করোনা ও রাজনীতিবিদদের দ্বন্দ্বে বিদ্যালয়টি বন্ধ আড়াই বছর

নদী গর্ভে বিলিন হওয়ার আগে বিদ্যালয় ভবন। ছবি: সংগৃহীত

টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার যমুনা নদীর চরাঞ্চলের চর চন্দনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি টানা প্রায় ২ বছর ৪ মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে বিদ্যালয়টির দের শতাধিক শিশুর শিক্ষা জীবন।

করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী বিদ্যালয়টি প্রায় ১৫ মাস বন্ধ ছিল। এরপর থেকে সেটি বন্ধ রয়েছে নদী ভাঙনে বিদ্যালয় ভবন বিলিন হওয়ার পর পুনরায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু না হওয়ায়। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না স্থানীয় রাজনীতিবিদদের দ্বন্দ্বের কারণে।

যমুনা নদীর মধ্যবর্তী চর গাবসারা ইউনিয়নের চর চন্দনী গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৩৮ সালে। ১৯৭৩ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করা হয়। ২০১৫ সালে পুরাতন ভবনের পাশে বিদ্যালয়টিতে একটি নতুন ৩তলা পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়।

নদী ভাঙনে বিদ্যালয় ভবন বিলিন হওয়ার পর বিদ্যালয়টি পুনরায় স্থাপনে স্থান নির্ধারণ নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের ২ পক্ষের বিরোধ এবং কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে গত ১৩ মাসেও বিদ্যালয়টিতে আর শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়নি।

স্থানীয়দের একটি পক্ষ চাচ্ছে বিদ্যালয়টির অধিকংশ শিক্ষার্থী নদীর পূর্ব পাড়ের বাসিন্দা হওয়ায় সেটি পূর্ব পাড়ে স্থাপন করা হোক। অপর পক্ষ চাচ্ছে পশ্চিম পাড়ে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় সেটি পশ্চিম পাড়ে স্থাপিত হোক।

বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের এখন বেশিরভাগ সময়ই দেখতে পাওয়া যায় নদীর পাড়ে খেলতে। ছবি: স্টার

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, ওই বিদ্যালয়টি অত্র এলাকার সবচেয়ে বড় ভোটকেন্দ্র। কেন্দ্রটি নিজেদের দখলে এবং সুবিধাজনক স্থানে রাখতে বিদ্যালয়টি পুনরায় স্থাপনের স্থান নিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থীদের দ্বন্দ্ব পরবর্তীতে স্থানীয় ২ সংসদ সদস্য পর্যন্ত গড়ায়।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, চর চন্দনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থাপনের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা প্রতিবেদন ও টাঙ্গাইল-২ আসনের সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনিরের আধা সরকারি পত্র সংযুক্ত করে অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছেন। ওই আধা সরকারি পত্রে এবং প্রতিবেদনে নদীগর্ভে বিলীন হওয়া স্কুলটি পুনঃনির্মানের জন্য নদীর পশ্চিম পাড় নির্বাচন করার বিষয়ে মতামত দেওয়া হয়েছে।

অপরদিকে বিদ্যালয়টি যেন পূর্বপাড়ে হয় সেই বিষয়ে সংরক্ষিত নারী আসন ৩২০-এর সংসদ সদস্য অপরাজিতা হকের সুপারিশসহ স্থানীয় অধিবাসী ও বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের পক্ষে সাবেক ইউপি মেম্বার লাল মিয়া, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম ও দুলাল মিয়া অনুরোধ জানিয়েছেন। বিদ্যালয় স্থাপনে উপযুক্ত জমি দিতে তারা ইচ্ছুক বলেও জানিয়েছেন।

গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর ২ চিঠির বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদন করা হয়েছে।

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নাজমুল মোর্শেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদীতে বিনিন হওয়ার আগে মোট শিক্ষার্থী ছিল ১৫৮ জন। বর্তমানে শিক্ষার্থী আছে ১২১ জন। বাকিদের মধ্যে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে কয়েকজন এবং অন্যরা ঝরে গেছে।'

ওই গ্রামের বাসিন্দা ওমর ফারুক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার ২ মেয়ে বিদ্যালয়টির ২য় ও ৩য় শ্রেণীর শিক্ষার্থী। কিন্তু করোনা ও নদী ভাঙনের কারণে টানা ২ বছর ৪ মাস ধরে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় তাদের শিক্ষা জীবন এখন হুমকির মুখে।'

জয়নাল আবেদীন নামে অপর এক অভিভাবক বলেন, 'বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ছেলেটা সারাদিন খেলাধুলা, মাছধরা ও ঘুরে বেড়ানো নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মাঝ নদীর নির্জন এই চরে সন্তানের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা এখন দুশ্চিন্তায়।'

ফজর আলী ও ময়দান মিয়া নামে অপর ২ অভিভাবক জানান, বিদ্যালয়টি চালু না হওয়ায় তারা তাদের মেয়েদের স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিয়েছেন।

বিদ্যালয়টির গর্ভনিং বডির সভাপতি আব্দুল লতিফ আকন্দ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদীর পশ্চিম পাড়ে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। তাই আমাদের দাবি বিদ্যালয়টি নদীর পশ্চিম পাড়ে পুনঃস্থাপন হোক।'

অপর দিকে, গর্ভনিং বডির সাবেক সভাপতি লাল মিয়া বলেন, 'নদীতে ভেঙে যাওয়ার আগে বিদ্যালয়ের ১৫৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৩৯ জন ছিল পূর্ব পাড়ের আর মাত্র ১৯ জন ছিল পশ্চিম পাড়ের বাসিন্দা। তাই আমরা চাই বিদ্যালয়টি নদীর পূর্ব পাড়েই হোক।'

তিনি আরও বলেন, 'বিদ্যালয়টি পশ্চিম পাড়ে স্থাপন করা হলে পূর্ব পাড়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী আর সেখানে যাবে না। পশ্চিম পাড়ে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই বলে দাবি করা হলেও, প্রকৃতপক্ষে কাছাকাছি আরেকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সেখানে আছে।'

ভূঞাপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এম. জি মাহমুদ ইজদানী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২ পক্ষের দ্বন্দ্ব এবং এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত আসতে দেরি হওয়ায় বিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে পারছি না।'

তিনি আরও বলেন, 'সংশ্লিষ্ট সবারই উচিত ব্যক্তিগত ইগোকে প্রাধান্য না দিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন ও ভবিষ্যতকে গুরুত্ব দেওয়া।'

টাঙ্গাইল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কার্যালয়ের চাহিদা মতো তথ্যাদি ইতোমধ্যেই আমরা প্রেরণ করেছি। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা প্রত্যয়ন দিয়েছেন যে বিদ্যালয়টি নদীর পশ্চিম পাড়ে হলে ভালো হয়, সেটিই আমি ফরোয়ার্ড করেছি।'

Comments

The Daily Star  | English

Crowd control: Police seek to stop use of lethal weapon

The police may stop using lethal weapons and lead pellets for crowd control as their widespread use during the July mass uprising led to massive casualties and global criticism.

8h ago