খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: নৌ কমান্ডো ডা. মোহাম্মদ শাহ আলম বীর উত্তম

ডা. মোহাম্মদ শাহ আলম বীর উত্তম। ছবি: সংগৃহীত

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের ৫৬তম পর্বে রইলো মোহাম্মদ শাহ আলম বীর উত্তম'র বীরত্বগাঁথা।)

মুক্তিযুদ্ধে ডা. মোহাম্মদ শাহ আলম ছিলেন অপারেশন জ্যাকপটের চট্টগ্রাম বন্দরের আক্রমণের অন্যতম নৌ কমান্ডো। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও অবদানের জন্য ডা. মোহাম্মদ শাহ আলমকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। খেতাবে তার সনদ নম্বর ৫৬।

১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন মোহাম্মদ শাহ আলম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

মুক্তিযুদ্ধের ২৩ মে মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানীর নির্দেশে নৌ-কমান্ডো সেক্টর গঠনের পর বিভিন্ন সেক্টর থেকে নৌ কমান্ডো হিসেবে নির্বাচিত করার জন্য তরুণদের বাছাই কার্যক্রম শুরু হয়। বাছাইকৃতদের মাঝে নির্বাচিত হয়েছিলেন শাহ আলম ও। নির্বাচিত তরুণদের টানা আড়াই মাস কঠোর  প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ঐতিহাসিক পলাশীর ভাগীরথী নদীর তীরে। প্রশিক্ষণ শুরুর আগে বলা হয়েছিল 'এটি একটি আত্মঘাতী যুদ্ধ।

আগস্টের প্রথমে ২টি সমুদ্র বন্দর এবং ২টি নদী বন্দর আক্রমণের লক্ষ্যে ৪টি সেক্টরের পরিকল্পনায় সাজানো হয়। প্রথম ব্যাচকে ৬০ জনের ২টি দল এবং ২০ জনের ২টি দল নিয়ে মোট ৪টি স্থানে আক্রমণের জন্য ৪টি দলে ভাগ করা হয়। ঠিক হয় সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৬০ জন কমান্ডো চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের জাহাজ আক্রমণ করবে।  এই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন মোহাম্মদ শাহ আলম।

২ আগস্ট দুপুরে পলাশী ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে রওয়ানা দিয়ে রাত ৯টায় ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছে পরদিন সকালে কলকাতার দমদম বিমানঘাঁটি থেকে ড্যাকোটা বিমানে চেপে ৪ আগস্ট ভোরে আগরতলায় এসে নিউক্যাম্পে উঠেন শাহ আলমসহ কমান্ডোরা। ৬-৮ আগস্ট অপারেশনের নানা পরিকল্পনা ও আবহাওয়া বার্তা জানানো হয় কমান্ডোদের।

৮ আগস্ট  হরিণায় আসার পরে দলটিকে ৩ ভাগ করে প্রতিটি দলে ১জন করে কমান্ডার করা হয়। এই ৩ কমান্ডারের মধ্যে একজন ছিলেন মোহাম্মদ শাহ আলম। অন্য দুই কমান্ডার ছিলেন মোজাহার উল্লাহ ও আবদুর রশিদ।

এরপর সাব্রুম সীমান্ত দিয়ে সারারাত দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ পথ হেঁটে  শ্রীনগর ক্যাম্প হয়ে প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেই বাংলাদেশে প্রবেশ করেন কমান্ডোরা। এরপর কেএমহাট বাজারে এসে গাইড পরিবর্তনের পর নৌকায় চেপে  মুহুরি ও ফেনী নদী দিয়ে ৯ আগস্ট দুপুরে মীরসরাইয়ের ইছাখালী গ্রামে এসে ১০ আগস্ট রাতে রওয়ানা দিয়ে ১২ আগস্ট মধ্যরাতে  সমিতির হাটে এসে পৌঁছান শাহ আলমসহ নৌ কমান্ডোরা। কিন্তু রাস্তায় পাকিস্তানি চেকপোস্ট থাকায় যুদ্ধ সামগ্রী নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছানো ছিল ভীষণ দুঃসাধ্য। ১৩ আগস্ট সকালের মধ্যেই চট্টগ্রামে পৌঁছাতে হবে তাদের। তখন শাহ আলমসহ নৌ কমান্ডোরা বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে তরকারি বিক্রেতার ছদ্মবেশে দরগার হাট থেকে বাসের ছাদে চেপে চট্টগ্রামে চলে যান।

১৩ আগস্ট সন্ধ্যায় দুটি গ্রুপের কমান্ডোরা অলংকারের মতিন টেইলার্সে পৌঁছে সেখান থেকে আগ্রাবাদের  মমতাজ মহলে পৌঁছান।

নৌ কমান্ডোদের থাকার ব্যবস্থা হয় নাসিরাবাদের নিজাম রোড, সিডিএ মার্কেটের পাশে কাকলী বাড়ি, মৌলভীপাড়া, সবুজবাগ, পানওয়ালাপাড়া, কমান্ডো খোরশেদের বাড়ি, চকবাজারে কবির সওদাগরের বাড়ি, পূর্ব নাসিরাবাদের একটি বাড়িসহ বেশ কয়েকটি বাড়িতে। সবুজবাগের হাজির হোটেলটি ছিল কমান্ডোদের সম্মিলনের কেন্দ্র। কমান্ডোরা একে অপরকে চেনার জন্য বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করতেন।

এদিন চট্টগ্রাম বন্দর ট্রাস্টের চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. কামাল হোসেনের কাছ থেকে বন্দরের সচিব মিসবাহউদ্দিন খানের ঠিকানা আর ফোন নাম্বার সংগ্রহ করেন মোহাম্মদ শাহ আলম। এরপর তিনি তার সঙ্গে দেখা করে ডা. কামাল হোসেনের পরিচয় গোপন করে বলেন, 'এরশাদের বাবা আমাকে জরুরী কাজে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। মেসবাহ উদ্দিন খান শাহ আলমকে সেদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় আগ্রাবাদের জ্যাকস কনফেকশনারীর সামনে অপেক্ষা করতে বলেন। একই সঙ্গে তিনি তার গাড়ি নাম্বার ও বলে দেন। যখন তাদের দেখা হয় মেসবাহউদ্দিন খান শাহ আলমকে গাড়িতে উঠিয়ে অফিসার্স কলোনির সরকারী বাসভবনে নিয়ে যান। এরপর শাহ আলম মেসবাহ উদ্দিন খানকে তার আগমনের কারন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলে ২/৩ দিনের জন্য থাকার আশ্রয় চান। সে সময় বাসাতে বহিরাগত ও অতিথি কাউকে রাখতে হলে কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হতো। মেসবাহ উদ্দিন খান তখন পোস্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান আইএস মালিকের কাছ থেকে থাকার অনুমতি নেন।

পরদিন সকাল ৯টায় শাহ আলম মেসবাহউদ্দিন খানের বাড়িতে ১ থেকে ১২ নম্বর জেটি পর্যন্ত রেকি করে ৪ নম্বর গেট দিয়ে বেরিয়ে যান। এসময়ে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে শত্রুর অবস্থান, বয়ার অবস্থান, কয়টি জাহাজ থাকবে, পাকিস্তানি সেনাদের গতিবিধি, কর্ণফুলীর টাইটেল চার্ট সংগ্রহ করেন। এরপর নিউমুরিং গেট দিয়ে ঢুকে নেভাল বেসের সামনে দিয়ে পতেঙ্গা বিচ পর্যন্ত ঘুরে আসেন। দ্বিতীয় দিন শাহ আলম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে রেকি করতে চাইলে পাকিস্তানি বাহিনীর সন্দেহ এড়াতে মেসবাহ উদ্দিন খান তাকে বিরত থাকেন।

নৌ কমান্ডোরা কাকলী অবস্থানকালে ১৩ আগস্ট রাতেই রেডিওতে বেজে উঠে পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে 'আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম' গান। এই সতর্কতা সংকেত কেবল দলনেতা বা সমন্বয়কেরাই জানতেন কেবল। এই গান শোনার পর দলনেতা সবাইকে প্রস্তুত হতে বলেন যেন যেভাবেই হোক ১৪ আগস্ট শহর অতিক্রম করে কর্ণফুলী পাড়ি দেওয়া যায়। তরকারির টুকরি, বাজারের ব্যাগ, মাছের ডালাসহ নানান কিছুতে করে অস্ত্রগুলো আনোয়ারার  লক্ষ্যার চরে পৌছানো হয়। এদিন দুপুরে শাহ আলম গ্রুপ ও মোজাহার উল্লাহ'র গ্রুপ পৌঁছান চর লক্ষ্যা খামারবাড়ি। দ্বিতীয় গানটি বাজানোর কথা থাকলে বাজানো হয়নি। ১৫ আগস্ট সকালে রেডিও আকাশবানীতে  বেজে উঠে দ্বিতীয় গান 'আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি।' 

শেষ মুহূর্তে ৩ জন কমান্ডো অপারেশনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় কমান্ডোর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৭ জনে। প্রতি গ্রুপে তিনজন করে মোট ১২টি গ্রুপ করে কমান্ডোরা ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই এসে পৌঁছান কর্ণফুলী নদীর তীরে।  নির্দিষ্ট তিনজনের গ্রুপ পায়ে ফিনস ও গামছা দিয়ে বুকে মাইন বেঁধে কোমরে ড্যাগার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন নদীর জলে। এসময়ে পাহারায় থাকা শাহ আলম, মোজহার উল্লাহ, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী কমান্ডোদের বিদায় জানান। নদীতে তখন পাকিস্তানি জাহাজের তীব্র আলো। নিস্তব্ধ চারপাশের মধ্যেই তিনজনের প্রতিটি দল সাঁতার কেটে নির্দিষ্ট টার্গেটের দিকে এগিয়ে মাইন লাগিয়ে, রাবার ক্যাপ খুলে, সেফটি পিন লাগিয়ে পুনরায় সাঁতরে নির্দিষ্ট অবস্থানে ফিরে আসেন। কমান্ডোরা নদীতে থাকা অবস্থাতেই ফাটতে শুরু করে একে একে মাইনগুলো। পাকিস্তানি  বাহিনীর জাহাজ ও বাণিজ্যিক জাহাজগুলো  আক্রান্ত হয়েছে বুঝতে পেরেই প্রচণ্ড শব্দে সাইরেন বাজায়।
এসময়েই পাকিস্তানি বাহিনী নদীর দুইপাশে গানবোট থেকেই শুরু করে গুলিবর্ষণ। বাণিজ্যিক জাহাজ থেকেও এসময় এসওএস বার্তা পাঠাতে শুরু করে। রাত দেড়টা দিকে দুটোর মধ্যে মাইনগুলো একের পর এক বিস্ফোরিত হতে থাকে। সেদিন তাদের অপারেশনে প্রায় ১০টি টার্গেট এমভি আল আব্বাস, এমভি হরমুজ, মৎস বন্দরে নোঙ্গরকৃত বার্জ ওরিয়েন্ট, নৌ বাহিনীর দুটি গানবোট। এছাড়া ছোট কয়েকটি বার্জ সম্পূর্ণ ডুবে যায়।

অপারশন জ্যাকপট এতোটাই সাফল্যের মুখ দেখেছিলো যে এই অপারেশনের খবর বিশ্বখ্যাত সব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিলো। সাড়া ফেলেছিলো সারা পৃথিবীতে।

অপারেশন জ্যাকপটের পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতিসংঘের কাছে জাহাজ ডোবানো বন্ধের জন্য হস্তক্ষেপ কামনা করেন। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান জেনারেল এম এ জি ওসমানী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অন্যান্য দেশের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, 'কোন দেশ যেন বাংলাদেশের জলসীমায় তাদের জাহাজ না পাঠায়। নয়তো আমাদের সেনারা তা ধ্বংস করবে।'  এরপরে বিদেশী কোন পণ্যবাহী জাহাজ সেপ্টেম্বর মাস থেকে বন্দরে আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলো।

ডা. মোহাম্মদ  শাহ আলমের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৩ নভেম্বর নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার করমুল্লাপুর গ্রামে। ১৯৬৭ সালে কর্ণফুলী পেপারমিলস হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬৯ সালে রাঙ্গুনিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন তিনি। পরবর্তী ১৯৭৫ সালে এমবিবিএস পাশ করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে সহকারী সার্জন হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেলের রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। ১৯৮৫ সালের ৭ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ডা. মোহাম্মদ শাহ আলম বীর উত্তম।

তথ্যসূত্র

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ১০ম খণ্ড

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস ১০ম খণ্ড

Comments

The Daily Star  | English
tailor injured during July mass uprising fights for dignity

Is respect too much to ask for?

Rasel Alam, 36, a tailor from Mohammadpur, has been fighting two battles since the July mass uprising -- one for his health and another for his dignity.

19h ago