শিনজো আবে হত্যা: শান্তির দেশ জাপানে বিস্ময়কর ঘটনা

শিনজো আবে। ছবি: এপি

শিনজো আবে একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবাররে জন্মগ্রহণ করেন। তার দাদা কিশি নোবুসুকে (১৯৫৭-৬০) জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার পিতা আবে শিনতারোও ছিলেন জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। শিনজো আবে তার বাবার মৃত্যুর পর ১৯৯৩ সালে সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।

২০০৬ সালে ৫২ বছর বয়সে তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনিই ছিলেন জাপানের সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী। বছরখানেক সে দায়িত্ব পালন করার পর তিনি স্বাস্থ্যগত সমস্যার কথা বলে পদত্যাগ করেন। ২০১২ সালে সুস্থ হয়ে তিনি আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং বিপুল ভোটে দলকে বিজয়ী করে তিনি আবারও জাপানের প্রধানমন্ত্রী হন। তার সময়ে সবগুলো নির্বাচনে দলকে বিপুল ভোটে জিতিয়ে এনে ক্ষমতা ধরে রাখেন। জাপানের ইতিহাসে দীর্ঘ সময় (২০১২-২০২০) ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তি তিনি।

জাপানের অর্থনীতিকে অধিক শক্তিশালী ও গতিসম্পন্ন করতে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন শিনজো আবে। তার নেওয়া ৩টি নীতি হলো—জাপানের মুদ্রানীতিকে সহজ করা; অবকাঠামো-খাতে অধিক বিনিয়োগের মাধ্যমে আর্থিক উদ্দীপনা সৃষ্টি করা; এবং কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে শ্রমশক্তিতে অধিক নারীকর্মীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত, শ্রমের উদারীকরণ ও চাপ কমানো এবং অভিবাসী নীতি গ্রহণ। এই তিন নীতির উদ্দেশ্য ছিল দুই দশক ধরে চলা জাপানের অর্থনৈতিক স্থবিরতা দূর করা। আবের সেই কর্মসূচি এতটাই আলোচিত হয়েছিল যে, সেই নীতিকে তার নামানুসারে জাপানে তাকে 'আবেনোমিক্স' বলা হয়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকাকালে সেই নীতিকে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যান তিনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান বিশ্বে সামরিক ও রাজনৈতিক দিকে থেকে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে তারা শান্তির নীতি গ্রহণ করে। তাদের সংবিধানও সেভাবে তৈরি করা হয়। সেই ধারা থেকে বের হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে আবে দেশকে সামরিক, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন। সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ান। কথিত শান্তিবাদী সংবিধান পরিবর্তনের কথা বলেন। জাপানের ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ রক্ষা পুনরুদ্ধারের কথা বলেন। বারবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নিহত যুদ্ধাপরাধী সৈনিকদের ইয়াসুকুনি মন্দির পরিদর্শনের মাধ্যমে সে বার্তা স্পষ্ট করেন। তার এই জাতীয়তাবাদী অবস্থান ও অর্থনৈতিক সংস্কারের নীতি তাকে অধিক জনপ্রিয়তা দেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের সৈন্যদের বর্বরতার ইতিহাস পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। ডানপন্থি নেতা আবেও এমন ধারণা পোষণ করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঝুনিজিরো কইজুমি নিয়মিত যুদ্ধাপরাধীদের কবরে যেয়ে ফুল দিয়ে আসতেন। শান্তিপূর্ণ জাপানিরা এমন কর্ম পছন্দ ও সমর্থন করেন না। নেতাদের এমন কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য নিয়ে প্রায়ই জাপানের সঙ্গে চীন-কোরিয়ার বিরোধ ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।

২০২০ সালে আবারও স্বাস্থ্যগত সমস্যার কথা বলে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শিনজো আবে। পদত্যাগ করলেও দল ও রাজনীতিকে ঘিরে তার যে নীতি-দৃষ্টিভঙ্গি, সেটা এগিয়ে নিতে কাজ করেন এবং দলের ভেতরে নিজের প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখেন।

৮ জুলাই নারায় উচ্চ-কক্ষের নির্বাচনে তার দলের প্রার্থীর পক্ষে এক নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতাকালে তাকে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যাকারী পালানোর চেষ্টা না করে সেখানেই ঘোরাফেরা করলে আবের নিরাপত্তারক্ষী ও উপস্থিত জনতা তাকে ধরে ফেলেন। ৪১ বছর বয়সী অভিযুক্ত হত্যাকারী তেতসুয়া ইয়ামাগামি জাপানের নৌবাহিনীতে বছর তিনেক (২০০২-০৫) চাকরি করেন। নির্বাচনের দুদিন আগে এত বড় একটি ঘটনা সত্যি বিস্ময়কর। যদিও এ কারণে নির্বাচন স্থগিত করা হয়নি।

আমি জাপানে দীর্ঘদিন ছিলাম। যে কারণে বেশ কয়েকটি নির্বাচনী প্রচারণা কাছ থেকে দেখেছি। সেখানে নেতারা সাধারণ মানুষের মতোই চলাফেরা করেন, তাদেরকে ঘিরে বিশেষ কোনো নিরাপত্তা আমার চোখে পড়েনি। সেখানকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত এবং এ ধরনের অপরাধ নগণ্য হওয়ায় নেতারাও বাড়তি কোনো নিরাপত্তা নিয়ে চলাফেরা করেন না। জিপ, মাইক্রোবাস বা ছোট ট্রাক থেকে দাঁড়িয়েই তারা লোক সমাগমে বক্তব্য রাখেন। আর নির্ধারিত স্থানের জনসভার ক্ষেত্রেও তার খুব ব্যতিক্রম নয়। তবে শিনজো আবের এই ঘটনা হয়তো নেতৃত্ব ও প্রশাসনকে সতর্ক করবে।

প্রশ্ন উঠছে, জাপানের মতো একটি শান্তিপূর্ণ দেশে কীভাবে এ রকম একটি হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হতে পারল? জাপানে বন্দুক হামলার ঘটনা খুবই বিরল। যেখানে বন্দুক আইন খুব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অস্ত্র পাওয়া খুব জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। তবে, ধারণা করা হচ্ছে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র ঘরে তৈরি করা হয়েছে।

হত্যার কারণ হিসেবে ইয়ামাগামি পুলিশকে বলেছেন, তিনি একটি 'নির্দিষ্ট গোষ্ঠী'র বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ থেকে এ কাজ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, শিনজো আবে সেই গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং সে কারণে তিনি তাকে হত্যা করেছেন। এনএইচকে সংবাদ বলছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজনৈতিক কারণে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করেননি। মাইনিচি পত্রিকা বলছে, সন্দেহভাজন ব্যক্তির একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী ও তার নেতাকে হত্যার লক্ষ্য স্থির করেছিলেন। কিন্তু, সেই ধর্মীয় নেতা সমাবেশে যোগ দেননি। এক্ষেত্রে আততায়ীর বক্তব্য কিছুটা বিভ্রান্তিকর।

আবের হত্যাকারী সম্পর্কে জাপান টাইমস বলছে, এই ব্যক্তি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না এবং তার অতীতেও সে রকম কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। অভিযুক্ত হত্যাকারী ইয়ামাগামি নারার যে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন, তার স্নাতক বার্ষিক খাতায় লিখেছেন যে, তিনি ভবিষ্যতে কী হতে চান, তা তিনি ভালো করে জানেন না বা ধারণা করতে পারেন না। তিনি যে কোম্পানিতে চাকরি করতেন, এ বছরের মে মাসে শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে সেখান থেকে ইস্তফা দেন।

নারা জাপানের প্রাচীন রাজধানী। বর্তমানে এটি জাপানের অন্যতম একটি পর্যটন শহর। জাতিসংঘের বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় নারার বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক নজরকারা দৃষ্টিনন্দন মন্দির তালিকাভুক্ত। সেখানকার পরিবেশ খুবই নিরিবিলি, ছায়াঘেরা ও শান্তিপূর্ণ। নারার পথ-ঘাট-দোকানে শত শত হরিণ নিরুপদ্রুপভাবে বিচরণ করে। খাবারের জন্য তারা পর্যটকদের পিছু নেয়, সে দৃশ্য দারুণ। সেখানে এমন রক্তপাত সত্যি বিস্ময়কর।

জাপানে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নতুন নয়। তবে সমসাময়িক ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি। এ ছাড়া জাপানে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের টার্গেট করে হত্যা করার ঘটনাও খুব নেই। ১৯৩৬ সালে এক রাজনৈতিক ক্যুর সময় দুজন মন্ত্রী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে জাপানের সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রধান ইনেজিরো আসানুমাকে বক্তব্য দেওয়ার সময় উগ্র ডানপন্থি সামুরাই গুলি করে হত্যা করে। ২০০৭ সালে নাগাসাকি শহরের মেয়র ইচো ইতোকে গুলি করে হত্যা করে মাফিয়ারা। এসব ঘটনার পেছনে ছিল উগ্র ডানপন্থি জাতীয়তাবাদীরা।

জাপানে এখনো কট্টর ডানপন্থি ও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের অস্তিত্ব আছে। তারা মনে করে, জাপানকে আবারও সেই আগের শৌর্য-বীর্যে ফিরে যেতে হবে। বিশ্ব রাজনীতিতে তাদের প্রভাব পুনরুদ্ধার করতে হবে। তাদের কাছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত ও নিহত সৈনিকরা হচ্ছেন জাতীয় বীর। জাপানের যুদ্ধাপরাধীদের যেখানে সমাহিত করা হয়েছে, সেই ইয়াশুকুনি মন্দিরে তারা নিয়মিত শ্রদ্ধা জানাতে যান। তবে জাপানের কট্টরপন্থি উগ্র জাতীয়তাবাদীদের চরিত্র-তৎপরতার সঙ্গে এই অপকর্মটি সঙ্গতি পাচ্ছে না। কেউ কেউ তার মানসিক ভারসাম্য নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। তবে অধিকতর তদন্তে হয়তো এর সঠিক কারণ-সমীকরণ পরিষ্কার হবে।

জাপানে শিক্ষা ও গবেষণাকালীন এবং একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সেখানকার রাজনীতি ও নেতৃত্বের বলা-বক্তব্য-বিতর্ক সবসময় পর্যবেক্ষণ করেছি। জনপ্রিয় রাজনীতিক হিসেবে জাপানে যে নামগুলো সবচেয়ে বেশি আলোচিত হতো, তাদের মধ্যে শিনজো আবে ছিলেন অন্যতম। তার এমন বিদায়-মৃত্যু দুঃখজনক। আবেকে আমার মনে করার বড় কারণ হচ্ছে, আমি যখন জাপানে লেখাপড়া করতে যাই এবং শেষ করে চলে আসি, তখন তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। জাপান বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী। মেট্রোরেলসহ অনেক প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রী আবে উদারভাবে সহযোগিতা করেছেন। এ কারণে আমার মতো বাংলাদেশও তাকে মনে রাখবে।

ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Battery-run rickshaws allowed back on Dhaka roads for one month

SC chamber judge issues status quo on HC order

3h ago