সিলিকন ভ্যালির ‘অমরত্বের’ খোঁজ

ছবি: ওয়ান্ডারফুল ইঞ্জিনিয়ারিং.কম

চীনের এক রাজা তার প্রজাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন অমোঘ এক ঔষধ খুঁজে আনতে, যার থাকবে মৃত্যু বিনাশী ক্ষমতা। এ ছাড়া ষোড়শ শতাব্দীতে ফ্রান্সে অভিজাত শ্রেণির লোকেরা তাদের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির জন্য হজমযোগ্য স্বর্ণ পান করতেন। 

অমরত্ব লাভের চেষ্টা নিয়ে রয়েছে হাজারও গল্প। সুমেরীয় রাজা গিলগামেশ খুঁজে ফিরছিলেন অমরত্ব প্রদানের ক্ষমতা সম্পন্ন এক জাদুকরী গাছ- পেয়েওছিলেন। তবে সেই গাছটি একটা সাপে খেয়ে ফেলে বলে গিলগামেশ তা নিজের কাছে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। চির যৌবন লাভের উদ্দেশ্যে অস্কার ওয়াইল্ডের উপন্যাসের চরিত্র দরিয়ান গ্রে বিক্রি করে দেয় নিজের আত্মা।

সাম্প্রতিক সময়ের অমরত্ব অর্জনের যাত্রা মূলত বিজ্ঞানভিত্তিক ও প্রযুক্তি-নির্ভর এবং এসব যাত্রা পরিচালিত হচ্ছে সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি ধনকুবেরদের দ্বারা। 

ছবি: ট্রাভেলেটেলিয়ার

মৃত্যুকে ধোঁকা, ধনকুবের সব কুশীলব

মানুষ যাতে 'মৃত্যুকে ধোঁকা' দিতে পারে সেজন্য বেশ কয়েকজন টেক বিলিওনিয়ার তাদের অগাধ সম্পদ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। 

বিভিন্ন সাক্ষাৎকার, বই এবং গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, আমাজনের জেফ বেজস, অ্যালফাবেটের ল্যারি পেজ, ওরাকলের ল্যারি এলিসন, প্যালান্টিরের পিটার থিয়েলের মতো সিলিকন ভ্যালির কর্ণধার এবং অসম্ভব ধনী ব্যক্তিরা দীর্ঘায়ু অর্জনের গবেষণায়, উদ্যোগে বিপুল বিনিয়োগ করছেন। 

জেফ বেজস। ছবি: দ্য সান

এমআইটি টেকনোলজি রিভিউয়ের মতে, অ্যাল্টস ল্যাবস নামের নবজীবন লাভের এক উদ্যোগে শীর্ষস্থানীয় ধনকুবের বেজস তার সম্পদের প্রায় ১৯৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছেন। 

ওই বার্ধক্য প্রতিরোধী স্টার্ট-আপে (যা জৈব প্রক্রিয়া মেরামতের জন্য প্রযুক্তি খুঁজে ফিরছে) পুঁজিপতি ইউরি মিলনারেরও বিনিয়োগ আছে বলে জানা গেছে। 

অন্যদিকে, ওরাকলের প্রতিষ্ঠাতা এলিসন বার্ধক্য এবং বার্ধক্যর দরুন সৃষ্ট রোগের গবেষণায় প্রায় ৩৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দান করেছের বলে জানা গেছে নিউইয়র্কারের বরাতে। 

অমরত্বের গবেষণার অন্যতম প্রবক্তা এবং সর্বাপেক্ষা বেশি ভূমিকা রাখা ব্যক্তি হচ্ছেন পেপ্যাল ও প্যালান্টিরের সহপ্রতিষ্ঠাতা পিটার থিয়েল। যিনি ২০১৬ সালে আমেরিকার নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে প্রচারাভিযানেও অংশ নিয়েছিলেন। 

২০০৬ সালে থিয়েল অলাভজনক প্রতিষ্ঠান মেথুসেলাহ মাউস প্রাইজ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বার্ধক্য প্রতিরোধী গবেষণায় ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দান করেছিলেন, যা ২০১৭ তে ছিল ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। 

থিয়েল এবং বেজস উভয়ই সানফ্রান্সিসকো ভিত্তিক ইউনিটি বায়োটেকনোলজি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন বলে জানা যায়। শোনা যায়, এই কোম্পানির মালিক উন্নত বিশ্বের দেশগুলো থেকে মানুষের ৩ ভাগ রোগ বিলীন করে ফেলতে চান। 

এবার আর কোন জাদুকরী গাছ নয়

সিলিকন ভ্যালির ধনকুবেরদের মৃত্যুকে আলিঙ্গন না করার ধারণার কথা শুনে মনে হতে পারে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো কিছু একটা। কিন্তু তারা যেসকল পরীক্ষামূলক পদ্ধতি গ্রহণ করছে সেগুলো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী-নির্ভর চলচ্চিত্র বা উপন্যাসের জনপ্রিয় উপাদান যেমন জারে ডুবিয়ে রাখা মগজ, রেফ্রিজারেটরে থাকা দেহ বা গাড়ির ব্যাটারির সঙ্গে তারে সংযুক্ত হৃদপিণ্ড- এসব থেকে অনেক ভিন্ন কিছু।

অমরত্ব অর্জনে বর্তমান সময়ের বিজ্ঞানী এবং উদ্যোক্তারা কোষের বার্ধক্য প্রতিরোধ থেকে শুরু করে বয়স্কদের শরীরে তরুণ রক্ত প্রবেশের মতো বেশ কিছু কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন। 

তাদের প্রচেষ্টায় শুধু অধিক সময় বেঁচে থাকাই প্রাধান্য পাচ্ছে না বরং সুস্থভাবে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার উপায় বের করা প্রাধান্য পাচ্ছে। 

গুগলের প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিন ও ল্যারি পেজ ক্যালিকো নামের এক গোপন উদ্যোগে বিনিয়োগ করে আসছে শুরু থেকে। ক্যালিকো ইঁদুরের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যেকটা মুহূর্ত, ধাপ নিরীক্ষণ করছে ডায়াবেটিস ও আলঝেইমার্সের মতো রোগের সুনির্দিষ্ট কারণ এবং সামগ্রিকভাবে মৃত্যুর সমাধান বের করার উদ্দেশ্য নিয়ে। 

ছবি: ওয়ান্টারফুলইঞ্জিনিয়ারিং

আরও যেসব অমরত্ব সংক্রান্ত কার্যক্রমে বিনিয়োগ বাড়ছে তার ভেতর আছে ইনসিলিকো মেডিসিন, যা ঔষধ আবিষ্কারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগাতে চায়। 

কিংবা এইজএক্স থেরাপিউটিকসে-  ক্যালিফোর্নিয়াতে মূল অফিস থাকা যেই প্রতিষ্ঠান স্টেম সেল তৈরি করতে চাচ্ছে যা মৃতপ্রায় টিস্যু সমূহকে নতুন করে জীবন দেওয়ার সক্ষমতা রাখে। 

অথবা লাইজেনেসিসে যা এমন প্রযুক্তি তৈরি করতে চায় যেটা প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গের পুনরুৎপাদনে লিম্ফ নোডকে বায়োরিঅ্যক্টর হিসেবে ব্যবহার করে।

মৃত্যুকে ধোঁকা দেওয়ার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকা আরেকটা কোম্পানির নাম সিয়েরা সায়েন্স। এই কোম্পানি টেলোমিয়ার বৃদ্ধি করতে পারে এমন চিকিৎসাকে বেছে নিয়েছে। 

উল্লেখ্য যে প্রতিটি সুকেন্দ্রিক কোষের ক্রোমোসোমের সূত্রকগুলোর প্রান্ত নির্দেশক ডিএনএর  অংশের নাম টেলোমিয়ার এবং প্রতিবার কোষ বিভাজনের সময় এর আকার ছোট হয়ে আসে। আর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বিভাজনের পর টোলেমিয়ারের আকার এত ছোট হয়ে যায় যে, কোষগুলো আর সংখ্যায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না। ফলে শরীরের কোনো কোষ মারা গেলে তাকে প্রতিস্থাপনকারী নতুন কোষ উৎপন্ন হয় না। তাতে করে শরীরে বার্ধক্যের জানান ঘটে। 

'আমরা যদি টেলোমিয়ারকে আমাদের জন্মের সময়কার স্বাভাবিক অবস্থায় নিতে পারি, তাহলে আমরা আমাদের জৈবিক বয়সকে কমিয়ে ২৫ এ নিতে পারি' অমরত্ব নিয়ে কাজ করা কোয়ালিশন অব র‍্যাডিক্যাল লাইফ এক্সটেনশন নামের প্রতিষ্ঠানের পরিচালক জেমস স্ট্রোলের ভাষ্য তাই।  

বায়োভিভাও অমরত্ব নিয়ে কাজ করা আরেকটি বড় প্রতিষ্ঠানের নাম এবং সিয়েরা সায়েন্সের প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি। এই কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এলিজাবেথ হলেন পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি যিনি ২০১৫ সালে টেলোমিয়ার থেরাপি গ্রহণ করেন। ২০১৮ সালে তিনি দাবি করেন যে ট্রিটমেন্টের পর থেকে তার টেলোমিয়ারের বয়স প্রায় ৩০ বছর হ্রাস পেয়েছে এবং তার দেহ ধীরেধীরে তারুণ্য অর্জন করছে।   

অন্যদের দাবি মতে, তারা ইতোমধ্যে প্রাণীদের বার্ধক্য প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছেন। রিজুভেনেট বায়োর প্রতিষ্ঠাতা জর্জ চার্চ বলে যে তিনি ইঁদুরের জীবনকাল দ্বিগুণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এবং এই গোপনীয় প্রতিষ্ঠানটি কুকুরের ওপর একই রকম পরীক্ষা চালাচ্ছে বলে শোনা যায়।  

অন্যদিকে ২০১৮ সালে ক্যালিকোর বিজ্ঞানীদের মোল ইঁদুরের বয়স না বাড়ার আবিষ্কার অমরত্বের সন্ধানকে আরও শক্তিশালী করেছে। 
  
শোনা গেছে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কম বয়স্ক এক ইঁদুরের শরীরের রক্ত বয়স্ক এক ইঁদুরের শরীরে প্রবেশ করানোর পর বয়স্ক ইঁদুরের বয়স কমার 'সাফল্য'।

ইউনাইটেড থেরাপিউটিক্স নামের আরেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে মামুষের ডিএনএ থেকে নতুন অঙ্গ সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে। 

বৃদ্ধপ্রায় কোষ যেগুলো এক ধরনের ফ্যাকাসে, গন্ধহীন বর্জ্য তৈরি করে এবং যা অন্য কোষেও বার্ধক্য বয়ে আনে ও সারা শরীরে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা ছড়িয়ে দেয়, সেই কোষগুলোকে মেরামত এবং কোষের বার্ধক্য প্রতিরোধের জন্য ইউনিটি বায়োটেকনোলজি (যেখানে বেজস ও থিয়েলের বিশাল বিনিয়োগ আছে) এক ধরনের ঔষধ নিয়ে কাজ করছে। 

যেখানে নিশ্চিত সাফল্যের দেখা পাওয়া এখনো লম্বা সময়ের বিষয়, অমরত্ব নিয়ে আশাবাদী ব্যক্তিদের আপাত আশা হচ্ছে বিভিন্ন ঔষধ, থেরাপি এবং অন্যান্য প্রযুক্তিদের সাহায্যে মানুষ অন্তত একশ বছরের সীমানা পেড়িয়ে ২০০, ৩০০ বা আরওবেশি বছর যেন বাঁচতে সক্ষম হয়। 

মুমূর্ষু পৃথিবী, নিঃসীম জীবন 

প্রশ্ন হচ্ছে, অমরত্ব অর্জনের প্রচেষ্টার সুফল সামগ্রিক মানবজাতি নাকি শুধু গুটিকয়েক অত্যন্ত ধনী মানুষ ভোগ করার সুযোগ পাবে? প্রশ্নের উত্তরে মিলছে দ্বিধার উপস্থিতি। 

র‍্যাডিক্যাল লাইফ এক্সটেনশনের পরিচালক জেমস স্ট্রোলের ভাষ্যমতে, অমরত্ব সম্পৃক্ত প্রযুক্তি সমূহ যদি সফলতার মুখ দেখে তবে সেগুলো নিশ্চিতভাবেই অসম্ভব খরচের বিষয় হবে। চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মূল্য কমার সম্ভাবনা থাকলেও সেই সময়ের ভিতর ধনকুবের না এমন অসংখ্য মানুষ অবশ্য মারা যাবে।

সিএনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্স-এর গবেষক এবং কার্যকরী পরার্থপরতা বিশেষজ্ঞ স্টেফান শুবার্ট বলেন, 'শুরুতে প্রযুক্তি শুধুমাত্র ধনীদের আওতায় থাকলেও তা একটা সময়ে সবার নাগালেই পৌঁছায়।' 

শুবার্টের মতামতের পক্ষে দেখা যায় ঔষধ, স্মার্টফোনের সময়ের সঙ্গে মূল্য হ্রাসের দরুন ক্রয় এবং ব্যবহারের ব্যাপ্তির ঘটনা। 

স্কাইপের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগকারী জান ট্যালিনের ধারণা সিলিকন ভ্যালির অমরত্বের খোঁজ শেষমেশ সমগ্র মানবজাতিকেই সাহায্য করবে। তার মতে, অনৈচ্ছিক মৃত্যু নৈতিকভাবে খারাপ তাই সবার উচিৎ অমরত্ব লাভের যাত্রায় অংশগ্রহণ করা। তার ভাষ্য হচ্ছে যে, শুরুর সুবিধা গ্রহণ সব ক্ষেত্রেই একটু খরুচে হয় আর অল্প সংখ্যক মানুষই ঝুঁকি নিয়ে সেই সুবিধা গ্রহণ করে, আপামর জনগণ তা পারে না এবং এই স্বাভাবিক। 

অনেকের চিন্তার কারণ এই হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মানুষ যদি দীর্ঘায়ু অর্জন করে তবে পৃথিবীর সীমাবদ্ধ সম্পদ অচিরেই নিঃশেষ হবে। 

পরিবেশ বিপর্যয়ের এই সময়ে সেজন্য কারও কারও মতে ধনকুবেরদের উচিৎ পরিবেশের মতো বর্তমান পৃথিবীর অন্যান্য চলমান সমস্যা নিরসনে তাদের অর্থ ব্যয় করা, জীবন-আয়ু বৃদ্ধির গবেষণায় না। 

এ ক্ষেত্রে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের অধ্যাপক জন ক্রোক্রফটের মতামত উল্লেখ করা যেতে পারে, তিনি বলেন- 'মুমূর্ষু জগতে অসীম সময় বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই।'

Comments

The Daily Star  | English

Mohakhali blockade halts Dhaka's rail link

Students of Titumir College waged protest to press home their demand for upgradation of their institution as a university

33m ago