হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন বাড়ায় কমেছে রেমিট্যান্স
বিপুলসংখ্যক প্রবাসীকর্মী হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোয় চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের মে পর্যন্ত দেশে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১৯ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে যা ছিল ২২ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই ১১ মাসে রেমিট্যান্স ৩ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার কমেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় টাকা পাঠানোর অবৈধ চ্যানেল হুন্ডি কার্যক্রম আবারও স্বাভাবিক হওয়ায় প্রবাসীকর্মীরা এর মাধ্যমেই টাকা পাঠাচ্ছেন। এ ছাড়াও, ডলারের বিপরীতে টাকার দর বাড়াও এর অন্যতম একটি কারণ।
মহামারিতে কাজ হারানো অনেক প্রবাসীকর্মী তাদের সব সঞ্চয় নিয়ে দেশে ফিরে আসায় ২০২০-২১ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স বেড়েছে বলেও তারা বলেন।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ লাখ ৮ হাজার প্রবাসীকর্মী দেশে ফিরেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসেছে ১৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার।
২০২১-২২ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি কমেছে সৌদি আরব থেকে, যেখানে রয়েছে ২২ লাখ বাংলাদেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। অথচ এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
রেমিট্যান্স কম আসার তালিকায় দ্বিতীয়তে রয়েছে মালয়েশিয়া। ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৮৪৯ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন ডলার। এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
একই সময়ের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত, কাতার ও যুক্তরাজ্য থেকে আসা রেমিট্যান্সের প্রবাহও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ বলেন, মহামারিকালে দেশে টাকা পাঠানোর অবৈধ চ্যানেল বন্ধ থাকায় ব্যাংকগুলো যে সুবিধা পাচ্ছিল, এখন আবার তা কমতে শুরু করেছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার প্রবাসীকর্মীরা এখন আবার সেই অবৈধ চ্যানেলের দিকেই ঝুঁকতে শুরু করেছেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'যারা দেশে রেমিট্যান্স পাঠায়, তাদেরকে বৈধ চ্যানেল ব্যবহারে উৎসাহিত করতে বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'
বৈদেশিক মুদ্রার বাজারের সাম্প্রতিক অস্থিরতার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, 'ডলারের বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বৈধ ও অবৈধ চ্যানেলের মধ্যে ৬-৭ টাকার মতো পার্থক্য রয়েছে।'
এই ব্যবধান ২-৩ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'এত বেশি ব্যবধান থাকায় অবৈধ চ্যানেলের ব্যবহার বাড়বে কি না, সেটাই এখন উদ্বেগের বিষয়।'
ফরেক্স মার্কেটকে স্থিতিশীল করতে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারপ্রতি বিনিময় হার ৯২ টাকা নির্ধারণ করেছে। এ নিয়ে চলতি বছরে ১২ বারের মতো টাকার অবমূল্যায়ন হলো।
গত এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো গত ২ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারকে বাজারমূল্য অনুযায়ী নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই উদ্যোগের বিষয়ে মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'এই উদ্যোগ প্রবাসীকর্মীদের বৈধ চ্যানেল থেকে অবৈধ চ্যানেলে স্থানান্তরিত হওয়ার প্রবণতাকে হ্রাস করবে।'
তিনি আরও বলেন, 'ঐতিহাসিক ধারা' বজায় রেখে মহামারি-পূর্ববর্তী (২০১৯-২০) সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরে দেশে অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বিএমইটির তথ্যে দেখা যায়, ২০১৭ সাল থেকে টানা ৫ বছর বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্সে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে।
মুস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে যাওয়ায় এক বছরের মধ্যে অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স আরও বাড়তে পারে। তবে, অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর ঝুঁকি তুলে ধরে এক্ষেত্রে নজরদারি বাড়ানো ও জোরালো প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে।
নতুন অভিবাসীদের লক্ষ্য করে একটি শক্তিশালী প্রচার কার্যক্রমের মাধ্যমে আগামী অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স ২০২০-২০২১ সালে প্রাপ্ত ২৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারও স্পর্শ করতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে ৭ লাখ ৯৯ হাজার বাংলাদেশি কর্মী বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, মহামারির মধ্যে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে অবৈধ চ্যানেল থেকে বৈধ চ্যানেলে যাওয়াই ২০২০-২০২১ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
তিনি আরও বলেন, এ ছাড়াও মহামারিকালে অনেক বিদেশিকর্মী তাদের সব সঞ্চয় নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। তাই অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স বেড়েছে।
'কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ও অবৈধ চ্যানেলগুলোর কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসায় অনেকেই টাকা পাঠানোর জন্য এখন সেই মাধ্যমকেই বেছে নিচ্ছেন', বলেন তিনি।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর আরেকটি কারণ হলো 'ভিসা বাণিজ্য'।
'আন্ডার-ইনভয়েসিং' শনাক্ত করা জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে তাদের গোয়েন্দা সক্ষমতা আরও বাড়ানোর পরামর্শও দেন জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, 'আন্ডার-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অনেক আমদানিকারক অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর সুযোগ তৈরি করে কর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'করোনার সংক্রমণ যখন বেশি ছিল, সেসময় চলাফেরা সীমিত থাকায় প্রবাসীকর্মীরা বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাঠিয়েছেন। এ ছাড়াও অনেক অভিবাসীকে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে।
'সরকার নগদ প্রণোদনা দিয়ে অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেষ্টা করছে', বলেন তিনি।
ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য নগদ প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে উল্লেখ করে সিরাজুল আসলাম আরও বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই প্রণোদনা আরও বাড়ানোর সুপারিশ করেছে।'
Comments