যে রেস্টুরেন্টের সব ওয়েটার ভুলে যাওয়া রোগে আক্রান্ত

জাপানের এই রেস্তোরাঁর সব ওয়েটার ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত। ছবি: দ্য রেস্টুরেন্ট অব মিসটেইকেন অর্ডারস এর সৌজন্যে

রেস্তোরাঁয় গিয়ে ওয়েটারকে অর্ডার করলেন, পিজ্জা আর বার্গার। কিন্তু ওয়েটার হাসি মুখে নিয়ে এলেন, পাস্তা আর চিকেন ফ্রাই। কী হবে আপনার প্রতিক্রিয়া? নিশ্চয়ই রেগে যাবেন!

কিন্তু আশেপাশে লক্ষ করবেন, রেস্তোরাঁয় বসা কোনো ব্যক্তিই অর্ডার করা খাবারটি পাচ্ছেন না। তা নিয়ে তাদের অভিযোগ নেই। বরং হাসিমুখে খেয়ে নিচ্ছেন ওয়েটারের নিয়ে আসা ভুল খাবারটি।

এমনই এক রেস্টুরেন্টের দেখা মিলবে জাপানের টোকিও শহরে। রেস্টুরেন্টের নাম 'দ্য রেস্টুরেন্ট অব মিসটেইকেন অর্ডারস'। সেখানে যারা খেতে আসেন, সবাই জানেন অর্ডারকৃত খাবারটি তাদের পরিবেশন করার সম্ভাবনা খুবই কম।

ছবি: দ্য রেস্টুরেন্ট অব মিসটেইকেন অর্ডারস এর সৌজন্যে

কেননা যারা অর্ডার নিচ্ছেন সবাই টেবিল থেকে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে সব গুলিয়ে ফেলবেন কিংবা ভুলে যাবেন। তারপর সেই ভুল করা খাবার নিয়ে কাস্টমারকে সার্ভ করতে যাবেন। কাস্টমারও হাসিমুখে সেই খাবার গ্রহণ করবেন। এটিই সেই রেস্টুরেন্টের রীতি।

সেই রেস্টুরেন্টের ওয়েটাররা সবাই 'ডিমেনশিয়া' বা 'স্মৃতিভ্রম' রোগে আক্রান্ত। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিকট অতীতের কোনো কিছু সহজে মনে রাখতে পারেন না। এই রোগের অন্যতম লক্ষণ হলো রোগীর সুদূর অতীতের ঘটনা পুরোপুরি মনে থাকে। কিন্তু, কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে রাখতে তাদের রীতিমতো হিমসিম খেতে হয়। তবে আপনি যদি ভাবেন খেয়ে টাকা না দিয়েই চলে যেতে পারবেন তাহলে ভুল করছেন। রেস্টুরেন্টে বসা ক্যাশিয়ার কিন্তু অসুস্থ নন। ওয়েটারের চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও আপনি হিসাবরক্ষককে ফাঁকি দিতে পারবেন না।

ছবি: দ্য রেস্টুরেন্ট অব মিসটেইকেন অর্ডারস এর সৌজন্যে

ব্যতিক্রমী এই রেস্টুরেন্টের মালিক শিরো ওগুনি বলেন, 'আপনার কাছে বিষয়টিকে নিছকই পাগলামি মনে হতে পারে যে একটি রেস্তোরাঁ ঠিকমতো খাবারের অর্ডারও সরবরাহ করতে পারে না! এখানকার সব ওয়েটারই ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। পরিকল্পিতভাবেই তাদের এ কাজে নেওয়া হয়েছে।'

ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষের মতই সব কাজ করতে সক্ষম সমাজকে এমন বার্তা দেওয়ার জন্যই ওগুনি এমন রেস্তোরাঁ খোলার পরিকল্পনা করেন।

ওগুনি বলেন, 'স্মৃতিভ্রমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে সবার পারষ্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধিই এই রেস্টুরেন্টের প্রধান দিক।'

জাপানের মানুষ অন্যান্য দেশের মানুষের তুলনায় বেশি দিন বাঁচেন। ফলে জাপানে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে বেশি। ডিমেনশিয়া সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

দেশটির এক চতুর্থাংশ নাগরিকের বয়স ৬৫ বছরের ওপরে। ২০১৬ সালের এক সমীক্ষায় জাপানের ন্যাশনাল পুলিশ এজেন্সি জানিয়েছে, ২০১৫ সালে ১২ হাজার ২০৮টি ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত মানুষের হারিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। যে সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।

যার ফলে জাপান সরকার বৃদ্ধ ও বয়স্ক ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে বেশকিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যে প্রকল্পের একটি হলো এই রেস্তোরাঁ। মূলত ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে ২০১৭ সালে রেস্টুরেন্টটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। শুধু জাপান নয় সারা বিশ্বে রেস্টুরেন্টটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বর্তমানে জাপানের বিভিন্ন জায়গায় এর শাখা রয়েছে।

এই রেস্টুরেন্টে যারা খেতে আসেন তারা শতভাগ নিশ্চিত থাকেন যে খাবার অর্ডার করা হচ্ছে, তা তারা পাবেন না। এ নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ তো নেই। বরং আগ্রহ নিয়ে তারা অপেক্ষা করেন ওয়েটার কোন খাবার নিয়ে ফেরত আসেন তা দেখার জন্য!

ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কিছু আনন্দময় মুহূর্ত ভাগাভাগি করার জন্যই আগ্রহীরা এই রেস্টুরেন্টে খেতে আসেন এবং তাদের উৎসাহ দেন।

'দ্য রেস্টুরেন্ট অব মিসটেইকেন অর্ডারস' এর মালিক ওগুনি বলেন, 'রেস্টুরেন্টের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩৭ শতাংশ অর্ডার ভুল ছিল। কিন্তু তারা এখন অনেকটা উন্নতির দিকে। তাছাড়া অর্ডার ভুল হলেও সমস্যা নেই। এখানকার সব খাবারই সুস্বাদু।'

রেস্টুরেন্টের গ্রাহক ও ওয়েটারদের পারষ্পরিক সহযোগিতামূলক মিথস্ক্রিয়া বিশ্বে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যে, একটু উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও সহমর্মিতার মনোভাবই আমাদের সমাজকে অনেক বদলে দিতে পারে।

Comments

The Daily Star  | English

Over 102,000 annual deaths in Bangladesh linked to air pollution

Study also finds air pollution behind 266 million sick days every year hurting the economy

1h ago