চুক্তিতেই আটকে আছে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া

প্রতীকী ছবি | স্টার ফাইল ফটো

মালয়েশিয়ার শ্রম বাজারে একটি বড় সুযোগ হারাচ্ছে বাংলাদেশ। নিয়োগ সংস্থার অনিয়মের অভিযোগে ২০১৮ সাল থেকে নতুন করে কোনো বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মী নেয়নি কুয়ালালামপুর।

এরপর ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও, এখনো বাংলাদেশের জন্য চতুর্থ বৃহত্তম শ্রম বাজার হিসেবে বিবেচিত এই দেশটিতে নতুন করে কোনো কর্মী যেতে পারছেন না। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটছে।

দীর্ঘ আলোচনার পর ঢাকা ও কুয়ালালামপুর গত বছরের ডিসেম্বরে নতুন শর্তে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী যাওয়ার বিষয়ে একটি স্মারক চুক্তি সই করে। কিন্তু কর্মকর্তারা এখনো অভিবাসন প্রক্রিয়া আবারও শুরু করার জন্য সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা চূড়ান্ত করতে পারেননি।

২ দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আজ বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে আলোচনা করবেন। এর আগে মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের অনুরোধে বেশ কয়েকটি পূর্বনির্ধারিত বৈঠক মুলতবি করা হয়।

স্মারক চুক্তির অগ্রগতি বিষয়ে মন্তব্য জানতে চেয়ে বাংলাদেশে মালয়েশিয়ার দূতাবাসের কাছে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে ইমেল পাঠালেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

ডিসেম্বরের স্মারক চুক্তির পর ২ পক্ষ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা ও এ সংক্রান্ত কাগজপত্র চূড়ান্ত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। যেমন: অভিবাসন খরচ, মেডিকেল পরীক্ষা ও নিয়োগদাতা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা।

১৮ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার জনসম্পদমন্ত্রী এম সারাভানানের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) একটি বৈঠকের প্রস্তাব জানান, যেখানে উভয় পক্ষের কর্মকর্তারা বসে নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত ও বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনা করবে।

গত সপ্তাহে ডেইলি স্টারকে মন্ত্রী বলেন, 'আমরা ২৬ মে বৈঠক করার বিষয়ে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে বৈঠকের তারিখ বদলানোর অনুরোধ আসে।'

জানুয়ারি থেকে শুরু করে মালয়েশিয়ার কর্মকর্তাদের অনুরোধে বেশ কয়েকবার বৈঠকের তারিখ বদলাতে হয়েছে বলেও জানান প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী।

তবে আজকের নির্ধারিত বৈঠকে একটি ইতিবাচক ফল পাওয়ার বিষয়ে 'আশাবাদী' বলেও জানান তিনি। তিনি আরও জানান, কর্মীদের অধিকারের সুরক্ষা দেওয়াকে তিনি প্রাধান্য দেবেন।

বর্তমানে মালয়েশিয়ায় ৮ লাখ বাংলাদেশি কর্মী কাজ করছেন।

দেশটি ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে শ্রম নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। কারণ হিসেবে অনিয়ম ও নিয়োগের উচ্চ খরচের কথা বলা হয়, যা ক্ষেত্রবিশেষে জনপ্রতি ৪ লাখ টাকার মতো ছিল।

২০১৬ সালে গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জি-টু-জি) প্লাস প্রক্রিয়ার আওতায় মালয়েশিয়া সরকার মাত্র ১০টি বাংলাদেশি সংস্থাকে কর্মী নিয়োগ দেওয়ার জন্য নির্বাচন করে। বাংলাদেশ সরকার ৭৪৫টি প্রতিষ্ঠানের নাম প্রস্তাব করেছিল।

সর্বশেষ স্মারকের পর নিয়োগদাতা সংস্থাগুলো আবারও অভিযোগ তুলেছে, আগের 'সিন্ডিকেটের' সদস্যরা এ প্রক্রিয়ায় বাঁধা দিচ্ছে এবং নিজেদের মধ্যে অবৈধ জোট সৃষ্টি করে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদিত নিয়োগ সংস্থার তালিকায় আসতে বাঁধা সৃষ্টি করছে।

এই সংস্থাগুলো গত কয়েক মাসে বিভিন্ন তকমায় ঢাকা বেশকিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, যার মধ্যে আছে গোলটেবিল বৈঠক, সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন, যেখানে সব নিবন্ধিত সংস্থার জন্য মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।

এ ছাড়াও, তারা বিষয়টি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কাছে তুলে ধরেছে।

প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ বেশ কয়েকবার জানান, তিনি সব বৈধ সংস্থার জন্য সুযোগ সৃষ্টি ও কর্মীদের অধিকার রক্ষাকে প্রাধান্য দেবেন।

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার চৌধুরী জানান, অভিবাসী কর্মীদের ন্যূনতম খরচে অভিবাসনের জন্য আরও উন্নত সুযোগ থাকা উচিত।

তিনি আরও জানান, মালয়েশিয়ার নিয়োগদাতাদের জন্যও বাংলাদেশের 'সেরা' সংস্থাগুলোসহ আরও উন্নত বিকল্প থাকা উচিত।

'বাজারকে শিগগির উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। তবে, স্পষ্টতই এক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনার অভাব রয়েছে', যোগ করেন তিনি।

বায়রার অপর সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান জানান, বাংলাদেশি নিয়োগদাতা সংস্থাগুলো যেকোনো মুহূর্তে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো শুরুর জন্য প্রস্তুত আছে।

নতুন স্মারক অনুযায়ী, বাংলাদেশি কর্মীদের মালয়েশিয়ায় অভিবাসনের খরচ জোগাবে সে দেশের নিয়োগদাতা সংস্থা। স্মারক সইয়ের পর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানায়।

নিয়োগদাতারা যেসব খরচ যোগাবেন, তার মধ্যে আছে মালয়েশীয় নিয়োগ সংস্থার সেবা খরচ, মালয়েশিয়ায় যাওয়া-আসা ও সেখানে থাকার খরচ।

এ ছাড়াও, নিয়োগদাতা সংস্থা মালয়েশিয়ায় ইমিগ্রেশন, ভিসা, মেডিকেল টেস্ট, বিমা, করোনাভাইরাসের পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টিন খরচও জোগাবে।

এক্ষেত্রে শ্রম রপ্তানি প্রক্রিয়ায় নতুন সংযুক্তি হবে মালয়েশীয় নিয়োগদাতা সংস্থাদের উপস্থিতি। এর আগে পুরো প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশি সংস্থারা পরিচালনা করতো।

জেডব্লিউজি এই প্রক্রিয়ার বাস্তবায়নের কাজটি তদারকি করবে।

বাংলাদেশি কর্মীরা বনায়ন, কৃষি, উৎপাদন, বিবিধ সেবা, খনন, পাথর ভাঙ্গা ও নির্মাণ খাতসহ বিভিন্ন খাতে কাজ পাবেন বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

ব্র্যাকের কর্মকর্তা ও শ্রম অভিবাসন বিশেষজ্ঞ শরিফুল হাসান জানান, বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর আগে বাংলাদেশকে অভিবাসন খরচসহ বেশকিছু বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

তিনি জানান, অভিবাসন খরচ কখনোই কর্মীর ৩ মাসের বেতনের চেয়ে বেশি হওয়া চলবে না।

এ মুহূর্তে একজন বাংলাদেশি পুরুষ অভিবাসীকর্মীর অভিবাসন খরচ পুনরুদ্ধার করতে এখন প্রায় দেড় বছরের বেতন প্রয়োজন হয় বলেও জানান তিনি।

এ ছাড়াও অভিবাসীকর্মীদের বিভিন্ন ধরনের অধিকার, যেমন থাকা ও কাজের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ ও সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার মতো বিষয়গুলোর দিকেও খেয়াল রাখা উচিত বলে মত প্রকাশ করেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ শরিফুল হাসান।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের পর মালয়েশিয়াই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রম বাজার। ১৯৭৮ সাল থেকে প্রায় ১০ লাখ ৫৭ হাজার কর্মী কাজ করার জন্য বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় গেছেন।

বিএমইটির তথ্যে আরও জানানো হয়েছে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে, সে বছরই ১ লাখ ৭৫ হাজার কর্মী গেছেন মালয়েশিয়ায়।

এর আগের ৩ বছরে মালয়েশিয়ায় কাজ নিয়ে ১ লাখ ৭০ হাজার কর্মী গেছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) 'অভিবাসনের খরচ সমীক্ষা ২০২০' অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীর গড় অভিবাসন খরচ ৪ লাখ ৪ হাজার টাকা এবং গড় মাসিক আয় ২৫ হাজার ৬০০ টাকা।

এই হারে, একজন কর্মীকে অভিবাসন খরচ পুনরুদ্ধার করতে প্রায় দেড় বছর সময় লাগে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশি অভিবাসীরা প্রায় ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।

অনুবাদ করছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Jatiyo Party's office set on fire in Khulna

Protesters vandalised the Jatiyo Party office in Khulna's Dakbangla area last evening

1h ago