ডিজিটাল সেবা শুধু নামেই
সরকার যে ৭৬১টি সেবা ডিজিটালাইজড করেছে, ধীরগতির সার্ভার ও ইন্টারনেটের দুর্বল গতির জন্য তা থেকে মানুষ পর্যাপ্ত সুবিধা পাচ্ছে না। সরকারি এক জরিপে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
২৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ৬৭টি নির্বাচিত ডিজিটাল সার্ভিসের ওপর সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) চালানো জরিপ অনুযায়ী, এগুলো মধ্যে বেশ কয়েকটি সেবা এখন আর অনলাইনে পাওয়াই যাচ্ছে না।
প্রশাসনিক পর্যায়ের ৫৫ জন সেবা প্রদানকারী এবং প্রান্তিক পর্যায়ের ৩৪০ জন সেবাগ্রহীতা ও সুবিধাভোগীর সাক্ষাত্কার নিয়ে এ জরিপ চালানো হয়েছে।
প্রায় ৯১ শতাংশ সেবাগ্রহীতা জানিয়েছেন, পরিষেবাগুলো এখনো বিদ্যমান। বাকিরা জানান, পরিষেবাগুলো এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যবহারকারী ডিজিটাল সেবা সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
জরিপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ মানুষ সেবা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও ই-ডকেট, ভূমি মিউটেশন, ই-পাসপোর্ট, মেশিন-রিডেবল পাসপোর্ট, ঋণ সেবা, ই-ট্রেড লাইসেন্স ও স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট কাজ অনলাইনে করতে গিয়ে তারা বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
যে ওয়েবসাইটগুলোর মাধ্যমে পরিষেবাগুলো নেওয়া হয়, সেগুলো নিয়মিত আপডেট করা হয় না।
উদাহরণস্বরূপ, গত ৭ জুন সার্ভেয়াররা এসআইডি মিটিং ম্যানেজারের অ্যাক্সেস পায়নি। এসআইডি মিটিং ম্যানেজারের অ্যাক্সেস হলো ২০১৮ সালে চালু হওয়া পরিসংখ্যান ও ইনফরমেটিক্স বিভাগের মিটিং বিজ্ঞপ্তির ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অনেক পরিষেবা এখন আর চালু নেই। কারণ প্রকল্পগুলো শেষ হওয়ার আগে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা হয়নি।
জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সরকারি অফিস কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশনের জন্য আইসিটি বিভাগ ও পরিকল্পনা বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়িত একটি প্রকল্প হচ্ছে ই-গভর্নমেন্ট প্রকল্প।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের যে মেয়াদ ছিল, তা টেকসই নয়। প্রকল্পটি এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মটি চালানোর ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে।
কিন্তু, সিপিটিইউর মালিকানাধীন ও পরিচালিত ন্যাশনাল ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) পোর্টালটি পাবলিক এজেন্সিগুলোর ক্রয় কার্যক্রমকে সহজতর করতে ব্যবহারকারীদের জন্য উপকারী হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে।
সেবাগ্রহীতাদের মতে, পোর্টালটি প্রথমে জটিল বলে মনে হলেও এখন এটি কার্যকর বলে মনে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ২৫ দশমিক ৬ লাখেরও বেশি মানুষ এই পোর্টালটি ভিজিট করেছে।
তবে, দরপত্র জমা দেওয়ার সময় পোর্টালটিতে বেশ ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে। পাশাপাশি পরিষেবাটির নকশা আরও উন্নত, ইউজার ইন্টারফেসটি সহজ করা দরকার এবং পর্যাপ্ত ব্যান্ডউইথের প্রয়োজন রয়েছে।
যদিও ই-পাসপোর্ট অনেকের জন্য সুবিধা নিয়ে এসেছে, তবে কেউ কেউ প্রায়ই সার্ভার ডাউন ও ধীরগতির কারণে ঝামেলার সম্মুখীন হচ্ছে।
ডিজিটালাইজেশনের পরও ব্যবহারকারীরা বলছেন, পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য এখনো তাদেরকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ডিজিটাল সেবা প্রদানে ধীরগতি ও কর্মীদের অযোগ্যতার কারণে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগের অনলাইন এমআরপি সেবা নিয়েও তারা সন্তুষ্ট নন।
ব্যবহারকারীরা বলেন, ই-ডকেট ও ল্যান্ড মিউটেশন ওয়েবসাইটের সার্ভার খুব ধীরগতির এবং অনেক সময় অর্ধ পরিশোধের পরেও তাদের ট্যাক্স ফাইলিং ব্যালেন্স অপরিশোধিত দেখায়।
এ ছাড়া, ভূমি অফিসের মধ্যস্বত্বভোগীরা মানুষকে অনলাইনে সেবা গ্রহণে নিরুৎসাহিত করে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বহুতল ভবনের জন্য অনলাইনে নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট নিতে যে পোর্টালটি ব্যবহার করা হয়, সেটি আপগ্রেড ও সংশোধন করা দরকার। কারণ গ্রাহকরা সঠিকভাবে তথ্য পূরণ করা সত্ত্বেও পরিষেবাটি পাচ্ছে না।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যারা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ডিজিটাল সেবা ই-ট্রেড লাইসেন্স নিতে যান, তাদেরকেও প্রায়ই ডিএসসিসি অফিসের কর্মচারীদের ঘুষ দিতে হয়। অন্যথায়, তারা অনলাইনে অনুরোধ করা পরিষেবাটি সরবরাহ না করতে নানা অজুহাত দেখান।
এ ছাড়াও, ওই পোর্টালে সার্ভারের সমস্যা রয়েছে। ফলে আবেদনের ২ থেকে ৩ দিন পর আবেদনপত্র আসে।
সেবাগ্রহীতারা বলেন, এই সেবার মান উন্নত করতে হবে এবং বিষয়টি নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।
২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত আইসিটি খাতের এক হাজার ৮৯ জন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে উদ্ভাবনী বা গবেষণা কার্যক্রমের জন্য বৃত্তি ও অনুদান দিয়েছে সরকার। কিন্তু, অনুদান প্রাপকদের কোনো মোবাইল নম্বর বা ইমেল নেই বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
যেসব উদ্ভাবনী প্রকল্পের জন্য অনুদান দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো আসলেই সম্পন্ন হয়েছে কি না এবং তাদের উদ্দেশ্য অর্জন হয়েছে কি না, তা যাচাই করা প্রয়োজন।
প্রকল্পগুলোর উদ্দেশ্য পূরণ না হলে বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
অনলাইনে বিস্তারিত তথ্য পূরণ করে হজযাত্রীদের একটি নো-অবজেকশন লেটার ও কনফারমেশন এসএমএস পেতে বেশ সময় লাগে। অনেকে প্রায় শেষ মুহূর্তে এসে তা পেয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম মনিটর করতে ডিএসসিসি বাজারগুলোর প্রবেশদ্বারে একটি ডিজিটাল মূল্য চার্ট চালু করেছে, যা সব বিক্রেতাদের মানতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু বিক্রেতাদের মতে, এ ধরনের কোনো বোর্ড নেই। বিক্রেতারা তাদের ইচ্ছামতো ম্যানুয়ালি দাম লিখে রাখে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
Comments