‘আইন লঙ্ঘন’ করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে মন্ত্রণালয়

আইন অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো বা সমন্বয় করার দায়িত্ব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)। কিন্তু, সর্বশেষ গত ৫ আগস্ট দেওয়া প্রজ্ঞাপনে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়িয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, যা আইনের লঙ্ঘন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, এতে বিইআরসি আইনের লঙ্ঘন হয়েছে এবং এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

বিইআরসি আইনের ৩৪ (১) ধারায় বলা হয়েছে, বলবৎ অন্য আইনে যাই থাকুক না কেন, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন কর্তৃক প্রণীত নীতিমালা ও পদ্ধতি অনুসরণে পাইকারি বাল্ক ও খুচরাভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন, এনার্জি (বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রলিয়ামজাত পদার্থ) সঞ্চালন, মজুদকরণ, বিপণন, সরবরাহ, বিতরণ ও ভোক্তা পর্যায়ে ট্যারিফ নির্ধারণ করা হবে।

আইনের ৩৪ (৪) ধারা অনুযায়ী, কমিশন লাইসেন্সি ও অন্যান্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষকে শুনানি দেওয়ার পর ট্যারিফ নির্ধারণ করবে।

বিইআরসি আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী, এই আইন লঙ্ঘন করলে অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অন্যূন ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং অপরাধ অব্যাহত থাকার ক্ষেত্রে অনধিক ৩ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।

এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াল, এতে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে। এতে বিইআরসি আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। সেই আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অপরাধী কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। তারা যেভাবে মূল্যবৃদ্ধি করল, এটা লুণ্ঠনমূলক (প্রিডিয়েটরি) বৃদ্ধি। প্রতিযোগিতা আইনের আওতায় এই মূল্যবৃদ্ধিটাকে লুণ্ঠনমূলক বৃদ্ধি বলা হয়। এভাবে মূল্যবৃদ্ধি এক ধরনের ফৌজদারি অপরাধ।'

এই যে আইনের ব্যত্যয় ঘটল, এর পেছনে মূল দায় কার, জানতে চাইলে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, 'জ্যেষ্ঠ সচিব হলেন এই মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি সব ডকুমেন্টের আইন-কানুন, বিধি-বিধান নিশ্চিত করবেন। যথাযথভাবে রাষ্ট্রের আইন ও কর্তৃত্ব মেনে তিনি সরকারের দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করবেন। মূল্যবৃদ্ধির ফাইলে তো তিনি এটা লিখেন নাই যে আইনে কী বলা আছে। মূল্যবৃদ্ধির পর আমরা যে প্রশ্নগুলো তুলছি, সে বিষয়গুলো ফাইলে নোট হিসেবে দিয়ে তারপর সিদ্ধান্তের জন্য ফাইল সরকারের কাছে পাঠানোর কথা ছিল। নির্বাহী আদেশের ফাইলে তো সেই নোট নেই। আইনের যে ব্যত্যয় ঘটছে, সচিব ও তার অফিস সেটা সরকারের কাছে আড়াল করেছে।'

'সুতরাং সচিব এক্ষেত্রে দায়ী', যোগ করেন তিনি।

বিইআরসি আইনের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০০৩ সালে আইনের মাধ্যমে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে যে, জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের এখতিয়ার বিইআরসির। সেই আইনেই বলা আছে যে, জ্বালানি বলতে বোঝানো হয়েছে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রলিয়ামজাত পণ্য। ২০০৩ সালের পর থেকেই বিইআরসি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করছে। বিদ্যুতের দামও নির্ধারণ করছে। শুধু এলপিজি নিয়ে ঝামেলা ছিল, যেটা ২০০৯ সালের পর থেকে তারা আর করেনি। এরপর আদালতের আদেশের পরে ২০২১ সাল থেকে আবার তারাই করছে।'

'এখন পেট্রলিয়ামজাত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ তারা (বিইআরসি) একবারও করেনি। ২০০৩ সালের আগে যখন বিইআরসি আইন ছিল না, তখন পর্যন্ত সরকারি আদেশে বিপিসি বা মন্ত্রণালয় তেলের দাম নির্ধারণ করেছে, এতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু, যখন ২০০৩ সালে একটা নির্দিষ্ট আইন হলো, এরপর থেকে তেল বা পেট্রলিয়ামজাত যেকোনো পণ্যের দাম বাড়াতে মন্ত্রণালয় যতগুলো আদেশ দিয়েছে, সবগুলো অবৈধ। এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিইআরসি আইনে এটা স্পষ্ট করে বলা আছে এবং এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে বিইআরসি কী করবে, সেই ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়েছে', বলেন তিনি।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আরও বলেন, 'ফার্নেস ওয়েলের দাম বাড়ানোর আগে গত বছরে নভেম্বরে যখন পেট্রলিয়ামের দাম বাড়ানোর আদেশ দেওয়া হলো, আমরা তখন ক্যাবের পক্ষ থেকে একটা রিট করে বললাম যে, তারা (মন্ত্রণালয়) যে বারবার দাম বাড়াচ্ছে, তাদের তো কোনো এখতিয়ারই নেই। বিইআরসি একটা চিঠি দিয়েও বলে না যে, তারা কেন দাম বাড়াচ্ছে, সেটা তো আমরা নির্ধারণ করব! এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, বিইআরসি একটা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং মন্ত্রণালয়ও রাষ্ট্রেরই অংশ। তাহলে বিইআরসি করা আর মন্ত্রণালয়ের করার মধ্যে পার্থক্য কী? পার্থক্য হচ্ছে মৌলিক জায়গায়। যেহেতু আইন আছে, সরকারকে আইন মানতে হবে। কিন্তু, দেখা যাচ্ছে সরকার নিজেই আইন মানে না। এটা একটা রূঢ় বাস্তবতা। এটা গর্হিত অপরাধ।'

ভোক্তা অধিকারের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, 'মন্ত্রণালয় যখন দাম নির্ধারণ করছে, তখন সেটা নিয়ে আমাদের কথা বলার বা মত দেওয়ার সুযোগ থাকছে না। তারা একটা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করে ফেলছে। কিন্তু, যদি বিইআরসির মাধ্যমে হয়, তারা স্টেক হোল্ডারদের কাছ থেকে শুনে, গণশুনানি করে দাম নির্ধারণ করবে। অর্থাৎ আমরা যদি কোনো বক্তব্য দেই, সেটা আমলে নেওয়ার সুযোগ আছে, যেটা সম্প্রতি গ্যাসের ক্ষেত্রে ঘটেছে। প্রস্তাবনায় গ্যাসের দাম যে পরিমাণ বাড়ার কথা বলা হয়েছিল, সে পরিমাণ বাড়ানো হয়নি। কারণ, ক্যাবসহ স্টেক হোল্ডার, রাজনৈতিক-অধিকার কর্মীরা গিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন যে, গ্যাসের দাম এত বাড়ানোর সুযোগ নেই। প্রতিটা ক্ষেত্রে লুণ্ঠনমূলক মূল্যবৃদ্ধি। ফলে তারা গ্যাসের দাম এতটা বাড়াতে পারেনি।'

'তেলের ক্ষেত্রে সে সুযোগ থাকলে আমরা যদি দেখাতে পারতাম যে বিপিসি একটা ব্যাংকে পরিণত হয়েছে, তারা লাভ করে, অথচ লোকসান দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছে, তাহলে তো এত দাম বাড়ানোর সুযোগ ছিল না। এতে করে জ্বালানির ওপর নাগরিক বা ভোক্তার যে অধিকারটা আছে, সেটা প্রতিষ্ঠার সুযোগ থাকত। কিন্তু, মন্ত্রণালয়ে তো আমাদের কথা বলার সুযোগ নেই। তাদের যা মনে হলো বাড়িয়ে দিয়েছে। কোনো ব্যাখ্যা তাদের দিতে হচ্ছে না', যোগ করেন এই আইনজীবী।

এ বিষয়ে বিইআরসি চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আইনগতভাবে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করবে বিইআরসি। আইনের ৩৪ ধারায় বলা আছে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে বিইআরসি প্রবিধান করবে। সেই প্রবিধান আজ থেকে ১০ বছরেও বেশি সময় আগে আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। কিন্তু, তারা সেটিতে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং নেয়নি, সরকারের কাছেও পাঠায়নি।'

'আমরা আমাদের কাজ করে দিয়েছি। বাকি দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের। তারা সেটা করছে না বলে আমরা পারছি না। আদালতে ক্যাবের মামলা রয়েছে। আমরা সেখানেও জানিয়েছি যে আমরা আমাদের আইনগত দায়িত্ব পালনে সদা প্রস্তত', বলেন তিনি।

জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানোয় আইনের ব্যত্যয় হয়েছে কি না, এ বিষয়ে গত ৬ আগস্ট বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক যুক্তিতে এতে আইনের ব্যত্যয় হয়। আরেক যুক্তিতে হয় না।'

শুনানি বা ভোক্তা পর্যায়ে আলোচনা করা দরকার ছিল কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'কয়েকবার (দাম) বাড়ানোর প্রয়োজন হয়, কারণ এখন মার্কেট ভোলাটাইল। এ পর্যায়ে প্রতিবার শুনানি করতে গেলে তো সমস্যা থেকে যাবে। ৯০ দিনের সময় দিয়ে, শুনানি করে দাম বাড়াতে গেলে তো সমস্যা হয়ে যাবে।'

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় বিইআরসি আইন লঙ্ঘন করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে কি না, জানতে মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মাহবুব হোসেনকে ২ বার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোনো জবাব দেননি।

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhoury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands.

9h ago