হিরো আলম কি জোকার, প্রতিবাদী না ব্যবসায়ী?

'আপনারা হিরো আলমকে নিয়ে বেশি কথা বলেন, মাতামাতি করেন, এ জন্যই সে হিরো হয়েছে; হিরো আলমের মতো লোকও যে একজন তারকা—এটি কি আপনার আমার সবার জন্য লজ্জার নয়?'

হিরো আলমকে নিয়ে এ রকম অনেক মন্তব্য ফেসবুকে পাওয়া যাবে। হয়তো আপনি নিজেও এ রকম মন্তব্য লিখেছেন বা মনে মনে ভেবেছেন। হিরো আলমকে নিয়ে জনপরিসরে এই যে বিবিধ আগ্রহ, উদ্বেগ এবং তাকে নিয়ে আলোচনা ও রসিকতার ভেতরে অনেকে যে শ্রেণিবিদ্বেষেরও গন্ধ পান—তাতে করে হিরো আলম এখন একটি 'ডিসকোর্স' বটে!

প্রশ্ন হলো, হিরো আলম কি জোকার, প্রতিবাদী, নাকি নিছকই একজন ব্যবসায়ী—যিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে শুধু পয়সা কামাতে চান?

হিরো আলম যদি নিছকই একজন জোকার হন, তাহলে তার কর্মকাণ্ড নিয়ে মানুষ রসিকতা করবে, ব্যঙ্গ করবে সেটিই স্বাভাবিক। কারণ জোকারের কর্মকাণ্ড দেখে মানুষ যদি না হাসে, তাহলে সেটি জোকারের ব্যর্থতা। সুতরাং হিরো আলম যদি জোকার হন, তাহলে তিনি সফল।

কিন্তু অনেকেই মনে করেন, হিরো আলম আমাদের অগণিত সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ। অনেকে তাকে পশ্চিমবঙ্গের রোদ্দুর রায়ের সঙ্গে তুলনা করেন—যিনি তার মুখভঙ্গি বিকৃত করে বা তার মতো করে 'মোক্সা কবিতা' পাঠ করেন—যে কবিতাগুলো অশ্লীলতায় ভরপুর হলেও সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদও সেখানে আছে। অর্থাৎ গালাগালির মধ্য দিয়েই তিনি প্রতিবাদ করেন।

মুশকিল হলো, রোদ্দুর রায়ের যে পড়াশোনা, কবিতা ও সংগীত নিয়ে তার যে জানাশোনা—তার সঙ্গে হিরো আলমের তুলনা করাটাও আরেকটি রসিকতা। প্রশ্ন হলো, হিরো আলম কিসের প্রতিবাদ করছেন? রবীন্দ্রনাথের গান তার ভাষায় গেয়ে কিংবা ভুলভাল উচ্চারণ ও হাস্যকর ঢংয়ে আরবি গান গেয়ে তিনি কার বিরুদ্ধে এবং কোন ঘটনার প্রতিবাদ জানালেন?

রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার পরেই যে তাকে নিয়ে সমালোচনা বেশি হচ্ছে তা নয়। বরং তিনি যখন থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছেন তখন থেকেই। মূলত মানুষের এই সমালোচনা ও রসিকতাকে পুঁজি করেই হিরো আলম ধীরে ধীরে নিজের জায়গা শক্ত করেছেন। এটিই তার ব্যবসার কৌশল। বগুড়ার মতো জায়গায় ডিশ লাইনের ব্যবসা করে তিনি যে পয়সা কামাতেন, তার চেয়ে বহু গুণ পয়সা এখন তিনি কামান 'গান' গেয়ে। সেই গান ঠিক গান হলো কি না, তা নিয়ে তার ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ যে প্রয়োজনে তিনি এই লাইনে এসেছেন, সেখানে সফল হয়েছেন। সফলতার মানদণ্ড যেহেতু ব্যক্তিভেদে ভিন্ন—অতএব হিরো আলম তার মতো করে সফল এবং তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনিও নিশ্চয়ই নিজেকে একজন সফল মানুষ হিসেবেই দাবি করবেন।

হিরো আলমকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ যে ট্রল করে, তাকে নিয়ে যে রসিকতা করে, তারও সমালোচনা আছে। অনেকেই হিরো আলমকে নিয়ে যেকোনো ধরনের রসিকতাকে 'শ্রেণিবিদ্বেষ' বলে ভাবেন। কিন্তু হিরো আলমকে নিয়ে রসিকতাকে শ্রেণিবিদ্বেষ ভাবাটাও সমাজের অগ্রসর অংশের মানুষ বলে প্রমাণ করতে চাওয়া কি না—সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। অর্থাৎ যেহেতু মানুষ হিরো আলমকে তার পড়ালেখা, চেহারা, গলা, পোশাক এবং সর্বোপরি তার যোগ্যতার কারণে কটাক্ষ করে, অতএব তার পক্ষে দাঁড়াতে হবে। এই পক্ষে দাঁড়ানোর পেছনে মূলত নিজেকে অন্যের থেকে আলাদা করতে চাওয়ার মানসিকতাই কাজ করে বলে মনে হয়।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ নিতে চেয়েছিলেন হিরো আলম। বগুড়া-৪ আসনে নির্বাচন করতে তিনি জাতীয় পার্টির মনোনয়ন ফরম নিয়েছিলেন। দলের তৎকালীন কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে মনোনয়ন ফরম হাতে তার হাস্যোজ্জ্বল ছবিও তখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

তখনও হিরো আলমের এই মনোনয়ন সংগ্রহের ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল হয়। পক্ষান্তরে এ প্রশ্নও তখন সামনে আসে যে, সংবিধান যেহেতু কেবল মানবতা বিরোধী অপরাধে দণ্ডিত এবং পাগল ছাড়া যে কাউকেই (২৫ বছর হলেই) নির্বাচন করার অধিকার দিয়েছে; সেখানে শিক্ষা-দীক্ষারও যেহেতু কোনো শর্ত নেই; এমনকি সংসদ সদস্য বা আইনপ্রণেতা হওয়ার জন্যও যেখানে ন্যূনতম পড়ালেখা জানার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, সেখানে হিরো আলমের সংসদ সদস্য হতে বাধা কোথায়? কারণ নির্বাচনে অংশ নেওয়া তার সাংবিধানিক অধিকার।

আসলে হিরো আলমের রাজনীতিতে যোগ দেওয়া এবং মনোনয়ন চাওয়াটাও এক ধরনের রসিকতা। তিনি নিজেও জানতেন যে তাকে নমিনেশন দেওয়া হবে না, কিন্তু তিনি চেয়েছেন। কারণ তিনি জানতেন এটা নিয়ে সংবাদ হবে এবং মানুষ তাকে নিয়ে আরেক দফা রসিকতা করবে।

অর্থাৎ হিরো আলম কাটতি চান এবং তিনি যেহেতু গান জানেন না, সুর ও তাল বোঝেন না, গানের গলাও তার নেই, অতএব তিনি নিজেও বুঝে গেছেন যে, স্বাভাবিক পথে তার পক্ষে তারকা হওয়া কিংবা ইউটিউব ও ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে পয়সা কামানো সম্ভব নয়। ফলে তিনি জোকারির পথ বেছে নিয়েছেন এবং পাবলিক এটাই খেয়েছে।

পাবলিক যত খাবে, ইউটিউব চ্যানেলের তত লাভ। আমরা খেয়াল করলে দেখব, আমাদের দেশের ইউটিউবে যেসব কনটেন্ট যত বেশি নিম্নমানের, নিম্ন রুচির, সেগুলোর ভিউ-শেয়ার-লাইক তত বেশি। মানে নিম্নমানের ও নিম্ন রুচির কনটেন্টের আয় বেশি।

এখন অনেকে হয়তো প্রশ্ন তুলবেন, কোন কনটেন্ট নিম্নমানের সেটি আমি বলার কে? মান কে নির্ধারণ করেন ইত্যাদি। সেটি অন্য তর্ক। আমরা বলছি, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলিত থাকা রুচির প্রসঙ্গে। অনেকে এই প্রচলিত ধারার রুচির বিরোধিতা করাটাকেও প্রতিবাদ মনে করেন। সেই অধিকারও তদের রয়েছে। সেটি অন্য তর্ক এবং অনেক বড় বিতর্কের ইস্যু। আমরা বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকে যেগুলোকে অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ ও নিম্নমানের বলে চিনি বা বুঝি, সেই আলোকেই বলছি।

সেই আলোকে আমরা যেসব কনটেন্টকে সিরিয়াস কনটেন্ট বলে চিনি, যেমন সংবাদ ও টেলিভিশনের টকশো—তাও অনেক সময় ভাইরাল হয় বা বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সেখানেও খেয়াল করলে দেখা যাবে, পুরো সংবাদ বা পুরো আলোচনাটি নয়, বরং সংবাদের সবচেয়ে ব্যঙ্গাত্মক, সবচেয়ে হাস্যকর, সবচেয়ে খারাপ, সবচেয়ে কদর্য অংশগুলো কেটে অর্থাৎ এডিট করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ৫০ মিনিটের আলোচনার মধ্যে যে ২-৩ মিনিট ঝগড়া হয়েছে, ওই অংশটুকু কেটে ইউটিউব ও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং মানুষের যেহেতু পুরো ৫০ মিনিট ধরে কোনো কনটেন্ট দেখার ধৈর্য বা সময় নেই, ফলে সে তার হাজারো ব্যস্ততার মধ্যে ওই ২-৩ মিনিটই দেখেন এবং মজা পান।

সিরিয়াস কনটেন্ট মানুষকে হয়তো নতুন কিছু শেখায়। কিন্তু মানুষ এখন যতটা না শিখতে, তার চেয়ে বেশি শেখাতে চায়। আবার ভাবে যে, এত শিখে কী হবে? কারণ হীরক রাজা আগেই বলে গেছেন, যত বেশি জানে তত কম মানে। আবার শেখার কোনো শেষ নেই, শেখার চেষ্টা বৃথা তাই। সুতরাং শিক্ষণীয় কনটেন্টের খাওয়া নেই। মানুষ হিরো আলমকেই খায়।

মানুষ তাকে নিয়ে যে ভাষায় বা যে ভঙ্গিতেই রসিকতা করুক না কেন, তিনি আলোচনায় থাকছেন। মানুষ তার নাম উচ্চারণ করছে। অর্থাৎ যেভাবেই হোক তিনি আলোচনায় থাকতে চান। তাতে মানুষ তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করুক আর প্রশংসাই করুক। যেহেতু তিনি নিজেও জানেন যে, গান গেয়ে প্রশংসিত হওয়ার যোগ্যতা তার নেই, অতএব নিন্দাকেই তিনি গলার মালা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এই গ্রহণ করতে পারাটাও কম সাহসের নয়।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

5 Edn institutions: Academic life of 40,000 in disarray

Academic activities in five major educational institutions in Dhaka remain suspended for the past week amid multiple incidents of clashes, affecting at least 40,000 students.

3h ago