উত্তর কোরিয়ার করোনা ‘বিপর্যয়’, যা জানি-যা জানি না

ছবি: রয়টার্স

উত্তর কোরিয়া প্রথমবারের মতো করোনা সংক্রমণের তথ্য প্রকাশ করেছে। এর আগে, দেশটির কেউ করোনায় আক্রান্ত হননি বলে দাবি করে আসছিল তারা। তবে, বর্তমান পরিস্থিতি অর্থাৎ অত্যন্ত সংক্রামক এই ভাইরাসের বিস্তারকে 'মহাবিপর্যয়' হিসেবে উল্লেখ করেছেন দেশটির নেতা কিম জং উন।

উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম কেসিএনএ অনুসারে, গত শুক্রবার থেকে শনিবার সন্ধ্যার মধ্যে সে দেশে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়াও, ২ লাখ ৯৬ হাজার ১৮০ জনের 'জ্বর' রিপোর্ট করা হয়েছে।

তবে, করোনায় কতজনের মৃত্যু হয়েছে বা জ্বরে আক্রান্তদের কতজনের করোনা আছে তা উল্লেখ করা হয়নি। এর কারণ হয়তো করোনা পরীক্ষায় দেশটির সীমিত সক্ষমতা।

কেসিএনএ'র তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে মোট মৃতের সংখ্যা ৪২ জনে পৌঁছেছে এবং মোট জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ২০ হাজার ৬২০ জন। তাদের মধ্যে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩০ জন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেছেন এবং ৩ লাখ ২৪ হাজার ৫৫০ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন।

উত্তর কোরিয়া গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, তারা করোনায় আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত করেছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে ভঙ্গুর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার দেশের জন্য উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

কিন্তু, দেশটির সরকারের তথ্য প্রকাশের অনিচ্ছা ও বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে প্রকৃত পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা অত্যন্ত কঠিন।

ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

সিএনএন'র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বিদেশি কূটনীতিক ও ত্রাণকর্মীরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবার অভাব ও প্রতিদিনের জীবনযাপনে 'অভূতপূর্ব' বিধিনিষেধ আরোপের কারণে উত্তর কোরিয়া ত্যাগ করেন। ফলে, দেশটির রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এ দিকে, উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমের প্রতিবেদনগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অস্পষ্ট এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। যেমন: দেশটির টিকা দেওয়ার হার এবং ২৫ মিলিয়ন মানুষের জীবিকার ওপর লকডাউনের প্রভাব নিয়ে তেমন কোনো তথ্য জানা যায়নি।

উত্তর কোরিয়া ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটি করোনা মোকাবিলায় কতটুকু সক্ষম বা তাদের বর্তমান অবস্থা কী তা জানার চেষ্টা করা যেতে পারে।

যেভাবে দেশটিতে সংক্রমণের দেখা মিলল

সম্প্রতি, উত্তর কোরিয়া করোনা সংক্রমণের তথ্য দিলেও সংক্রমণের প্রকৃত কারণ ঘোষণা করেনি। ভাইরাস মোকাবিলায় ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে দেশটির সীমান্ত কঠোরভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে, দেশটি বিশ্ব থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এমনকি, করোনার হুমকির কথা উল্লেখ করে টোকিও ও বেইজিং অলিম্পিকে দল পাঠানোর আমন্ত্রণও প্রত্যাখ্যান করে তারা।

সিএনএন'র প্রতিবেদন মতে, যখন করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়া শুরু হয় তখন দেশটি আরও বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। এমনকি, চীনের সঙ্গে প্রায় সব বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাদের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার বেইজিং থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৯৯ শতাংশ আমদানি হ্রাস পায়।

এতো কঠোরতার মধ্যেও কীভাবে দেশটিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হলো তা এখনো অনিশ্চিত।

গত বৃহস্পতিবার কেসিএনএ প্রথম করোনা শনাক্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিন্তু, তারা কীভাবে আক্রান্ত হলেন বা কতজন আক্রান্ত হয়েছেন প্রতিবেদনে সেসব তথ্য নির্দিষ্ট করে জানানো হয়নি। এতে বলা হয়, গত ৮ মে জ্বরে আক্রান্ত একদল মানুষের কাছ থেকে সংগৃহীত নমুনায় অত্যন্ত সংক্রামক ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

কেসিএনএ'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত শুক্রবারের মধ্যে ১৮ হাজার মানুষের 'জ্বর' রিপোর্ট করা হয়েছে এবং গত বৃহস্পতিবার ৬ জনের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজনের ওমিক্রনের বিএ.২ সাবভেরিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে।

উত্তর কোরিয়ার সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, এই জ্বরের কারণ শনাক্ত করা যায়নি এবং এটি এপ্রিলের শেষ দিক থেকে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৮৭ হাজার ৮০০ জনকে আইসোলেশনে নেওয়া হয়েছে।

গত শনিবার কেসিএনএ জানিয়েছে, এপ্রিলের শেষ থেকে ১৩ মে পর্যন্ত মোট ৫ লাখ ২৪ হাজার ৪৪০ জনের 'জ্বরের' উপসর্গ দেখা গেছে। তাদের মধ্যে ২ লাখ ৮০ হাজার ৮১০ জন এখনো কোয়ারেন্টিনে চিকিৎসাধীন। বাকিরা সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

উত্তর কোরিয়া কি বড় ধরনের সংক্রমণ মোকাবিলা করতে পারবে?

সিএনএন বলছে, করোনার বড় ধরনের সংক্রমণ উত্তর কোরিয়ার জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে। কারণ, দেশটির জরাজীর্ণ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এবং পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব। যা এই অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাসে আক্রান্ত বিপুল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসাসেবা দিয়ে ওঠতে পারবে না।

এ ছাড়াও, উত্তর কোরিয়ার স্বচ্ছতার অভাব এবং তথ্য ভাগ করে নেওয়ার অনিচ্ছাও তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।

সিএনএন আরও বলছে, ১৯৯০-এর দশকের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে কতজন মারা গিয়েছিল উত্তর কোরিয়া তা কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি। কিন্তু, বিশেষজ্ঞদের মতে সেই দুর্ভিক্ষে প্রায় ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

ওয়াশিংটনভিত্তিক উড্রো উইলসন সেন্টারের হুন্দাই মোটর-কোরিয়া ফাউন্ডেশন সেন্টার ফর কোরিয়ান হিস্ট্রির পরিচালক জিন লি মহামারির শুরুতে সিএনএন'কে বলেছেন, 'উত্তর কোরিয়ায় মৌলিক ওষুধের সরবরাহ এত সীমিত যে তাদের জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের প্রতিরোধমূলক ওষুধের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। তাদের জন্য যে কোনো ধরনের মহামারি মোকাবিলা সহজ হবে না।'

২০১১ সালে দেশ ছেড়ে পালানো উত্তর কোরিয়ার সাবেক চিকিৎসক চোই জুং-হুন সিএনএন'কে বলেন, ২০০৬ থেকে ২০০৭ সালে যখন তিনি হামের সংক্রমণ মোকাবিলায় সহায়তা করেন, তখন উত্তর কোরিয়ার সার্বক্ষণিক কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন সুবিধা পরিচালনার মতো রিসোর্স ছিল না।

তিনি আরও বলেন, 'তখন সন্দেহজনক রোগী শনাক্তের পর রোগীদের পর্যবেক্ষণে হাসপাতাল বা কোয়ারেন্টিনে স্থানান্তর করা হতো। কিন্তু, উত্তর কোরিয়ার সমস্যা হচ্ছে ম্যানুয়াল অনুসরণ করা হয় না। কারণ হাসপাতাল ও কোয়ারান্টিনে থাকা মানুষদের পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ না করায় তারা খাবারের জন্য পালিয়েছিল।

এখন পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার প্রতিক্রিয়া কী?

প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে করোনা সংক্রমণের খবর পাওয়ার পর উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম দেশটির বর্তমান পরিস্থিতিকে 'জাতীয় জরুরি অবস্থা' হিসেবে ঘোষণা করেছে।

গত বৃহস্পতিবার দেশটির নেতা কিম সব শহরকে লকডাউনের আওতায় আনেন। এ ছাড়া, 'জ্বর বা অস্বাভাবিক উপসর্গযুক্ত ব্যক্তিদের' কোয়ারেন্টিনে রাখার নির্দেশ দেন।

কেসিএনএ'র মতে, করোনা মোকাবিলায় সরকার যেসব চিকিৎসা সামগ্রী মজুত করেছিল তা বিতরণের নির্দেশ দিয়েছেন কিম।

পরে কিম দেশটির পলিটব্যুরোর এক বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। সেখানে সবাই মহামারি মোকাবিলায় 'সর্বোচ্চ' উদ্যোগ বাস্তবায়নে সম্মত হন। এই উদ্যোগের মধ্যে আছে- ওয়ার্ক ইউনিটগুলো বিচ্ছিন্ন করা, 'জ্বর ও অস্বাভাবিক উপসর্গযুক্ত' ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা, আইসোলেশনে রাখতে সক্রিয়ভাবে মেডিকেল চেকআপ পরিচালনা করা।

কেসিএনএ বলেছে, জাতীয় অর্থনীতির প্রধান খাতগুলোতে উচ্চ মাত্রায় উৎপাদন অব্যাহত রাখতে এবং জনগণের জীবনমানকে স্থিতিশীল রাখতে ব্যবহারিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

কেসিএনএ'র তথ্য অনুযায়ী, পলিটব্যুরো দেশের মহামারিবিরোধী খাতের 'অবহেলা, শিথিলতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং অযোগ্যতার' জন্য সমালোচনা করেছে।

গত শুক্রবার চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সিজিটিএন'র এক সাংবাদিক পিয়ংইয়ং থেকে একটি ভিডিও প্রকাশ করেন। যেখানে তিনি সেখানকার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।

সাংবাদিক জাং কিং এক উইবো পোস্টে বলেন, 'আমরা যতদূর জানি পিয়ংইয়ংয়ের খুব বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া, চিকিৎসা ও মহামারি প্রতিরোধে তাদের পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই।'

তিনি আরও বলেন, যেহেতু রাজধানী লকডাউনের আওতায় আছে। তাই আমার ঘরে যে খাবার আছে তা কেবল এক সপ্তাহের জন্য যথেষ্ট। সরকার পরবর্তী কোন নীতি ঘোষণা করবে আমরা তার অপেক্ষায় আছি।

গত শনিবার কিম দেশটির জরুরি মহামারি ব্যবস্থা ও চিকিৎসা সামগ্রী পরিদর্শন করেন। কেসিএনএ'র মতে, তিনি উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তাদের চীনের 'উন্নত ও কোয়ারেন্টিন ফলাফল এবং সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অর্জিত অভিজ্ঞতা' থেকে শিক্ষা নেওয়ার আহ্বান জানান।

উত্তর কোরিয়ার টিকার অবস্থা কী?

সিএনএন বলছে, বৈশ্বিক করোনার টিকা শেয়ারিং প্রোগ্রাম কোভ্যাক্সের জন্য যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও উত্তর কোরিয়া করোনাভাইরাসের কোনো টিকা আমদানি করেছে বলে জানা যায়নি।

যদি ধরে নেওয়া হয় বেশিরভাগ উত্তর কোরিয়ান টিকা নেননি- তাহলে দেশটির সীমিত পরীক্ষার সক্ষমতা, অপর্যাপ্ত চিকিৎসা অবকাঠামো ও বাইরের বিশ্ব থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখার কারণে সাম্প্রতিক সংক্রমণ দেশটিতে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করবে।

টিকার প্রবেশাধিকার চেয়ে দেশটির নেতার কাছে অনেকেই আহ্বান জানিয়েছেন।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পূর্ব এশিয়ার গবেষক বোরাম জাং বিবৃতিতে জানিয়েছেন, উত্তর কোরিয়ার কাছে করোনার সংক্রমণ থেকে জনগণকে রক্ষার পর্যাপ্ত টিকা পাওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। তবুও, তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বাধীন কোভ্যাক্স প্রোগ্রামে দেওয়া অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও সিনোভ্যাক টিকার লাখ লাখ ডোজ প্রত্যাখ্যান করেছে।

তিনি বলেন, 'সেখানে করোনা সংক্রমণের প্রথম আনুষ্ঠানিক খবর জানার পরও যদি তারা এই পথে চলতে থাকলে অনেক মানুষের মৃত্যু হতে পারে। ফলে, এটি হবে মানুষের স্বাস্থ্য অধিকার সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে একটি অযৌক্তিক অবহেলা।

রয়টার্স জানিয়েছে, গত ফেব্রুয়ারিতে কোভ্যাক্স উত্তর কোরিয়াকে বরাদ্দ দেওয়া টিকার ডোজের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। কারণ, দেশটি টিকার চালান গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Bad loans hit alarming record

Awami League-affiliated businesses had already put the country’s banking sector in trouble with huge bad debts, but the loans disbursed through irregularities to these companies turned sour even at a more alarming pace after the party’s ouster.

5h ago