তেরুও নাকামুরা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মসমর্পণকারী শেষ সৈনিক

তেরুও নাকামুরা। ছবি: ইউ.এস. নেভাল ইনস্টিটিউট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৪৫ সালে শেষ হয়। তবে যুদ্ধ শেষ হয়নি ভেবে অনেকেই এর পরেও যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তাদের মধ্যে হিরু ওনোদার নাম হয়তো অনেকেই শুনেছে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মসমর্পণকারী শেষ সৈনিক মনে করা হয় তেরুও নাকামুরা। ওনোদাকে পাওয়ার ১০ মাস পর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়।

তেরুও নাকামুরা ৩০ বছর পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। যুদ্ধ শেষ হয়নি ভেবে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার মোরোতাই দ্বীপে অবস্থান করেন তিনি।

১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ৬ বছর ধরে চলার পর জার্মানি, জাপান এবং ইতালির সমন্বয়ে গঠিত অক্ষশক্তি অবশেষে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু, জাপানিদের দেশপ্রেম ও পরিচয়ের অত্যন্ত উচ্চ এবং কর্তৃত্বপূর্ণ চেতনা তাদেরকে দীর্ঘদিনর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। অনেক জাপানি সেনা যুদ্ধ শেষেও আত্মসমর্পণ করেনি।

১৯৭০ সাল নাগাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় তিন দশক হয়ে গেছে। কিন্তু ১৯৭৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর খবর ছড়িয়ে পড়ে যে একজন ব্যক্তি এখনও তার অবস্থানে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।

নাকামুরা তাইওয়ানের ফর্মোসা দ্বীপের আমিস উপজাতি গোষ্ঠীর। যা তখন জাপানি সাম্রাজ্যের একটি উপনিবেশ ছিল। তার আসল নাম আতুন পালালিন। নাকামুরা দ্বীপের পাহাড়ে দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে উঠেন। তার জন্ম ১৯১৯ সালে। ১৯৪৩ সালের নভেম্বরে ইম্পেরিয়াল জাপানি সেনাবাহিনীর তাকাসাগো স্বেচ্ছাসেবী ইউনিটে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন।

জাপান-অধিকৃত ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপ মোরোতাই মিত্রবাহিনী জয় করার কিছুদিন আগে তাকে সেখানে পাঠানো হয়। ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বরে মোরোতাইয়ের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বেশ কিছুদিন পর তার সন্ধান না পেয়ে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তিনি আসলে দ্বীপের জঙ্গলে অন্য কিছু জাপানি সৈন্যের সঙ্গে লুকিয়ে ছিলেন। যেখানে তারা তাদের কমান্ডারের নির্দেশ অনুযায়ী গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করতে প্রস্তুত ছিলেন।

নাকামুরার ইউনিটকে এমন পরিস্থিতিতে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি পরে একজন সাংবাদিককে বলেছিলেন, আমার কমান্ডিং অফিসার আমাকে লড়াই চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। তাই আমি সেটাই করেছি।

পরবর্তীতে জাপানি সেনাবাহিনীর অবশিষ্ট সদস্যদের অনেককেই বন্দী করা হয়। অনেকে আত্মসমর্পণ করে বা রোগ ও অনাহারে মারা যান। কিন্তু তেরুও নাকামুরা ও কয়েকজন সৈন্য তখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো উপায় না থাকা সত্ত্বেও তারা আদেশ অনুসরণ করতে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

তেরুও নাকামুরা মোরোতাই দ্বীপে আরও কয়েকজন জাপানি সৈন্যের সঙ্গে ১২ বছর বসবাস করেন। কমান্ডারদের সঙ্গে রেডিও যোগাযোগ হারিয়ে ফেলায় যুদ্ধ শেষ হয়েছে কি না সে সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা ছিল না। জাপান আত্মসমর্পণ করেছে এবং যুদ্ধ শেষ হয়েছে বলে ঘোষণা করে ১৯৪৫ সালে দ্বীপে লিফলেট দেওয়া হয়েছিল। তবে নাকামুরা এবং তার সহযোদ্ধারা সেগুলোকে শত্রুর প্রোপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

১৯৫৬ সালে নাকামুরা অন্যদের ছেড়ে নিজের আলাদা ক্যাম্প তৈরি করেছিলেন। অন্য সৈন্যদের ছেড়ে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে, নাকামুরা দাবি করেন যে তারা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। তিনি দ্বীপের কলা এবং মাছ খেয়ে বেঁচে ছিলেন। নাকামুরা চাঁদের চক্র পর্যবেক্ষণ করে দিন গণনা করতেন এবং একটি দড়িতে গিঁট বেঁধে মাস ও বছরের হিসাবও রেখেছিলেন।

এক পর্যায়ে তেরুও নাকামুরা বাইকোলি নামে এক স্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। মৃত্যুর আগে বাইকোলি তার ছেলেকে নাকামুরার যত্ন নিতে বলে যান।

কিছু প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বাইকোলির ছেলে তার খারাপ স্বাস্থ্যের উদ্বেগের কারণে তেরুও নাকামুরার অবস্থান কর্তৃপক্ষকে জানায়। আবার অনেকে বলেন যে, একজন পাইলট দ্বীপের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় নাকামুরার কুঁড়েঘর দেখতে পেয়ে কর্তৃপক্ষকে জানায়। তবে তথ্যটি যেভাবেই আসুক না কেন ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার সরকারকে জানানো হয় যে মোরোতাই দ্বীপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জাপানি সেনাবাহিনীর একজন সৈন্য থাকতে পারে। পরবর্তীতে তারা একটি অনুসন্ধান মিশন সংগঠিত করার জন্য জাপানি দূতাবাসের সঙ্গে কাজ করে।

নাকামুরাকে লুকানো অবস্থা থেকে বের করে আনতে অনুসন্ধানকারীরা জাপানি পতাকা উত্তোলন করে এবং জাতীয় সঙ্গীত গাইতে থাকে যা ভালো কাজ করে। ১৯৭৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর ৫৫ বছর বয়সী নাকামুরা অবশেষে বের হয়ে আসেন। ৩০ বছর জঙ্গলে লুকিয়ে থাকার পরেও তার স্বাস্থ্য বেশ ভালো ছিল।

নাকামুরার পেনশনের বিষয়টি বেশ জটিল মোড় নেয়। ১৯৪৩ সালে যখন তিনি সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্ত হন তখন তাইওয়ান জাপানি সাম্রাজ্যের একটি উপনিবেশ ছিল। মোরোতাই-এ তার ৩০ বছর থাকাকালীন তাইওয়ান চীনের অধীনে চলে যায়। নাকামুরা জাপানের ইম্পেরিয়াল সেনাবাহিনীর হয়ে লড়েন। তবে জাপানি সরকার মনে করেনি যে তিনি পেনশনের জন্য যোগ্য। কারণ তিনি আসলে জাপানি নাগরিক নন। নাকামুরার প্রত্যাবাসন এবং তার প্রতি জাপানি জনসাধারণের ধারণা পূর্ববর্তী ফিরে আসা সৈন্যদের থেকে ভিন্ন ছিল। যেমন লেফটেন্যান্ট হিরু ওনোদা। যাকে মাত্র কয়েক মাস আগেই ফিলিপাইনের লুবাং দ্বীপে আবিষ্কার করা হয়। তেরুও নাকামুরা ও ওনোদা সঙ্গে ভিন্ন আচরণ করার কারণ ওনোদা ছিলেন স্থানীয় জাপানি, উচ্চ বংশের এবং একজন অফিসারের পদমর্যাদাসম্পন্ন। অন্যদিকে নাকামুরা একজন সাধারণ সৈনিক যিনি শুধু জাপানি উপনিবেশ থেকে এসেছেন এবং জাপানি নাগরিক নন। নাগরিকত্বের বিষয়টি তখন জাপানি জনসাধারণের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছিল।

তাই নাকামুরাকে জাপানে নয়, তাইওয়ানে ফেরত পাঠানো হয়। নাকামুরা নিজেও জাপানে না গিয়ে সরাসরি তাইওয়ানে প্রত্যাবাসন করতে চেয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত নাকামুরাকে তাইওয়ানেই ফেরত পাঠানো হয়।

অন্যদিকে, হিরু ওনোদাকে সম্পূর্ণ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। সরকার যুক্তি দিয়েছিল যে ওনোদা একজন পূর্ণ জাপানি নাগরিক এবং তিনি একজন অফিসারের পদমর্যাদার ছিলেন। নাকামুরা শুধুমাত্র একজন সৈনিক ছিলেন। তারা প্রাথমিকভাবে তাকে ৬৮ হাজার জাপানি ইয়েন দিয়েছিল। যা সেই সময়ে প্রায় ২২৭ ডলারের সমতুল্য। পরবর্তীতে মিডিয়াতে আলোচনা এবং প্রতিবাদের পর তাইওয়ান সরকার নাকামুরাকে মোট ৪২ লাখ ৫০ হাজার জাপানি ইয়েন প্রদান করে। যা হিরু ওনোদার পাওয়া ইয়েনের কাছাকাছি।

নাকামুরা যখন বাড়ি ফিরল, তখন অনেক কিছুই বদলে গেছে। তার বাবা-মা মারা গেছে। তিনি যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার ছেলে শিশু ছিল। তার ছেলে তখন একজন প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৪ সন্তানের বাবা। নাকামুরার মারা গেছেন মনে করে তার স্ত্রী আবার বিয়ে করেন।

তাইপেই টাইমস অনুসারে, তার স্ত্রীর নতুন স্বামী আলাদা হয়ে পুরনো দম্পতিকে মিলিত করাতে ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু নাকামুরা তাদের জীবনে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাননি। তাই তিনি কাছাকাছি একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেন এবং প্রায়শই তাদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। ৪ বছর নাকামুরা তার পরিবারের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করেন। ১৯৭৯ সালের ১৫ জুন ফুসফুসের ক্যান্সারে নাকামুরা তার চূড়ান্ত যুদ্ধে হেরে যান। জীবনের প্রায় অর্ধেক একাকীত্বে অতিবাহিত করলেও, তেরুও নাকামুরা একজন সাহসী মানুষ এবং একজন নিবেদিতপ্রাণ সৈনিকের উদাহরণ রেখে গেছেন। তেরুও নাকামুরার গল্প স্মরণ করার জন্য মোরোতাইয়ের স্থানীয় সরকার উত্তর মালুকু প্রদেশের ডেহেগলিয়া গ্রামে তেরুও নাকামুরার স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেছে।

Comments

The Daily Star  | English
government reduces heart stent prices in Bangladesh

Govt slashes heart stent prices by up to Tk 88,000

Health ministry revises rates for US-made coronary stents to ease patient costs

1h ago