হাওরে ধান হারানোর কষ্টমাখা ঈদ

সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের রংচি গ্রামে কিছু আধাপাকা ধান আর একটি বাছুর নিয়ে উদাস হয়ে বারান্দায় বসে আছেন সুরুজ বানু।ছবিটি ঈদের আগেরদিন বিকেলে তোলা।ছবি: দ্বোহা চৌধুরী/স্টার

'বন্যায় আমাদের গ্রামের সবার ধান গেছে, কারো ২ আনা ধানও টিকেনি। নিজেদের খাওয়ার ধান নাই, গবাদিপশুর খাবার খড়ও নেই। আর যদি ২ সপ্তাহ পরও বন্যার পানি ঢুকত, তাহলে খাওয়ার মতো কিছু ধান অন্তত ঘরে তুলতে পারতাম।'

গত মাসের শুরুতে আকস্মিক বন্যায় ধান তলিয়ে যাওয়ার শোক সামলে নিয়ে প্রবল হতাশা ভরা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার রংচি গ্রামের ৭৫ বছর বয়সী কৃষক আব্দুল মনাফ তালুকদার।

মধ্যনগর উপজেলার এই গ্রামটি টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ে অবস্থিত। এই গ্রামের ৪৪০টি পরিবারের সবাই হাওরে কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। আগাম আকস্মিক বন্যায় এই পরিবারগুলোর একমাত্র অবলম্বন বোরো ধান নষ্ট হয়ে গেছে।

মাথায় এক আটি আধাপাকা ও কিছুটা পঁচে যাওয়া ধান নিয়ে বাড়ি ফিরছেন গোলাম হোসেন। ছবিটি ঈদের আগের দিন সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের রংচি গ্রামে তোলা।ছবি: দ্বোহা চৌধুরী/স্টার

ঈদের আগের দিন সোমবার রংচি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের যে মাঠে এখন কৃষকদের ধান শুকাতে ব্যস্ত সময় পার করার কথা, সেই মাঠ প্রায় ফাঁকা। কয়েকটি শিশু সেখানে নষ্ট হয়ে যাওয়া ধান ও খড় শুকাচ্ছে। ফসল হারানোর শোকের মাঝেও শেষ সম্বল নিয়েই ঈদ পালন করে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার কথা জানালেন কৃষকরা।

ঈদে পরিবারের বড়দের বেশিরভাগের নতুন জামা না জুটলেও শিশুদের জন্য সাধ্যমতো নতুন পোশাক আর ঈদের বাজার করেছেন সবাই। গ্রামের একমাত্র দর্জি শাকিল আহমেদের ব্যস্ততা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে কিছুটা কম হলেও শেষ মুহূর্তে থেমে নেই তার সেলাই মেশিন।

সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের রংচি গ্রামের দর্জি শাকিল আহমেদ শেষ দিকে এসে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন সেলাই মেশিনে। ছবি: দ্বোহা চৌধুরী/স্টার

ভারতের মেঘালয়ে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে গত ৩০ মার্চ থেকে শুরু হওয়া আগাম বন্যায় তলিয়ে যেতে শুরু করে সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল। কোথাও কাজের বিনিময়ে টাকা প্রকল্পের আওতায় বানানো ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে গিয়ে, কোথাও বাঁধ উপচে হাওরে পানি ঢুকেছে।

সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার রংচি গ্রামের একপ্রান্তে মাঠের শেষ যেখানে টাঙ্গুয়ার হাওরের শুরু। এই হাওরেই ডুবেছে এই গ্রামসহ আশেপাশের অনেকগুলো গ্রামের কৃষকের ধান। ছবি: দ্বোহা চৌধুরী/স্টার

গত ২ এপ্রিল ভেঙে যায় টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালি বাঁধ। টাঙ্গুয়ার হাওর রামসার কনভেনশনে সংরক্ষিত এলাকা হওয়ায় এই হাওর এবং অন্তর্ভুক্ত বিলে চাষ হওয়া ধান রক্ষায় ছিল না কোনো সরকারি ফসল রক্ষা বাঁধ। তবুও জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় মেরামত করা হয়েছিল পার্শ্ববর্তী তাহিরপুর উপজেলার পুরনো নজরখালি বাঁধ।

এই বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর একে একে তলিয়ে যায় হাওরের অন্তর্ভুক্ত সবকটি বিল। যার মধ্যে রংচি গ্রামের কৃষকদের চাষ করা বিল সোনাডুবি, বান্ধা বিল, মুক্তারখলাসহ অনেকগুলো বিল রয়েছে।

এমনকি এই বাঁধ ভাঙায় মধ্যনগর ও ধর্মপাশা উপজেলা গুরমার বর্ধিতাংশসহ বিভিন্ন হাওর ও বিলে বানানো ফসলরক্ষা বাঁধ ঝুঁকিতে পড়ে। পরবর্তীতে বাঁধ ভেঙে ও পানি উপচে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

রংচি গ্রামের কৃষক মো. গোলাম হোসেন বলেন, 'এবার ঈদের আনন্দ নাই। আমি গতবারের মতো ধান করছিলাম ২০ কিয়ার (৩৩ শতাংশে ১ কিয়ার)। গতবার ধান পেয়েছিলাম ৩০০ মণ। এবার বন্যার পানি ঢুকার পর ২০ মণ ধানও কাটতে পারিনি। তার ওপর ৫০ হাজার টাকা ঋণ আছে। এখন জানি না কী করব।'

আব্দুল হেলিম নামের আরেক কৃষক বলেন, 'সবাই ঋণ করে ধান চাষ করে। ব্র্যাক, আশা, গ্রামীণ ব্যাংক এমন প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অনেকে সমিতি বা মহাজনের কাছে থেকেও ঋণ নেন। এখন ধান নষ্ট হয়েছে, তাই বেশিরভাগ কৃষক জমি বা গরু বিক্রি করে ঋণ শোধ করবে। তারপর সামনের বছর আবার ঋণ করে চাষ করবে। ঈদে আনন্দ যা করার তা করছে সবাই। ঈদের পরেই ঋণ আদায়ে চাপ শুরু হবে।'

কৃষক আব্দুল মনাফ তালুকদার বলেন, 'আমার ১ লাখ টাকা ঋণ আছে। ভাবছিলাম কিছু জমি বেঁচে দেবো। কিন্তু কেউ কিনতে চায় না। যেই জমির ধান ডুবে যায়, সেই জমি কেউ কিনতে চায় না।'

তারা জানান, এই গ্রামে অন্তত ৫ হাজার গরু আছে, যার মধ্যে কৃষকরা এরই মধ্যে ১ হাজার বিক্রি করে দিয়েছেন। গবাদিপশুর খাদ্য সংকটে আর ঋণ মেটাতে বাকি গরুর বেশিরভাগই আগামী কয়েক মাসে তারা বিক্রি করে দেবেন।

আরেক কৃষক খাদিম আলী বলেন, 'ধান যখন যায়, তখন গ্রামের যুবকদের বেশিরভাগই শহরে কাজের খোঁজে চলে যায়।'

এই গ্রামের কৃষকদের দাবি, পরিবেশগত কারণে অনুচিত হলেও ফসল রক্ষায় নজরখালি বাঁধ কাবিটা প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

তারা জানান, এই একটা বাঁধ থাকলে এর ভেতরে ১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিকে দিয়ে বানানো বাঁধের প্রয়োজন হবে না। আর হাওরের পরিবেশগত গুরুত্ব বিবেচনায় রাখলে একটা স্লুইসগেট করা যেতে পারে যাতে পানি বাড়লে কিছুটা বণ্টন করা যায়।

সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এ বছর সুনামগঞ্জ জেলায় বাঁধ ভেঙে ও তলিয়ে গিয়ে ছোটবড় ১৯টি হাওর ও বিল মিলিয়ে মোট ৫ হাজার ৭৭৫ হেক্টর জমি প্লাবিত হয়, যা জেলার মোট আবাদ ২ দশমিক ২২ লাখ হেক্টরের ২ দশমিক ২৫ শতাংশ। টাকার হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ ৭০ কোটি টাকা। মোট ২০ হাজার কৃষক এখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

তবে কৃষক এবং কৃষক অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী প্রকৃত ক্ষতি আরও কয়েক গুণ বেশি।

হাওর ও পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, আমাদের হিসাব অনুযায়ী অন্তত ১৫ হাজার হেক্টর জমি প্লাবিত হয়ে ৫০ হাজার কৃষক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যার আর্থিক মূল্য কোনভাবেই ১৫০ কোটি টাকার কম নয়। কৃষি অধিদপ্তর তলিয়ে যাওয়া ফসলের খোঁজ রাখলেও যেসব কৃষক বন্যার আতঙ্কে আধপাকা ধান কেটেছেন, সেটা কখনো সরকারি হিসাবে আসে না।'

চলতি বছরে বোরো মৌসুমে সুনামগঞ্জের ২ দশমিক ২২ লাখ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলনও হয়েছে ভালো। হাওরাঞ্চলে এপ্রিলের মাঝামাঝি বা বৈশাখের প্রথমে ধান কাটা শুরু হয়। ইতোমধ্যে হাওরের ৯৮ শতাংশ আর উঁচু এলাকার ৪২ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে সুনামগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

তবে হাওরাঞ্চলের ফসলডুবির পরে কয়েক সপ্তাহ কেটে গেলেও এখনও আশ্বাস ছাড়া কোনো সাহায্য পাননি রংচিসহ অনেক গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক। ঈদ উপলক্ষেও তাদের জন্য আসেনি কোনো বিশেষ বরাদ্দ।

এই গ্রাম মধ্যনগর উপজেলার বংশীকুণ্ডা দক্ষিণ ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ড এর অন্তর্ভুক্ত। এই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. নুরুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, 'ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ৪৪০টি পরিবারের তালিকা পাঠিয়েছি। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সাহায্য আসেনি।'

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ইতোমধ্যে পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ২০ হাজার কৃষকের তালিকা তৈরি করেছি৷ আগামী রবি মৌসুমে তাদেরকে কৃষি প্রণোদনায় সার ও বীজ পেতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।'

তবে মন্ত্রণালয় এখনো এই তালিকা চায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা তালিকা তৈরি করে রেখেছি। মন্ত্রণালয় চাইলে পাঠানো হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আগাম কোনো সাহায্যের নির্দেশনা আসলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।

Comments

The Daily Star  | English

Technical education hit by teacher shortage, falling enrolment

Bangladesh’s technical education sector is facing a slow-burning crisis, shaped by a severe shortage of teachers, poor infrastructure, and steadily declining student interest.

10h ago