মাদক ও চুরি ঠেকাতে পুলিশি সিদ্ধান্তে মুন্সিগঞ্জ লঞ্চঘাটে রাতে দোকানপাট বন্ধ

মধ্যরাতে লঞ্চঘাট থেকে পায়ে হেটে গন্তব্যে যাচ্ছেন দুইজন লঞ্চ যাত্রী।
মধ্যরাতে লঞ্চঘাট থেকে পায়ে হেটে গন্তব্যে যাচ্ছেন দুইজন লঞ্চ যাত্রী। ছবি: সংগৃহীত

মুন্সিগঞ্জ সদর থানা থেকে লঞ্চঘাট এলাকার দূরত্ব প্রায় ১ কিলোমিটার। থানা থেকে মূল সড়ক ধরে এগোলেই লঞ্চঘাট এলাকা। মাঝে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। থানার গেট থেকে লঞ্চঘাট এলাকায় ব্যাটারিচালিত মিশুকে চড়ে যেতে ৩ মিনিট আর পায়ে হেটে গেলে ১০ মিনিট সময় লাগে।

লঞ্চঘাট এলাকার সীমানা ঘেঁষেই রয়েছে জেলা পুলিশ লাইন্স। লঞ্চঘাট এলাকায় আছে ৫-৬টি খাবারের দোকান, ১৮-২০টির মতো চায়ের দোকান ও ২-৩টি সেলুন। এসব দোকানে ঢাকা, চাঁদপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলার যাত্রীরা রাতের বিভিন্ন সময় এসে আশ্রয় নিয়ে থাকেন। কিন্তু গত ১০ দিন যাবত পুলিশ রাত ১২টায় এসব দোকান বন্ধ করে দিচ্ছে। পাশাপাশি ঘাট এলাকার একমাত্র পরিবহন মিশুক, অটোরিকশাও চলতে দিচ্ছে না। এতে করে দুর্ভোগে পড়েছেন রাতে ঘাটে আসা যাত্রীরা। পাশাপাশি  ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

পুলিশের দাবি, এ এলাকায় মাদকসেবীর আড্ডা ও চোরের কারণে দোকানপাট বন্ধ করা হচ্ছে।

এ উদ্যোগ নেওয়ার আগে কোনো পূর্ব ঘোষণা দেওয়া হয়নি বা তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনাও করা হয়নি বলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন। তারা জানান, রাত ১২টায় সব দোকান বন্ধ করে দিতে হচ্ছে এবং ভোর ৫টায় আবারও দোকানপাট খোলা হচ্ছে। পুলিশের এ উদ্যোগের বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনও কিছু জানে না।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, জেলা শান্তিশৃঙ্খলা কমিটির অধীনে পুলিশ সুপারসহ বেশ কয়েকজন সদস্য থাকেন। সেখানে বৈঠকে যদি সিদ্ধান্ত হয় মাদকসেবী বাড়ছে, তাহলে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে গভীর রাতে দোকানপাট বন্ধ করা প্রয়োজন। যদি এমন সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তবে পুলিশ এ ধরনের উদ্যোগ নিতে পারবে। শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আইন মেনে তারা তা করতে পারে। তবে এটি কতদিন পর্যন্ত করবে সেটি (সুনির্দিষ্টভাবে) বলতে হবে।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হোসাইন মোঃ আল জুনায়েদ জানান, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তার মতে, এ বিষয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। 

মহিউদ্দিন হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টের সত্ত্বাধিকারী শিহাব আহমেদ জানান, প্রায় ৪৩ বছর যাবত রাতদিন খাবারের দোকানটি খোলা থাকে। গত ১০-১২ দিন যাবত পুলিশ প্রতিদিন রাত ১২ টায় এসে দোকান বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি আশেপাশের সব দোকানপাটও বন্ধ করে দেয়।

তিনি জানান, কোনো সরকারি নির্দেশনার ভিত্তিতে রাত ৮টার পর দোকান বন্ধের এই উদ্যোগ নেয়নি পুলিশ।  মুন্সিগঞ্জ শহরে চুরির ঘটনা অনেক বেড়েছে, সঙ্গে বেড়েছে মাদকসেবীর সংখ্যা। পুলিশ সড়কে যাদেরকে ধরে, তারা সবাই লঞ্চঘাটের হোটেলে খেয়ে আসা বা ঘাটে যাওয়ার দাবি করে এবং অজুহাত দেখায়। ফলে পুলিশ লঞ্চঘাটের হোটেল বন্ধ রাখার উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে আর কেউ এ ধরনের অজুহাত দেখাতে না পারেন। আমরাও পুলিশের কথা মেনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখি।

ঘাটের সরকার রেস্তোরাঁর সত্ত্বাধিকারী রাসেল সরকার জানান, পুলিশ কিছুদিন যাবত নতুন আইন করেছে লঞ্চঘাটে রাত ১২টার পর খাবারের দোকান খোলা রাখা যাবে না। পুলিশকে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা কোনো সদুত্তর দেয় না। 'ঝামেলা আছে', শুধু এ কথা বলে দোকান বন্ধ করে দেয় । আগে সারারাত দোকান খোলা রাখা হত। বর্তমানে রাতে যেসব লঞ্চযাত্রী ঘাটে আসেন, তারাও ভোগান্তিতে পড়েন। কারণ পুলিশ ঘাটের মিশুক ও অটোরিকশা চলাচলও বন্ধ করে দেয়। ফলে যাত্রীরা ঘাটে অনেকটা নিরাপত্তাহীন অবস্থায় থাকেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘাটের সেলুনের একজন কর্মী জানান, পুলিশ শহরের যেকোনো জায়গায় সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তিকে আটক করলে তারা ঘাটে নাস্তা খেতে যাওয়ার কথা বলে। ফলে কে অপরাধী, এটা পুলিশ বুঝতে পারেনা। এজন্য তারা ঘাট বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদেরকে পুলিশ এটাই বলেছে। আগে দোকান সারা রাত খোলা থাকতো।

মুন্সিগঞ্জ রেস্তোরাঁর সত্ত্বাধিকারী ম. আলাল হোসেন জানান, প্রতিদিন ঠিক রাত ১২ টায় পুলিশ এসে সব দোকানপাট বন্ধ করে দিতে বলছে । ১ মিনিট দেরি হলেও গালিগালাজ শুরু করে। তারা সব আলো বন্ধ করে দেয়। ফলে রাত ১২ টার পর যেসব লঞ্চ যাত্রী ঘাটে আসে, তাদের অসুবিধা হয়। কিন্তু পুলিশ এ বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছে না। ঘাট পুরো অন্ধকার হয়ে যায়, তারা কোথাও দাঁড়িয়ে অপেক্ষাও করতে পারেন না। উলটো লুটপাট বা ছিনতাই হওয়ার আশঙ্কা থাকে। গভীর রাতে একজন যাত্রী এসে দোকানে আশ্রয় নিতে পারতেন, কিন্তু এখন আর পারছেন না। দোকান বন্ধ বিষয়ে আমাদেরকে কোনো লিখিত কাগজ দেওয়া হয়নি, আমাদের সঙ্গে কোনো বৈঠক করা হয়নি এবং কোনো পূর্ব ঘোষণাও দেওয়া হয়নি। এভাবে কতদিন বন্ধ রাখতে হবে, তাও জানায়নি পুলিশ।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) ম. মিনহাজ উল ইসলাম জানান, অনেক সময় দেখা যাচ্ছে মাদকসেবীরা রাতে শহরের লঞ্চঘাটে এসে আড্ডাবাজি করছে। (তাদের মধ্যে) চোর থাকতে পারে। এজন্য পুলিশ সব দোকানপাট বন্ধ করে দিচ্ছে। 

এ কারণে পুলিশের দোকান বন্ধ করার ক্ষমতা আছে কী না, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশ গিয়ে দোকানপাট বন্ধ করে দিতে পারে।

'প্রিভেনটিভ ওয়েতে (প্রতিরোধমূলক উপায়) আমাদের যতটুকু করার দরকার, আমরা তা করতে পারি', যোগ করেন পুলিশ সুপার।

মুন্সিগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তারিকুজ্জামান বলেন, 'রাত ১২ টার মধ্যে সব দোকানপাট বন্ধ করে দিচ্ছি। দোকানপাট বন্ধ করার এখতিয়ার আছে পুলিশের। রাত ১২ টার পর বেচাকেনার সুযোগ নেই।'

তিনি আরও জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী শিগগির সব দোকানপাট রাত ৮টার মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হবে।

গতকাল মঙ্গলবার রাতে লঞ্চঘাটে গিয়ে সব দোকান বন্ধ করেছেন সদর পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপপরিদর্শক ম. ওবায়দুর রহমান।

তিনি জানান, লঞ্চঘাটে ১২টার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে শহরে চুরি ও ছিনতাই রোধ করা। লঞ্চঘাট বন্ধ করে দিলে চুরি হয় না। রাত ১২ টার পর সন্দেহভাজন কাউকে ধরলেই বলে ঘাটে খেতে যাই। অজুহাত হিসাবে ঘাটে যাওয়ার কথা বললেও আদতে তারা চুরি করে পালিয়ে যায়।

'লঞ্চের মাধ্যমে যেসব যাত্রী আসেন, তাদের কোনো অসুবিধা হয়না', যোগ করেন ওবায়দুর রহমান।

তিনি আরও জানান, সেখানে নাইটগার্ড থাকে এবং নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরাও আছে। পাশাপাশি দোকানি, ও টার্মিনালের কর্মীরাও সেখানে থাকেন।

মুন্সিগঞ্জ আদালতের সরকারি কৌসুলি (পিপি) আবদুল মতিনকে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, 'পুলিশ দোকানপাট বন্ধ করতে পারে কী না, এ সম্পর্কে জানা নেই। কিন্তু দোকান অপরাধ করেছে কী? বন্ধ করে দিবে কেন? চোর ধরবে কৌশলে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ করে দিবে? দোকানদাররা তো চোর না।'

মুন্সিগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান জানান, যে উদ্দেশ্য নিয়ে দোকানপাট বন্ধ করছে পুলিশ, এটি ঠিক নয়। তারা প্রয়োজনে সে এলাকায় পাহারা দেবে। তারা এভাবে সব বন্ধ করে দিতে পারে না। এটা অন্যায়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা দেওয়া পুলিশের কাজ।

চাকুরীজীবী ম.জাকির হোসেন জানান, সোমবার রাত ১২টায় একজন অতিথিকে নিয়ে লঞ্চঘাটের একটি খাবারের দোকানে ভাত-তরকারি খাচ্ছিলাম। পুলিশ এসে উঠে যেতে বলায় খাবার রেখেই উঠে যেতে বাধ্য হয়েছি। এটা আমাদের জন্য বেশ কষ্টকর একটি অভিজ্ঞতা ছিল। 

শহরের হাটলক্ষীগঞ্জ এলাকার অটোরিকশা গ্যারেজের মেরামত শ্রমিক চালক দিদার মিয়াঁ জানান, রাত ১২টার পর গ্যারেজ বন্ধ করে ভাত খেতে লঞ্চঘাটে যাই। রাতে শহরের আর কোনো খাবারের দোকান খোলা থাকেনা। কিন্তু সেদিন রাত ১২টার পর গিয়ে দেখি পুলিশ সবকিছু বন্ধ করে দিচ্ছে। তারপর ঘাটে যেসব মিশুক, অটোরিকশা ছিল, সেগুলোকেও পুলিশ সরিয়ে দেয়। 

 

Comments

The Daily Star  | English

Fire breaks out at tissue warehouse in Narayanganj

Upon receiving the information, 19 firefighting units from various stations rushed to the scene and are currently working to bring the blaze under control

7m ago