‘আমার ছেলেকে মাইরা ফালাইছে, আপনারা কী করলেন?’

শিক্ষার্থীর স্টাম্পের আঘাতে নিহত শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের মা গীতা বালা সরকার। ইনসেটে উৎপল কুমার সরকার। ছবি: সংগৃহীত

'আমার ছেলেকে মাইরা ফালাইছে, আপনারা কী করলেন? দশ পনের দিন আগেও দেখপার আইছিল আমার ছেলে। ফল নিয়া আইছিল। আমারে খুব ভালোবাসতো। আমার ছেলে ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমি পাগল হইয়্যা যামু। আপনারা আমার জন্য কিছু করেন। আপনারা আমারে বিচার আইনা দেন,' আশি বছরের এক মা তার সন্তান হারানোর কষ্ট আর হত্যার বিচার চেয়ে এভাবেই কেঁদে যাচ্ছিলেন।

এক সময় ফোনের অপর প্রান্তে মা গীতা বালা সরকারের কান্না ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না।

যে স্কুলে শিক্ষকতা করেছে তার ছেলে, সন্তানসম শিক্ষার্থীদের জীবনের নৈতিকতা শিক্ষা দিয়েছে সেই স্কুলের ছাত্রের হাতেই ছেলের মৃত্যুর ঘটনা মানতে পারছেন না উৎপল কুমার সরকারের মা।

সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার লাহিরী মহনপুর দত্তপাড়া এলাকার নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে গ্রামের একটি স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাশ করার পর উল্লাপাড়া সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন উৎপল কুমার সরকার। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতোকত্তর শেষ করেন। ২০১১ সালে আশুলিয়ার চিত্তশাই এলাকার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। নীতি নৈতিকতার জন্য প্রতিষ্ঠানটির শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি করা হয় তাকে।

উৎপলের বড় ভাই মামলার বাদী অসীম কুমার সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাঁচ ভাই আর তিন বোনের মধ্যে উৎপল সবার ছোট। আমার বাবা অনেক আগে মারা গেছেন। ছোট ভাই উৎপলকে আমরা খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়েছিলাম। আমরা পাঁচ ভাই এখনও একসঙ্গে থাকি। ওইই (উৎপল) আমাদের পরিবার দেখাশোনা করত। তিন বছর আগে ভাইকে বিয়ে করিয়েছি। এখন আমাদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।'

'মাকে আমরা এখন কেমন করে বাঁচাবো? বাড়িতে এলেই মাকে নিজ হাতে খাওয়াতো। সবার ছোট ছিল আমাদের, সবার আগে চলে গেল। মা এই শোক সইতে পারছে না,' বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন অসীম।

'অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর পরিবার হুমকি দেয়'

স্থানীয়রা জানান, শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বাবা উজ্জ্বল হোসেন, হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হাজী হজরত আলীর ভাগিনা। উজ্জল এলাকার প্রভাবশালী লোক। গাড়ির ব্যবসা করেন তিনি।  

শিক্ষক উৎপলকে স্টাম্প দিয়ে পেটানোর কথা শুনেই ঘটনাস্থলে যান উৎপলের আরেক ভাই অশীষ কুমার ও তার ভাগনি। তাদের সামনেই অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বাবা উজ্জল ও তার স্ত্রী এবং তাদের কয়েকজন আত্মীয় প্রকাশ্যে ভয়ভীতি দেখান বলে অভিযোগ করেন অশীষ।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি স্কুলের একটু দূরেই দর্জির কাজ করি। আমার ভাইকে মারধর করার খবর পেয়ে স্কুলে যাই। ওইখানে ভাইকে পাই না। পরে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বাবা-মা ও তার কয়েকজন আত্মীয় আমাদের সঙ্গে খুব বাজে ব্যবহার করে। তারা বলে মারছে তাতে তাদের কিছুই হবে না, যা পারবে করবে। এসময় উজ্জল হোসেন আমার ভাগনিকে মারতে তেড়ে আসেন এবং বেশি কথা বললে খবর আছে বলে হুমকি দেন।'

অশীষ কুমার বলেন, আমরা কী করবো এখন? আমরা বিচার পাব কিনা এটা নিয়ে সন্দেহ। পুলিশ এখনো আসামি আটক করেনি। ওর বাবা-মা আমাদের হুমকি দিল তাদের বিরুদ্ধেও পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি। আমরা নিরুপায়।'

বিচার নিয়ে সন্দিহান স্কুলের প্রিন্সিপালও

স্কুল শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার হত্যার বিচার নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাইফুল ইসলামও।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অভিযুক্ত ছাত্রের বাবা উজ্জল হোসেন অঢেল সম্পত্তির মালিক। কয়েক দিন আগে ছেলেকে ৫৬ লাখ টাকা দিয়ে গাড়ি কিনে দিয়েছে বলে জানতে পারি। মূলত বাবার প্রশ্রয়েই ছেলে বখাটে হয়েছে। তাদের তো অঢেল টাকা। আমরা বিচার পাব কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।'

তবে আমরা এই হত্যার বিচার চাই। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা না হলে বড় ধরনের আন্দলনে যাবো আমরা, বলেন অধ্যক্ষ।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, শিক্ষক উৎপল কুমারকে স্টাম্প দিয়ে আঘাত করার পর পেছনের মাঠে স্টাম্প হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল অভিযুক্ত শিক্ষার্থী। এসময় কয়েকজন তাকে আটক করলেও অভিযুক্তের বাবা উজ্জল সেখানে এসে ছেলেকে ছাড়িয়ে নেয়।

অভিযোগ নিয়ে জানতে উজ্জল হোসেনের বাড়িতে গেলে কাউকেই সেখানে পাওয়া যায়নি। মোবাইলে কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

আশুলিয়া থানার ওসি কামরুজ্জামানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি আসামি আটক করা হলে জানানো হবে বলে ফোন কেটে দেন। পরে কল করলেও আর ধরেননি।

গতরাতে সিরাজগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের সৎকার হয়েছে বলে জানিয়েছে পরিবার।  

Comments

The Daily Star  | English

Power, Energy Sector: Arrears, subsidies weighing down govt

The interim government is struggling to pay the power bill arrears that were caused largely by “unfair” contracts signed between the previous administration and power producers, and rising international fuel prices.

9h ago