র‍্যাবের অভিযানের পর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা হয়ে গেল চাঁদাবাজির মামলা

রাজধানীর মিরপুরে এক কিশোরের মোটরসাইকেলের ধাক্কায় আহত হন এক বৃদ্ধ। দুর্ঘটনার পর ৮ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা হয়। অথচ আহত বৃদ্ধ, তার পরিবার বা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা চাঁদাবাজি সম্পর্কে বলতে পারছেন না কিছুই।

রাজধানীর মিরপুরে এক কিশোরের মোটরসাইকেলের ধাক্কায় আহত হন এক বৃদ্ধ। দুর্ঘটনার পর ৮ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা হয়। অথচ আহত বৃদ্ধ, তার পরিবার বা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা চাঁদাবাজি সম্পর্কে বলতে পারছেন না কিছুই।

ঘটনাটি গত ৭ মার্চ সন্ধ্যার। মিরপুর ১২ নম্বরে বায়তুর রহমান জামে মসজিদের সামনে এক কিশোরের মোটরসাইকেলের ধাক্কায় আহত হন আব্দুল বারেক (৬০)।

স্থানীয়রা প্রথমে তাকে নিকটবর্তী হাসপাতালে এবং পরে জাতীয় অর্থোপেডিক বা পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যান।

সে রাতেই বাম হাতে প্লাস্টার করে বাসায় ফেরেন তিনি।

ঘটনার ৩ দিন পর র‌্যাব ৪ এর মামলার খসড়ায় পুরো ঘটনাটিকে অন্যভাবে বর্ণনা করা হয়।

এতে দুর্ঘটনা বা বাইকারের কোনো উল্লেখ নেই। সেখানে ৮ কিশোরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কলেজ শিক্ষার্থী ৫ ও স্কুল শিক্ষার্থী ২ জন।

এই ৮ কিশোরের বিরুদ্ধে র‍্যাব যে অভিযোগ এনেছে তা হলো: 'তারা চা বিক্রেতা বারেককে মারধর, আহত করে ৪০ হাজার ৫০০ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে।'

অভিযুক্তদের মধ্যে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরের বাবা মোহন মিয়া ২০১৮ সালে 'গুম' হন বলে জানা গেছে। মিরপুর ২ নম্বরে জমি নিয়ে স্থানীয় একজনের সঙ্গে বিরোধের পর তিনি নিখোঁজ হন।

মোহন মিয়ার বাবা জমশের আলী এবং কয়েকজন স্থানীয় এমনই সন্দেহ করেন। তাদের ধারণা, জমি নিয়ে বিরোধের ঘটনায় র‌্যাবের কয়েকজন সদস্য তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

জমশেরের বিরোধী পক্ষের প্ররোচনায় র‍্যাব মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই কিশোরদের 'একটা শিক্ষা দিতেই' ওই চাঁদাবাজির মামলা করেছে বলে তারা মনে করছেন।

দুর্ঘটনায় আহত বৃদ্ধ বারেকের ছেলে নাজমুল হোসেন বাপ্পী মামলার বাদী। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে চেয়েছিলাম।'

কিন্তু, তিনি নিজে মামলার এজাহার সম্পর্কে জানতেন না এবং র‌্যাবের লিখে রাখা মামলার বিবরণীতে সই করেছিলেন বলে জানান।

তার অভিযোগ, মামলার আগে র‌্যাব তাকে ও অভিযুক্তদের মধ্যে ৫ জনকে পাইকপাড়ার র‌্যাব ৪ এর কার্যালয়ে প্রায় ২৪ ঘণ্টা আটকে রেখেছিল। সেখানে খসড়া করা মামলার কাগজে সইয়ের পর, তাদের সবাইকে পল্লবী থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে গিয়ে ৫ শিক্ষার্থীকে পুলিশে হস্তান্তর করে র‍্যাব।

মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম মামলার তদন্ত চলমান আছে উল্লেখ মন্তব্য করতে রাজি হননি।

র‌্যাব ৪ এর কোম্পানি কমান্ডার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'আমরা আইন মেনেই সব কিছু করেছি।'

সেদিন যা হয়েছিল

সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে বারেক জানান, তার দোকানের জন্য কিছু মালামাল কিনে বাড়ি ফেরার সময় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা হয়।

তিনি জানান, মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল আনুমানিক ১৫ বছরের এক ছেলে। সে একাই ছিল। দুর্ঘটনার পর সে সেখান থেকে চলে যায়।

বারেক বলেন, 'পরে জানতে পারি আমার ছেলে মামলা করেছে। আমি ভেবেছিলাম দুর্ঘটনার জন্য আমরা হয়তো কিছু ক্ষতিপূরণ পাব। এখন দেখি পুরো ঘটনাই পাল্টে গেছে।'

মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা ৩ মোটরসাইকেলে করে মিরপুর ১২ নম্বরে বারেকের চায়ের দোকানের সামনে গিয়ে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে।

প্রত্যাখ্যান করায়, তারা তাকে লোহার পাইপ দিয়ে মারধর করে। এতে তার এক হাত ভেঙে যায় এবং তার মাথা ও শরীরের অন্যান্য অংশ আঘাতপ্রাপ্ত হয়।

সরেজমিনে ঘটনাস্থলে দেখা যায়, চায়ের দোকান থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। বারেক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মামলার বক্তব্য কিছুই সত্য নয়।'

১০ মার্চ দায়ের করা ওই মামলায় আরও বলা হয়, 'আসামিরা এলাকায় চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত "সুমন-হাবিব" চক্রের সদস্য।'

স্থানীয়রা বলছেন, ওই এলাকায় এ রকম একটি গ্যাং ছিল। তবে অভিযুক্ত ও তাদের পরিবারের সদস্যরা এই গ্যাংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে।

ভেতরের গল্প

সেদিনের ওই মোটরসাইকেলটি ধার করেছিল ওই কিশোর। মোটরসাইকেলে ঘুরতে গিয়ে বারেককে ধাক্কা দিয়েছিল সে। দুর্ঘটনার পর সে মোটরসাইকেলটি সেখানে ফেলে পালিয়ে যায়।

পরে সে মোটরসাইকেলের মালিক নাহিদুল ইসলাম নীরবসহ (১৯) ও আরও কয়েকজন বন্ধুকে দুর্ঘটনার কথা জানায়। বাইক ফেরত পাওয়ার আশায় তারা ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব দিয়ে বৃদ্ধ বারেকের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

তারা বারেকের চিকিৎসার বিষয়েও সহযোগিতা করে।

নীরব ও তার ৪ বন্ধুর সঙ্গে বাপ্পীর কথা হয় যে তারা পরদিন ৮ মার্চ ক্ষতিপূরণ দিয়ে বাইক ফেরত নিতে যাবে।

বছরখানেক আগে আরেকটি পৃথক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাপ্পীর ভাই মারা গিয়েছিলেন। সেই ক্ষোভ বাপ্পীর মাঝে ছিল।

স্থানীয়ভাবে র‌্যাবের সোর্স হিসেবে পরিচিত এক ব্যক্তি ওই শিক্ষার্থীদের 'উচিত শিক্ষা' দিতে বাপ্পীকে প্ররোচিত করেন ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে তাকে সাহায্য করতে পারবেন বলে জানান।

ভাইয়ের দুর্ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বাপ্পীকে তিনি বলেন, 'এই ছেলেদের শিক্ষা দেওয়া উচিত।'

৮ মার্চ সন্ধ্যায় মোটরসাইকেলের মালিক নীরব ও তার ৪ বন্ধু মীমাংসার জন্য যখন বাপ্পীদের এলাকায় যায়, ঠিক তখনই র‌্যাব সেখানে অভিযান চালায়।

মামলার অন্যতম আসামি হাবিবুর রহমান পায়েল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'র‍্যাবের অভিযানের পরই সবকিছু অন্যদিকে মোড় নেয়।'

তিনি বলেন, 'আমরা যখন বারেকের বাসায় ঢুকতে যাচ্ছিলাম, তখন সাদা পোশাকে কয়েকজন র‌্যাব সদস্য ঘটনাস্থলে চলে আসে। ৯ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা র‌্যাব হেফাজতে ছিলাম। পরে আমাদের পল্লবী পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।'

তাদের কাউকেই এর মধ্যে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।

নীরব, পায়েলসহ ওই ৫ জনের সঙ্গে র‌্যাব ৪ এর অফিসে গিয়েছিলেন বাপ্পীও। তিনি বলেন, 'আমি বেপরোয়া গাড়ি চালানোর অভিযোগে মামলা করতে চেয়েছিলাম।'

'কিন্তু, র‌্যাব সদস্যরা তা চাননি,' যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'র‌্যাব কর্মকর্তা যখন মামলার খসড়া তৈরি করছিলেন, আমি তাকে অনুরোধ করেছিলাম যে আমার বাবাকে মারধর করা হয়েছে এমন অভিযোগ না দিতে। কিন্তু, কোনো লাভ হয়নি।'

খসড়া তৈরি শেষ হলে র‌্যাব কর্মকর্তা বাপ্পীকে তাতে সই করতে বলেন।

বাপ্পী বলেন, 'ওই কিশোররা আমাদের হুমকি দিয়েছে বলেও র‍্যাব কর্মকর্তা মামলায় উল্লেখ করেন। তিনি আমাকে মামলার খসড়ায় সই করতে বাধ্য করেন।'

মামলার সাক্ষী ছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ী নকিব উদ্দিন শিকদার ও পোশাককর্মী মনতাজ আলী। তারা ২ জনেই মামলার বিবরণীতে উল্লেখ করা অভিযোগ শুনে অবাক হয়েছেন।

নকিব ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মামলার বিবরণী সম্পূর্ণ মিথ্যা।'

ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন। কীভাবে মাগরিবের নামাজের আগে মসজিদের কাছে দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল, কীভাবে তারা বারেককে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং যেন ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়, সেজন্য তারা মোটরসাইকেলটি আটকে রেখেছিলেন—সব জানালেন।

তিনি বলেন, 'আমরা তো চাঁদাবাজি এবং হামলার বিষয়ে কিছুই জানি না।'

তিনি আরও জানান, ঘটনার একদিন পর র‌্যাবের দল দুর্ঘটনাস্থলের কাছে তার দোকানে যায় এবং তাকে একটি নথিতে সই করতে বলে।

মনতাজ অবশ্য দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। তবে পরের দিন বারেকের বাসার পাশে একটি মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকানে গেলে র‌্যাব সদস্যরা তাকে একটি কাগজে সই করতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি তাদের বলেছিলাম আমি পড়তে বা লিখতে পারি না। তাই, র‌্যাব সদস্যরা একটি কাগজে আমার নাম লিখে নিয়েছিলেন এবং কাগজে সই করার আগে আমাকে বেশ কয়েকবার প্র্যাকটিস করিয়েছিলেন।'

ক্ষমতার অপব্যবহার

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও মামলার বিষয়ে ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানের কথা জানানো হলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক তা বিশ্বাসই করতে চাননি। তিনি বলেন, 'যদি অনুসন্ধান সত্য হয়, তাহলে এটি ক্ষমতার অপব্যবহারের সুস্পষ্ট উদাহরণ।'

মানবাধিকারকর্মী নুর খান দুর্ঘটনার পর এর সঙ্গে র‍্যাবের সংশ্লিষ্ট হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, 'এ ঘটনায় র‌্যাবের জড়িত থাকার কথা ছিল না। প্রয়োজনে পুলিশ (বাইকারের বিরুদ্ধে) ব্যবস্থা নিতে পারে। মনে হচ্ছে র‌্যাব তার কার্যপরিধির বাইরে গিয়ে এটি করেছে।'

অভিযুক্ত ৫ কলেজ শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান পায়েল, নাহিদুল ইসলাম নীরব, প্রজ্ঞানুর রহমান মুগ্ধ, সাইফুল ইসলাম ও দেওয়ান এম এ মাহিম এখন জামিনে আছেন।

অপর ৩ অভিযুক্তের মধ্যে একজন 'গুমের' শিকার মোহন মিয়ার ছেলে, অন্যজন মোহনের ফুফাতো ভাই ও তৃতীয়জন ওই পাড়ার এক কিশোর।

এই ৩ জনের মধ্যে একজন মামলার দেড় মাস পর র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয় এবং জামিনে মুক্ত হন। বাকি ২ কিশোর গ্রেপ্তার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। আইনগত কারণে ডেইলি স্টার তাদের নাম প্রকাশ করছে না।

আদালত সূত্র জানায়, বাদী বাপ্পী এক জবানবন্দিতে বলেছেন যে আসামিদের খালাস দিলে তার কোনো আপত্তি নেই।

অভিযুক্ত ৩ কিশোরের বিষয়ে জানতে চাইলে পায়েল জানান, তিনি তাদের চিনতেন না এবং অনেক পরে তিনি ওই ৩ জনের বিষয়ে জানতে পেরেছেন।

নিরাপত্তা বাহিনী থেকে অবসর নেওয়া জহিরুল ইসলাম র‌্যাবের সোর্স হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

তিনি জানান, র‌্যাব সদস্যরা যখন ওই এলাকায় অভিযান চালায় তখন তিনি আশেপাশেই ছিলেন।

তিনি বলেন, 'আমার সাবেক সহকর্মী (নিরাপত্তা বাহিনীতে) র‌্যাবে ছিলেন। তিনি আমাকে তাদের ক্যান্টিনে যেতে বলেছিলেন। তখন আমি বাপ্পীকে নিয়ে র‌্যাব অফিসে গিয়েছিলাম।'

অভিযানের নেতৃত্বদানকারী র‌্যাব ৪ এর কোম্পানি কমান্ডার পুলিশ সুপার জয়িতা শিল্পী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা বাদীর করা অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়েছি।'

র‌্যাব সদস্যরা মামলার বিবরণী তৈরি করেছেন উল্লেখ করা হলে তিনি তা অস্বীকার করেন।

মামলায় ৩ কিশোরের নামের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি ৫ আসামির কথা জানি। পরে কী হয়েছে, জানি না।'

Comments

The Daily Star  | English

An economic corridor that quietly fuels growth

At the turn of the millennium, travelling by road between Sylhet and Dhaka felt akin to a trek across rugged terrain. One would have to awkwardly traverse bumps along narrow and winding paths for upwards of 10 hours to make the trip either way.

13h ago