ডিবি তুলে নেয় ভোর ৬টায়, ‘তুই কি হিরোর মতো, নাম পরিবর্তন করবি’

‘তোর চেহারা কি হিরোর মতো? আয়নায় একবার নিজের চেহারা দেখেছিস? হিরোদের চেহারা কেমন হয় সিনেমায় দেখিস না? তোর হিরো আলম নাম পরিবর্তন করবি।’
হিরো আলম
হিরো আলম। ছবি: সংগৃহীত

'তোর চেহারা কি হিরোর মতো? আয়নায় একবার নিজের চেহারা দেখেছিস? হিরোদের চেহারা কেমন হয় সিনেমায় দেখিস না? তোর হিরো আলম নাম পরিবর্তন করবি।'

`তোর জন্য আমরা মুখ দেখাতে পারি না। বাইরের দেশে তোর জন্য আমাদের অপমান করে। তুই বাংলাদেশের হিরো এটা শুনতে লজ্জা লাগে। তোর নামে অনেক মামলা। এখন বল তুই কী করবি? তুই এতগুলো অন্যায় করেছিস। সাইবার ক্রাইমে তোর ৭ বছর জেল হবে। এখন কী করবি বল?'

ডিবি অফিসে কী হয়েছিল- আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত কন্টেন্ট ক্রিয়েটর আশরাফুল আলম সাঈদ ওরফে হিরো আলম আজ শুক্রবার তা জানান দ্য ডেইলি স্টারকে। 

হিরো আলমকে বুধবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। আর কোনো দিন রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত গাইবেন না এবং পুলিশের পোশাক ব্যবহার করবেন না এই মর্মে মুচলেকাও দিয়েছেন হিরো আলম।

হিরো আলম বলেন, বুধবার ভোর ৬টার দিকে ডিবির লোকজন তার রামপুরার অফিস থেকে তাকে তুলে আনে। দুপুর ২টার দিকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ছেড়ে দেওয়ার আগে তাকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ করেন হিরো আলম। 

হিরো আলম বলেন, 'তারা যখন ভোর ৬টার দিকে আমার অফিসে আসে, তখন আমি শুয়েছিলাম। তারা আমার পিসি নিয়ে যেতে চায়। হার্ডডিস্ক খোলা ছিল। তারা বলে হার্ডডিস্ক কই? তোর এখানে অশ্লীল কাজকর্ম হয়, তুই অশ্লীল উল্টাপাল্টা কাজকর্ম করিস। তোর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। আমি তখন কিছুই বলিনি। তারা কে বা কারা পরিচয়ও দেয়নি। আমাকে বলে, চল আমাদের সঙ্গে। আমি তখন কিছু না বলে তাদের সঙ্গে যাই।'

তিনি আরও বলেন, 'ডিবি অফিসে যাওয়ার পর পুলিশ বলে, তুই জানিস তোর নামে কত রিপোর্ট? তোর অত্যাচারে আমরা থাকতে পারছি না। তারা তুই-তুকারি করে কথা বলে এবং খারাপ ব্যবহার করে। কে আমার নামে রিপোর্ট করেছে জানতে চাইলে তখন তারা মডেল পিয়াসা, মৌ, ডাক্তার মুরাদ হাসানের কথা বলে। পুলিশের পোশাক পরে কাজ করেছি সেটির অভিযোগ দেখায় এবং সবশেষ বলে, তুই রবীন্দ্র সংগীত গাইলি কেন?'

'আমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে। গায়ে হাত তোলা ছাড়া সব ধরনের খারাপ ব্যবহার করে। অনেক গালিগালাজ করে। বলে, তুই নিজেকে হিরো দাবি করিস, তোর চেহারা কি কোনোদিন আয়নায় দেখেছিলি (গালি)…। তোর নাম আজ থেকে পাল্টাবি। হিরো আলম পরিবর্তন করবি। হিরো কী তুই বুঝিস?', যোগ করেন তিনি।

হিরো আলম। ছবি: সংগৃহীত

হিরো আলমের ভাষ্য, 'তারা যখন জেলের কথা বলে তখন আমি বলি, ভবিষ্যতে এমন গান করব না এবং পুলিশের পোশাক পরে আর কাজ করব না। তারা বলে, তুই তাহলে বিপাশা, মৌ তাদের কাছে ভিডিওতে মাফ চা। ভবিষ্যতে তুই এমন কাজ করবি না তার প্রমাণ কী? তাহলে তুই মুচলেকা দে। আমি মুচলেকা দিতে চাইনি। তারা জোর করে আমার থেকে মুচলেকা নিয়েছে।'

হিরো আলম বলেন, 'ওরা আমাকে বললেই আমি ডিবি অফিসে যেতাম। এভাবে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার কী দরকার ছিল? তারা বুঝাতে চেয়েছে আমি আপসে গেছি। কিন্তু আমি তো আপসে যাইনি। আমাকে তারা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। লোক দেখানোর জন্য তারা নিজেরাই আমার হেঁটে যাওয়ার ভিডিও করে। হেঁটে যাওয়ার ভিডিওটি দুপুর ১টার দিকের। জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করার পর যখন আমি চলে আসব, ঠিক তার কিছুক্ষণ আগে তারা সেই ভিডিও ধারণ করে।'

ডিবি অফিসের ৮ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে হিরো আলম বলেন, 'সকালে নিয়ে যাওয়ার পরপরই তারা বিভিন্ন প্রশ্ন করা শুরু করে। সকালে আমাকে বলে, খাবার খা। আমি যখন বলি খাব না, তখন তারা আবার খারাপ ব্যবহার শুরু করে। বলে, খাবি না কেন? আমার সামনে খা। তোর কোনো কথা চলবে না। আমরা যা বলি তাই চলবে।'

তিনি বলেন, 'আমার সম্মানবোধ বলতে কিছু আছে। কিন্তু তারা সেই সম্মানবোধ দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেনি। নাগরিক হিসেবে আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করার কথা ছিল তা করেনি। বাংলাদেশের কোনো আইনে নেই যে আমার নাম পরিবর্তন করতে হবে, এমন আইন নেই যে আমি নির্দিষ্ট কোনো গান গাইতে পারব না, অভিনয় করতে পারব না।'

গরিব বলেই তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করা হয়েছে দাবি করে হিরো আলম বলেন, 'তারা আমাকে সাবধান করতে পারত। কিন্তু আমার সঙ্গে যা করেছে তা অন্যায় এবং জুলুম। আমি একা সংগ্রাম করে আজকের জায়গায় এসেছি। এদেশে শুধু আমি একা না, আরও অনেকে আছেন যাদের গান হয় না, অভিনয় হয় না, উচ্চারণ ঠিক না। কই তাদের ডেকে তো মুচলেকা নেওয়া হয় না। আমি গরিব, দুর্বল, আমার কোনো লোক নেই তাই তারা আমার সঙ্গে এই অন্যায় করেছে। আমার সঙ্গে যা হয়েছে অন্য কারো সঙ্গে যেন তা না হয়।'

গান ও অভিনয় চালিয়ে যাবেন জানিয়ে হিরো আলম বলেন, 'মানুষকে ভালো হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। আমি যদি ভালো কোনো জায়গায় সুযোগ পেতাম তাহলে আমিও ভালো করতে পারতাম। আমাকে রোস্ট করে অনেক ইউটিউবার আয় করেন, আমি নিজে যে টাকা আয় করি তা দিয়ে গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াই। আমি কী দেশের জন্য কিছুই করি না? আমি আমার গান ও অভিনয় চালিয়ে যাব।'

হিরো আলমের থেকে পুলিশ এভাবে মুচলেকা নিতে পারে কি না জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে সাংস্কৃতিক কোনো জায়গায় হস্তক্ষেপ করে না। তবে কেউ অভিযোগ করলে তখন পুলিশ ব্যবস্থা নেয়। হিরো আলমকে পুলিশ স্বেচ্ছায় ডেকে নেয়নি। বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে ডেকে নেওয়া হয়। ছেড়ে দেওয়ার সময় কোনো না কোনো কাগজে তো তাকে সই করতে হয়। তাই তার মুচলেকা নেওয়া হয়েছে। নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত সবাই গাইতে পারে। এখানে কোনো আপত্তি নেই। তবে মানুষ যাতে কোনো অভিযোগ না করে। অভিযোগ করলেই তো পুলিশকে এগিয়ে আসতে হয়।'

হিরো আলম
হিরো আলম। ছবি: সংগৃহীত

পুলিশ কারো নাম পরিবর্তন করতে বলতে পারে কি না এবং কাউকে অসম্মান করে কথা বলতে পারে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এমন যদি কিছু হয়ে থাকে সেটি অবশ্যই দুঃখজনক। পুলিশের উচিত অবশ্যই সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলা।'

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হেফাজতে নিয়ে নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের একটি আইন আছে। হিরো আলমের সঙ্গে যা হয়েছে তা মানসিক নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে। যারা হিরো আলমকে ধরে নিয়ে গেছেন হিরো আলম তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারেন। আইনি প্রতিকার পেতে পারেন।'

তিনি বলেন, 'দেশের কোনো নাগরিক কী নাম রাখবে, তার কেমন চুলের ছাঁট হবে সেটি তার একান্ত ব্যক্তিগত এখতিয়ার। সংবিধানে আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নীতি নৈতিকতার কিছু কথা আছে। কিন্তু এই নীতি নৈতিকতা নির্ধারণ করবে কে? এটি তো সমাজ থেকেই তৈরি হয়। সমাজ যে বিষয়টি ধারণ করছে সেটি পুলিশ নির্ধারণ করার কেউ না। পুলিশের কাজ হলো কেউ যাতে আইন লঙ্ঘন না করে তা বাস্তবায়নের জায়গাটি নিশ্চিত করা। এভাবে কাউকে ধরে আনাটাই এখতিয়ার বহির্ভূত, সংবিধান বিরোধী। ফৌজদারি আইনের যেসব বিধিবিধান আছে কিংবা পুলিশের যে ১৮৬১ সালের আইন বা তাদের ১৯৪৩ সালের যে পুলিশ রেগুলেশন অফ বেঙ্গল সেটাতেও কিন্তু এসব আচার-আচরণের কোনো সুযোগ নেই। তাদের পুরো আচরণটাই বেআইনি, অবৈধ। যে কোনো শ্রেণির নাগরিক হোক না কেন, সবাই সমান ব্যবহার পাওয়ার অধিকার রাখেন।'

`পুলিশের এভাবে হিরো আলমের থেকে মুচলেকা নেওয়ার এখতিয়ার নেই। তাদের পুরো কর্মকাণ্ড আইন বহির্ভূত এবং এখতিয়ার বিহীন। পুরো বিষয়টি নিয়ে হিরো আলম আইনের দারস্থ হতে পারেন এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে,' তিনি যোগ করেন।

হিরো আলম জানান, ডিবির কর্মকর্তা নাজমুল হকের নেতৃত্বে তাকে ডিবি অফিসে নিয়ে আসা হয়।

এই বিষয়ে কথা বলতে নাজমুল হকের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। পরিচয় ও বিষয় উল্লেখ করে এসএমএস পাঠালেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

Comments

The Daily Star  | English

Classes resume in DU after over 3 months

Classes and exams began around 10:00am, with students from dormitories and off-campus locations returning to participate

48m ago