিলিতভাবে প্রতিদিন প্রায় ৪০ লাখ ডিম বিক্রি করে, যা দেশে বিক্রি হওয়া মোট ডিমের প্রায় ১০ শতাংশ। সুতরাং পোল্ট্রি কোম্পানিগুলো চাইলেও ডিমের দাম বাড়ানোর কোনো উপায় নেই', বলেন তিনি।

ডিমের অন্যতম বৃহৎ উৎপাদক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ডায়মন্ড এগ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কায়সার আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর দাবি করছে, বড় ফার্মগুলো যোগসাজশ করে ডিমের দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু, তা যৌক্তিক নয়।'

কাজী ফার্মস লিমিটেডের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তাদের প্রতিবেদনে 'কাজী ফার্মস লিমিটেড তাদের এজেন্ট ফয়সালকে দিয়ে অযৌক্তিক নিলামের মাধ্যমে ডিমের মূল্যবৃদ্ধি করে বাজার অস্থির করেছে' উল্লেখ করে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে ফার্মটির বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য সুপারিশ করেছে।

এতে আরও বলা হয়েছে, ডিম ও লাইভ চিকেনের ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থার প্রতিটি ক্রয়-বিক্রয়কারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানাসহ মুদ্রিত রসিদ (পাকা রসিদ) সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। সমবায় সমিতি থেকে মূল্য নির্ধারণের প্রথা বাতিল করতে হবে।

নিলাম প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সরকারি সংস্থার (জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা) উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে বলেও প্রতিবেদনটিতে সুপারিশ করা হয়েছে।

প্যাকেটজাত ও অর্গানিক ডিম অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রির বিষয়টি পরীক্ষা করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে সংস্থাটির সুপারিশে।

বাংলাদেশ এগ প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. তাহির আহমেদ সিদ্দিকী জানান, দেশের জাতীয় চাহিদা মেটাতে দৈনিক প্রায় সাড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি ডিম প্রয়োজন হয়। এই ডিমগুলোর একটি বড় অংশ সারাদেশের খামার থেকে আসে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়েছে। গত এক দশকে ডিম উৎপাদনের পরিমাণ ৩ গুণেরও বেশি বেড়েছে।

ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান ও সরকার 'প্রয়োজনে প্রোটিনের মূল উৎস আমদানি করা' হবে বলে ঘোষণা দেওয়ার পর ডিমের দাম সম্প্রতি কমেছে।

Comments

The Daily Star  | English

Doubts growing about interim govt’s capability to govern: Tarique

"If we observe recent developments, doubts are gradually growing among various sections of people and professionals for various reasons about the interim government's ability to carry out its duties."

3h ago