ঈদ আনন্দ মিলিয়ে যাচ্ছে পথের কষ্টে
সাভারের একটি পোশাক কারখানার কর্মী আইয়ুব আলী (৪৫) স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঈদ করতে পাবনার সাঁথিয়ায় যাওয়ার জন্য বাস না পেয়ে জনপ্রতি ৩০০ টাকা ভাড়ায় একটি ট্রাকে চেপে বসেন। শুক্রবার রাত ৯টায় রওনা দিয়ে দীর্ঘ সময় বাইপাইল ও চন্দ্রায় যানজটে আটকে থাকার পর আজ শনিবার সকাল ৬টায় টাঙ্গাইলের করটিয়া এসে আবার যানজটে আটকে যায় তাদের ট্রাক।
আইয়ুব নিজে একজন ডায়াবেটিসের রোগী। তার স্ত্রীও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। পথে প্রস্রাবের বেগের কথা জানালেও আইয়ুব রাতের অন্ধকারে স্ত্রীকে নিয়ে ট্রাক থেকে নামার সাহস পাননি। পরে করটিয়ায় দীর্ঘসময় আটকে থাকার সময় সন্তানদের ট্রাকে রেখে স্ত্রীকে নিয়ে ঢোকেন রাস্তার পাশের একটি বাড়িতে। কিন্তু অতিরিক্ত মানুষের আনাগোনার কারণে শৌচাগারটি তালা দিয়ে রেখেছিলেন বাড়ির মালিক। এ অবস্থায় তাকে সেটা খুলে দিতে অনুরোধ করতে না করতেই কাপড় নষ্ট করে ফেলেন আইয়ুবের স্ত্রী। পরে পাশের এক ডোবায় পরিষ্কার হয়ে আবার গাড়িতে উঠেন তারা।
এই পোশাক শ্রমিক বলেন, 'আমরা গরীব মানুষ। খিদার কষ্টরে কষ্ট মনে করি না। কিন্ত পেশাব-পায়খানা তো আটকা রাখা যায় না। ঈদে বাড়ি যাইতে চাইছিলাম না। পোলাপানের আব্দারে যাইতেছি। নাইলে আইজ মাইনষের সামনে এত শরমিন্দা হওয়া লাগত না।'
এবারের ঈদযাত্রায় মহাসড়কে যানজটে দুই-আড়াই ঘণ্টার পথ যেতে লাগছে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা। বাস সংকটে ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক ও পিকআপে চেপেও বাড়ির পথ ধরেছেন হাজারো মানুষ। রেল স্টেশনে দীর্ঘ অপেক্ষা আর মহাসড়কে ধুঁকতে ধুঁকতে এগুতে থাকা এসব মানুষের ঈদ আনন্দ ম্লান করে দিচ্ছে তীব্র দুর্ভোগ।
পোশাক শ্রমিক আইয়ুবের মতোই গাজীপুরের একটি কনষ্ট্রাকশন সাইটে কাজ করা নির্মাণশ্রমিক আবদুল লতিফ গত রাতে একটি মিনি ট্রাকে চেপে বসেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় যাওয়ার জন্য। সারারাত যানজটে আটকে থেকে সকালে টাঙ্গাইলের আশেকপুরে ট্রাক দাঁড়ালে স্ত্রী-সন্তানের জন্য খাবার কিনতে তিনি ট্রাক থেকে নামেন। এসময় একটি মোটরসাইকেল তাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম হয় তার।
কাঁদতে কাঁদতে লতিফ বলেন, 'সারা রাইত পেটে দানাপানি নাই। সকাল নামছি বৌ-পোলাপানের নিগা পাউরুটি আর পানি কিনতে। এইসময় হুন্ডা আইয়া মাইরা দিছে। ম্যালা জাগায় চামড়া ছিলা গ্যাছে। ঈদ করবার আইয়া মরণ দশা হইল।'
আসাদুজ্জামান নামের সিরাজগঞ্জগামী এক যাত্রীর কাছ থেকে জানা গেল, শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ঢাকার কল্যানপুর থেকে রওনা দেন তিনি। সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তের সল্লায় যানজটে আটকে আছেন। তিনি বলেন, 'কখন বাড়ি ফিরতে পারব জানি না। এটি আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টদায়ক পথযাত্রার অভিজ্ঞতা।'
কামরুল ইসলাম নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর ভাষ্য, 'সড়কে সড়কে যা চলছে সেটাকে রীতিমতো মানবিক বিপরর্যয় বলা যায়। অথচ এবার নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রার আশ্বাস মিলেছিল সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। কিন্তু যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে ন্যুনতম সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসেনি কোনো কর্তৃপক্ষ।'
ওই শিক্ষার্থী প্রশ্ন রাখেন, 'দেশের নাগরিক হিসাবে তাদের (সরকার) কাছে আমাদের কি কোনো মূল্যই নেই?'
Comments