হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড: শিল্পখাতে বহুল ব্যবহৃত, অব্যবস্থাপনায় বিপজ্জনক
চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকার বিএম কনটেইনার ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামক রাসায়নিক পদার্থ থাকার কারণে সেখানে এতো বড় বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে ধারণা করছেন বাংলাদেশে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
কিন্তু এই হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড আসলে কী?
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড এর রাসায়নিক সংকেত H2O2। ফ্যাকাসে নীল বর্ণের তরল পদার্থ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে মূলত জারক পদার্থ, ব্লিচিং এজেন্ট এবং জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ছোটখাটো কাটাছেঁড়াতে জীবাণু মুক্তকরণের মতো ব্যক্তিগত কাজে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের লঘু জলীয় দ্রবণ ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন শিল্প খাতে ব্যবহৃত হয় অধিক ঘনত্বের হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড।
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের স্ফুটনাংক ১৫০.২°সেলসিয়াস (৩০২.৪°ফারেনহাইট) যা পানির তুলনায় ৫০°সেলসিয়াস (৯০°ফারেনহাইট) বেশি।
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের ব্যবহার
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের বিভিন্ন শিল্পখাত ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে বহুবিধ ব্যবহার আছে। কাগজ, মণ্ড, চামড়া এবং পোশাক শিল্পে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে ব্লিচিংয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়।
এছাড়া, খাবার ও পানীয় পণ্যের এসেপটিক মোড়কীকরণ, ডিটারজেন্ট, মাউথওয়াশ, স্যানিটাইজার তৈরিতে, পানির বিশোধন, কন্টাক্ট লেন্স পরিষ্কার, কাপড়ের স্টোন ওয়াশ ও উড়োজাহাজ-রকেট শিল্প খাতসহ বিভিন্ন কাজে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে ব্যবহার করা হয়।
উৎপাদন, আমদানি ও রপ্তানি
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড মূলত ১৯৩৯ সালে জার্মানির রাসায়নিক কোম্পানি বিএএসএফ এর উদ্ভাবিত অ্যানথ্রাকুইনোন নামক রাসায়নিক এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপাদন করা হয়।
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পূর্বে সম্পূর্ণভাবে আমদানি নির্ভর থাকলেও, বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণে রপ্তানি হয়েছে।
বাংলাদেশে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড উৎপাদন করে এমন অন্তত ৬টি কারখানা আছে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানি করে আয় হয়েছে ২ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২০৭ কোটি টাকার সমান।
২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারত, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং ইন্দোনেশিয়ায় ১ কোটি ৩৯ লাখ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানি হয়েছে। অন্যদিকে নেদারল্যান্ডস, থাইল্যান্ড, জাপানসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকে বাংলাদেশে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের আমদানি মূল্য ছিল ৬ লাখ ৫৬ হাজার মার্কিন ডলার।
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড যেভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে মূলত এটি একটি জারক পদার্থ হওয়ার কারণে। এটি নিম্নোক্ত কারণে সাধারণত বিপজ্জনক, বিধ্বংসী হয়ে ওঠে-
দূষণের প্রতি তীব্র সংবেদনশীলতা
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড কোনো প্রকার দূষণের সংস্পর্শে আসলে ক্ষয় হতে শুরু করে। ক্ষয়ের মাত্রা দ্রুত হলে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড থেকে পানি, অক্সিজেন ও তাপ তৈরি হয়। ফলে যে প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি হয় তা থেকে বড় ধরনের বিস্ফোরণের উদ্ভব হতে পারে।
জৈব যৌগের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া
অক্সালিক এসিডের মতো বিবিধ জৈব যৌগের সংস্পর্শে আসলে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বিস্ফোরক মিশ্রণ এবং অভিঘাত সংবেদনশীল রাসায়নিক যৌগ সৃষ্টি করে ভয়ানক আগুনের সূত্রপাত ঘটাতে পারে।
অজৈব যৌগের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বেরিলিয়াম, রেডিয়ামের মতো মৃৎক্ষারসহ অন্যান্য বিভিন্ন অজৈব যৌগের সংস্পর্শে আসলে অনুঘটক ভিত্তিক অথবা জারণ-বিজারণ বিক্রিয়ার দরুন ক্ষয়ের সম্মুখীন হয়ে বিপুল তাপের সৃষ্টি করতে পারে। যা সংরক্ষিত হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের আশেপাশে থাকা দাহ্য পদার্থের বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য যথেষ্ট।
জ্বালানি দ্রব্যের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া
অতীব দ্রুত এবং আলো ও তাপের মধ্য দিয়ে শক্তি নিঃসরণ পন্থার মধ্য দিয়ে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড জৈব অ্যামাইন, হাইড্রোজেন-ভিত্তিকসহ বহুবিধ জ্বালানির সঙ্গে বিক্রিয়ায় লিপ্ত হতে পারে। যার ফলাফল আগুন সৃষ্টিসহ তীব্র শক্তির বিস্ফোরণ।
এছাড়া চোখ বা ত্বকে অতিরিক্ত মাত্রায় হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের সংস্পর্শ ঘটলে অন্ধত্ব ও ত্বক পুড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড শরীরে প্রবেশ করলে দেখা দিতে পারে তীব্র মাথাব্যথা, নাক জ্বলা বা বমিও হতে পারে। অতিরিক্ত হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ফুসফুস জটিলতা সৃষ্টির কারণ হতে পারে।
সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা ও পরিবহন সতর্কতা
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নিজে দাহ্য পদার্থ না হলেও আগুন বা দাহ্য পদার্থের আশেপাশে রাখলে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে।
শীতল, শুষ্ক, ভালোভাবে বাতাস চলাচল করে এরকম জায়গায় হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে সংরক্ষণ করতে হয়।
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের ক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে বলে ব্রোঞ্জ, কপার, নিকেল, টাইটেনিয়ামের মতো উপাদান সমূহকে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের সংরক্ষণ কাজে ব্যবহার করা উচিৎ না।
প্রকৃতিতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্যের একটি পদার্থ এবং এটি আলোর উপস্থিতিতে ক্ষয় হতে শুরু করে। সেজন্য হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে স্ট্যাবিলাইজারের সংযোগে অস্বচ্ছ পাত্রে সংরক্ষণ করতে হয়।
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের নিরাপদ সংরক্ষণ ও ব্যবহারে রুল অফ ফোর অনুসরণ করতে পরামর্শ দেওয়া হয়। অর্থাৎ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে কখনো বাতাস চলাচল করতে পারেনা এমন কোথাও আবদ্ধ না রাখা, দুষিত না করা, এর সংস্পর্শে না আসা, সর্বদা পানির যোগান রাখা।
অন্যদিকে, নিরাপদ ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে ট্যাংক ট্রাকের মতো পরিবহন বাহনে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড স্থানান্তরের কাজ অ্যালুমিনিয়াম অথবা স্টেইনলেস লোডিং আর্মস বা বিশেষভাবে তৈরি পলি-ইথিলিন রাসায়নিক নলের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়।
শিল্পখাতে বহুল ব্যবহৃত হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনায় রাসায়নিক সংরক্ষণের বৈশ্বিক নিয়ম 'ম্যাটারিয়াল সেইফটি ডেটাশিট' অনুসরণে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দেখা দিলে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড থেকে ঘটতে পারে অত্যন্ত বিপজ্জনক দুর্ঘটনা।
Comments