পাল্টাচ্ছে সাইবার অপরাধের ধরন, বাড়ছে অপরাধীও
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয়। এরপর খুব কম সময়েই তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
প্রায়ই তারা একে অপরের সঙ্গে নিজেদের ব্যক্তিগত ছবি শেয়ার করতেন। এক পর্যায়ে প্রাইভেট ভিডিও চ্যাটের অফার দেন ওই নারী।
তবে, ওই যুবক ধারণাই করতে পারেননি যে শিগগিরই তিনি প্রতারণার ফাঁদে পড়বেন। সেই ভিডিও চ্যাটটি রেকর্ড করে ওই নারী তার কাছে টাকা দাবি করেন। দাবি করা টাকা না দিলে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন ওই নারী।
কাতারে বসবাসরত ৪০ বছর বয়সী ওই প্রবাসীর পরিবার গত ফেব্রুয়ারিতে অনানুষ্ঠানিকভাবে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কাছে সহায়তা চান। এই ঘটনায় কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি।
সাইবার ক্রাইমের তদন্ত কর্মকর্তারা এ ঘটনাকে 'সেক্সটরশন' হিসেবে অভিহিত করে এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে, এ ধরনের অপরাধ দেশে একটি সাধারণ ধরনে পরিণত হয়েছে।
সিটিটিসির ডেটাবেস অনুযায়ী, ২০২১ সালে সাইবার অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে ১৫ শতাংশই 'সেক্সটরশন'র ভুক্তভোগী। যাদের মধ্যে পুরুষ ২৩ জন ও নারী ১১৭ জন।
তবে, এ তথ্য দেশব্যাপী বিস্তৃত সাইবার অপরাধের মাত্র একটি নমুনা।
উন্নত প্রযুক্তি, সহজ অ্যাক্সেস ও দিনকে দিন নতুন প্ল্যাটফর্ম আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশে উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে সাইবার অপরাধও। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে অপরাধেরও নতুন ধরন পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সিটিটিসির সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৪টি ভিন্ন আইনের অধীনে প্রতি মাসে গড়ে ১৬৯টি সাইবার মামলা দায়ের হয়েছে। ২০২১ সালে এই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৪টি।
সিটিটিসির উপ-কমিশনার মিশুক চাকমা বলেন, 'সাইবার অপরাধের ধরন দিনকে দিন বদলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে অপরাধের সংখ্যাও। সহজেই ইন্টারনেটের অ্যাক্সেস ও নজরদারির অভাবের কারণেই এমনটা হচ্ছে।'
এমনকি এ ধরনের কার্যক্রমে বিদেশি নাগরিকদেরও সংশ্লিষ্টতাও দেখা গেছে।
উদাহরণস্বরূপ, গত ২১ এপ্রিল পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ১১ জন নাইজেরীয় নাগরিককে জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে।
বাংলাদেশি সহযোগীদের পাশাপাশি বিদেশি এই নাগরিকরাও ফেসবুকে বিভিন্ন ব্যক্তিদের টার্গেট করতেন এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার পরে উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতেন।
কিছু দিন পরে স্থানীয় এক সিন্ডিকেট সদস্য কাস্টমস কর্মকর্তা হওয়ার ভান করে টার্গেটকে ফোন করে বলতেন যে, তার একটি উপহার এসেছে, যেটি সংগ্রহ করতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শুল্ক দিতে হবে। এরপর টাকা পেয়ে তারা ওই ব্যক্তির সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিতেন।
অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীদের অনেকে নিজেদেরকে মার্কিন নারী সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়ে বর্তমানে সিরিয়ায় অবস্থান করছেন বলে দাবি করতেন।
শুধু ব্ল্যাকমেইলিং, চাঁদাবাজি ও আত্মসাৎ করেই অপরাধীরা থেমে যায়নি। এখন তারা প্রশ্নফাঁস থেকে শুরু করে যৌন হয়রানি এবং পাচার থেকে শুরু করে সংঘর্ষ পর্যন্ত করছে।
সম্প্রতি একটি সিন্ডিকেট হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিএসএইচই) একটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও সমাধান ফাঁস করে দেয়। গত ১৩ মে ঢাকার ৬১টি কেন্দ্রে ওই নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
সিটিটিসি কর্মকর্তা মিশুক চাকমা বলেন, 'সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের সক্রিয়তার জন্য ভুয়া খবর খুব দ্রুতই দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এতে ভয়ংকর অপরাধের পথ তৈরি হয়।'
ফেসবুকে মন্তব্যের জের ধরে গত ১২ মার্চ গাজীপুরের কাপাসিয়ার শোম্মানিয়া ইউনিয়নে এক সংঘর্ষে ৩ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন।
২০২১ সালের মে থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম টিকটক ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধের জন্য প্রায় ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
টিকটকের মাধ্যমে করা অপরাধের ধরনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, 'টিকটকে তারকা' হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মূলত তরুণীদের লক্ষ্য করা হতো।
ভুক্তভোগীরা একবার সেই ফাঁদে পা দেওয়ার পর থেকেই শুরু হয় ভয়ংকর নির্যাতন ও পরিশেষে মানসিক ট্রমা।
এই ধরনের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ও ভারতে পাচার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রলুব্ধ করে সংঘবদ্ধ পাচার চক্র অন্তত ৫০ জন তরুণীকে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করেছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) কর্মকর্তারা জানান, মাত্র কয়েক বছর আগেও তারা প্রতি মাসে গড়ে প্রায় দেড় হাজার সাইবার অপরাধের অভিযোগ পেতেন। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে আড়াই হাজার।
সাম্প্রতিক সময়ে সাইবার অপরাধ বাড়ছে উল্লেখ করে সিআইডির ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন (সিপিসি) বিভাগের এসপি এসএম আশরাফুল আলম বলেন, 'এসব অপরাধের বেশিরভাগই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তবে, উন্নত প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে অপরাধগুলো এখনো আরও বড় আকারে দেশে সংঘটিত হচ্ছে না, সেটাই এখন স্বস্তির বিষয়।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. তাওহিদুল হক বলেন, 'সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে সাইবার অপরাধের শিকার অনেক ভুক্তভোগীই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যায় না।'
সাইবার অপরাধের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার জন্য ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করেছেন তিনি।
'অভিযোগগুলো তখনই করা হয়, যখন ভুক্তভোগীদের অন্য আর কোনো উপায় থাকে না। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলা যেতে পারে যে, এই সংখ্যাগুলো আসলেই বাড়ছে', যোগ করেন মো. তাওহিদুল হক।
Comments