কেন আমি অনন্ত জলিলের ভক্ত
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে আমি অনন্ত জলিলের ভক্তে পরিণত হচ্ছি। তবে আমি তার সর্বশেষ সিনেমা, বাংলাদেশ-ইরানের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত 'দিন: দ্য ডে'র ট্রেলার দেখে তার ভক্ত হইনি, যে ট্রেলারে সিনেমার নায়ক 'এজে' নিজের মেকআপ অবিকৃত রেখে অসামান্য ও অতিমানবীয় সব স্টান্ট দেখিয়েছেন।
ট্রেলারে তিনি একশর বেশি খারাপ মানুষকে গুলি করেছেন এবং এর মাঝেও তিনি বেশ কয়েকবার তার বিশেষ রঙে রাঙানো পরচুলা (হঠাৎ দেখলে যেটাকে সিংহের কেশর মনে হয়) ঝাঁকাতে ভুল করেননি। এমনকি যখন তিনি তার অনন্য বাচনভঙ্গি ও আমাদের সবার পছন্দের উচ্চারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় (আমি নিশ্চিত, রোহিঙ্গাদের কথা উল্লেখ করার পেছনে সিনেমার জটিল প্লটের অবদান আছে; যেখানে আফগানি সন্ত্রাসী, মাদকচক্র ও বন্দুক-পিস্তলের এমন মহোৎসব রয়েছে, যা আমেরিকার ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনকেও লজ্জায় ফেলতে পারে) দেওয়াসহ বাংলাদেশের অন্যান্য অর্জনের কথা বলতে থাকেন, সেটাও আমাকে ভক্ত বানানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না।
না, আমি 'নায়ক' নয়, 'মানুষ' অনন্ত জলিলের ভক্ত হয়েছি।
যখন চারদিক থেকে বন্যার ভয়াবহতা ও মানুষের দুর্দশার খবর আসতে লাগলো, তখন এই বহুল জনপ্রিয় ও একইসঙ্গে নিন্দিত তারকার একটি ফেসবুক পোস্ট আমরা দেখতে পাই, যা আমাদেরকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করে। 'ম্যানসিস্টার' ও 'ওরেনজ জিউস' খ্যাত তারকা অনন্ত জলিল কোনো ধরনের অপ্রয়োজনীয় ভণিতা না করে ঘোষণা দিলেন, তিনি বন্যাদুর্গতদের পাশে থাকবেন এবং যতটুকু সম্ভব সাহায্য করবেন। তিনি তার ব্যবসা ও সিনেমা থেকে অর্জিত মুনাফা থেকে ত্রাণের জন্য অর্থ দান করবেন। নিশ্চিতভাবেই, তিনি ১০-১২টির বদলে এবার ২টি গরু কোরবানি দেবেন এবং বাকি টাকা দান করবেন, এ কথা না বললেও পারতেন। তবে আমরা অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছি যে তিনি ভালো উদ্দেশ্যেই এ কথা বলেছিলেন। সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন মতে, তিনি বন্যাদুর্গতদের জন্য ৩০ লাখ টাকা দান করবেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তিনি অন্যান্য অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদেরও একই কাজ করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
কিছু এনজিও, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের মতো বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যক্তি পর্যায়েও অনেকেই সহায়তার উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দুর্গম এলাকার মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া। সেসব এলাকার নৌপথ খুবই উত্তাল এবং আবহাওয়া এতটাই বিরূপ যে, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও পৌঁছাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
অনির্বাণ বোটের মতো ট্যুর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের হলিডে ক্রুজ নৌকাগুলোকে উদ্ধারকাজে ব্যবহারযোগ্য নৌকায় রূপান্তর করেছেন। তারা দুর্গম জায়গায় আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ই-ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের কয়েকটি পর্যটন সংস্থা দুর্গম এলাকায় রাখা তাদের নৌকাগুলো ব্যবহার করে আটকে পড়া মানুষদের কাছে যেয়ে তাদেরকে দ্রুত উদ্ধার করে খাদ্য ও আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছে। তারা এই ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য সংস্থার সদস্য ও অন্যান্য উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে। আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন তার ফেসবুক পেজে জানান, মাত্র ২ দিনে তিনি ৯৭ লাখ টাকার তহবিল জোগাড় করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশিরা আটকে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য তহবিল জোগাড় করছেন।
এগুলো স্বতঃস্ফূর্ত সহানুভূতি ও দ্রুত উদ্যোগের হৃদয়গ্রাহী উদাহরণ। কিন্তু এই বিপর্যয়ের ব্যাপক ও দীর্ঘায়িত প্রকৃতির বিবেচনায় এ উদ্যোগগুলো যথেষ্ট নয়। সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাক্ষণবাড়িয়া ও ময়মনসিংহের প্রায় ৭৩ লাখ ৩৪ হাজার মানুষ ইতোমধ্যে বন্যাকবলিত অবস্থায় আছেন। এটি একটি চলমান দুর্যোগ। এর আর্থিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রভাব বেশ কয়েক মাস ধরে চলতে থাকবে। এখন প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি একটি জীবন-মরণ সমস্যা। সুতরাং, কেনো আমরা সমাজের ধনাঢ্য শ্রেণির কাছ থেকে আরও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া দেখছি না?
এখান থেকেই আসে ইংরেজিতে যাকে বলা হয় 'বাবল কালচার', সেই বুদবুদ সংস্কৃতির প্রসঙ্গ। বুদবুদের ভেতরে থাকা মানুষগুলো এর বাইরের মানুষদের কষ্ট অনুধাবন করতে পারেন না, যতক্ষণ না তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় হচ্ছে। তাদের কাছে এই দুর্গত মানুষগুলো 'অদৃশ্য জনগোষ্ঠী'। তারা তাদের প্রিয় ধারাবাহিক নাটকের অত্যাচারিত নায়িকা ও বেধড়ক মার খাওয়া নায়কের কষ্টে কেঁদে বুক ভাসাবেন, কিন্তু বাস্তব জীবনের নায়ক-নায়িকাদের জীবন সংগ্রামের প্রতি নিঃস্পৃহ থাকবেন। তারা নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে দেখবেন এসব মানুষদের সব সহায়-সম্পদ, বাড়িঘর, শস্য, খাদ্য, ব্যবহারের জিনিসপত্র, গৃহপালিত পশু ও কখনো কখনো, সবচেয়ে ভীতিকর বিষয় হিসেবে, তাদের প্রিয়জনদেরকেও হারিয়ে ফেলতে।
তারা জানবেন না সেই মা ও তার ৫ সন্তানের কথা, যারা ২ দিন ধরে না খেয়ে আছে। অথবা সেই কৃষকের কথা, যার উৎপাদিত সব ধান পানিতে ভেসে গেছে, যে ধান বিক্রি করা টাকা দিয়েই আগামী দিনগুলোতে সে তার পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল। অথবা আরও হাজারো পরিবারের কথা, যাদের সামনে অপেক্ষা করছে দারিদ্র্যের কষাঘাত ও মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ধার নিয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকার অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যৎ। এ মানুষগুলোর জন্য ঠিক কী ধরনের ঈদ অপেক্ষা করছে, তা নিয়ে ভাবার সময় বেশিরভাগ ধনী ব্যক্তিরই নেই।
ধনীদের মধ্যে একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা রয়েছে। অর্থ-বিত্তের দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী চরম দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে গেলেও এই শ্রেণির মানুষ তাদের প্রতি এক ধরনের উদাসীনতা দেখান। তারা একই সমাজের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও এমনটি হচ্ছে। খুব সম্ভবত সুনামগঞ্জ ও সিলেটের বন্যা তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিউজফিডে খুব একটা স্থান পায় না।
বরং অ্যামবার হার্ড ও জনি ডেপের সর্বশেষ উপাখ্যান সেখানে বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। হয়তো আমাদেরকে সেই আগের দিনের ছবি তোলার সুযোগগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, যখন সবাই প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে একটি চেক জমা দিয়ে বিটিভির সংবাদে জায়গা করে নিতে পারতেন, এবং কিছুক্ষণের জন্য হলেও বিখ্যাত ব্যক্তি হওয়ার স্বাদ পেতেন। বিষয়টি খুবই বিচিত্র, যে মানুষ তার আত্মিক তুষ্টি অথবা বেহেশতে স্থান নিশ্চিত করার জন্য বিশাল পরিমাণ টাকা খরচ করতে রাজি, কিন্তু কাউকে নিঃশর্তভাবে সাহায্য করতে নারাজ। কেনো বাংলাদেশে কোটিপতিদের ভিড় বাড়া সত্ত্বেও দানশীলতা এত দুর্লভ?
এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা প্রাকৃতিক এই দুর্যোগে মানুষের পাশে না দাঁড়ালেও অলঙ্কার, ঘড়ি, গাড়ি ও ইউরোপে ছুটি কাটানোর জন্য অস্বাভাবিক পরিমাণ অর্থ খরচ করতে দ্বিধাবোধ করেন না। ধনী মানুষদের তাদের টাকা দিয়ে কী করা উচিৎ, তা অনন্ত জলিল আমাদের জানিয়েছেন। তাদের উচিৎ সেই অর্থ অভাবী, অসহায় ও দুর্দশাগ্রস্তদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। সমাজের উঁচুতলার বাসিন্দাদের উচিৎ তার এই আর্জিতে কান দেওয়া এবং যেসব ভাই ও বোনদের জীবন এই দুর্যোগে ছারখার হয়ে গেছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো। যদি তাদেরকে সরাসরি সাহায্য করতে নাও পারি, আমরা সব সময়ই ত্রাণ ও উদ্ধারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনকে আমাদের অর্থ দিতে পারি। মাঝে মাঝে আমাদেরকে কিছু ধ্রুব সত্য মনে করিয়ে দিতে হয়, যা অনন্ত জলিল তার ফেসবুক ভিডিওতে দার্শনিকের মতো করে বলেছেন, 'আপনি আপনার টাকা-পয়সা কবরে নিয়ে যেতে পারবেন না।'
আশা মেহরীন আমিন দ্য ডেইলি স্টারের যুগ্ম সম্পাদক
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments