সিলেট টানতো মুহিতকে, অবশেষে ফিরছেন প্রিয় নগরে

muhit.jpg
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শেষবার সিলেট এসেছিলেন গত ১৬ মার্চ। সেদিন সন্ধ্যায় সিলেটের ঐতিহ্যবাহী চাঁদনীঘাটে আলী আমজদের ঘড়ির সামনে তাকে 'গুণীশ্রেষ্ঠ' সম্মাননায় ভূষিত করেছিল সিলেট সিটি করপোরেশন।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুকে জয় করে ফিরে আসা মুহিত সেদিন সিলেট এসেছিলেন শীর্ণ দেহে কিন্তু ছিলেন প্রাণচঞ্চল। ৪০ মিনিটের দীর্ঘ বক্তৃতায় তিনি স্মৃতিচারণ করেছিলেন তার দেখা প্রিয় শহর সিলেট।

গুণীশ্রেষ্ঠ আবুল মাল আবদুল মুহিত আবারও ফিরছেন তার প্রিয় শহর সিলেটে। তবে এবার তিনি একেবারেই নিথর। শুক্রবার রাত ১১টা ৫৬ মিনিটে ঢাকার একটি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন সাবেক এ অর্থমন্ত্রী।

সম্মাননা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, 'আমি একান্তভাবে সিলেটের মানুষ। সিলেটের পরিবেশেই আমার জন্ম। আমার বেড়ে ওঠা। আমি গর্ব বোধ করি এখানে জন্মে। এখান থেকে অনেক জ্ঞানী-গুণীর জন্ম হবে। আজকে সিলেট নগরে আমি একজন অতিথি। এটা একটা গর্বের বিষয়। নিজের জন্মস্থানে নিজে এমন একটি সম্মান পাওয়া গর্বের।'

মুহিতের ইচ্ছা ছিল তিনি সিলেটে ফিরবেন। গত ২১ মার্চ জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'যেখানেই ছিলাম না কেন বা থাকি না কেন, সিলেট আমাকে খুব টানে। আমি আবার সিলেট যাব।'
এই এপ্রিলেই ঈদের আগে সিলেট আসার কথা ছিল তার। তার পরিবারের সদস্যদেরও তিনি এ কথা বলেছিলেন।

আজ শনিবার গুলশান কেন্দ্রীয় মসজিদে মুহিতের প্রথম নামাজে জানাজা শেষে তার ছোট ভাই সাবেক সচিব ড. একে আবদুল মুবিন বলেন, 'ভাই অসুস্থ থাকাকালীন প্রায়ই বলতেন, আমি এপ্রিলে বাড়ি যাব। তোমরা সবাই আমার সঙ্গে বাড়ি যাবে। বাড়ি গিয়ে আমি বাবার জন্মদিন পালন করবো। আমরা ভাইকে বলেছি—বাবার জন্মদিন তো জুনে। এপ্রিলে কেন তার জন্মদিন পালন করবে? তারপরও তিনি বারবার বলতেন, আমি এপ্রিলেই বাড়ি যাব। তোমরা আমার সঙ্গে যেও।'

ড. মুবিন বলেন, 'আমরা তখন বুঝতে পারিনি, তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন— এপ্রিল মাসেই তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবেন। ঠিক ঠিক সেই এপ্রিল মাসেই তিনি বাড়ি ফিরে চলেছেন।'

ঢাকা থেকে ফ্রিজার অ্যাম্বুলেন্সে তার মরদেহ সিলেট নিয়ে আসা হবে আজ। রোববার দুপুর ১২টায় সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে তার মরদেহ।

জোহরের নামাজ শেষে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে তার শেষ নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। তারপর নগরীর রায়নগরে সাহেব বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হবে।

গত বছরের ২৫ জুলাই করোনায় আক্রান্ত হন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তারপর করোনামুক্ত হলেও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। এর মধ্যে কয়েকবার গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় তাকে।

সর্বশেষ শুক্রবার রাতে আবারও অসুস্থ হলে তাকে দ্রুত ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই রাত ১২টা ৫৬ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

আজ শনিবার সকাল ১১টা ৫ মিনিটে গুলশান কেন্দ্রীয় মসজিদে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তার মরদেহ রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সর্বস্তরের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। দুপুর দেড়টায় জোহরের নামাজ শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তার দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

সংসদ প্লাজায় তার একটি জানাজা আয়োজনের কথা থাকলেও তা অনিবার্য কারণে সেটা স্থগিত করা হয়।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৩৪ সালে সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা।

তিনি ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় তৎকালীন সারা প্রদেশে প্রথম স্থান, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাস করেন।

চাকরিতে থাকাকালে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এমপিএ ডিগ্রি লাভ করেন। মুহিত ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি) যোগ দেওয়ার পর তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার, পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে পরিকল্পনা সচিব এবং ১৯৭৭ সালে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগে সচিব পদে নিযুক্ত হন।

১৯৮১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে তিনি অর্থনীতি ও উন্নয়ন পরামর্শক হিসেবে ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ইফাদে কাজ শুরু করেন। ১৯৮২ সালের মার্চ থেকে ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে তিনি বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে উড্রো উইলসন স্কুলে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মুহিত। তিনি ২ মেয়াদে টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেন এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন।

পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের চিফ ও উপসচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বৈষম্য ছিল তার ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন। সংবিধানের বাধ্যবাধকতা পালনে পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে এটিই ছিল এ বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন। তিনি ছিলেন ওয়াশিংটন দূতাবাসের প্রথম কূটনীতিক এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য মুহিতকে ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়।

লেখক হিসেবেও খ্যাতি ছিল তার। মুক্তিযুদ্ধ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ইতিহাস, জনপ্রশাসন এবং রাজনৈতিক সমস্যাসহ নানা বিষয়ে তার ২২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজের তৃতীয় সন্তান তিনি। তার মা সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরীও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।

Comments

The Daily Star  | English

Palak admits shutting down internet deliberately on Hasina's order

His testimony was recorded by the International Crime Tribunal's investigation agency following a questioning session held yesterday

2h ago