মহাকাশের মালিকানা ও বাণিজ্য বিস্তার

মহাকাশের অসীম সম্পদ আহরণে মুখিয়ে আছে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। ছবি: নাসা

স্থলে, জলে ও আকাশে নানা ধরনের লড়াই সম্পর্কে জানলেও মহাকাশযুদ্ধ এখনো সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্র ও বইয়ের পাতায় দেখা যায়। ১৯৬৯ সালে নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের পৃষ্ঠে কেবল অবতরণই করেননি, সেখানে একটা মার্কিন পতাকাও টানিয়ে এসেছিলেন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ৬০টির বেশ দেশ মহাকাশে নিজেদের সরব উপস্থিতি জানান দিয়েছে। 

অনেকে তো আবার নিজেকে বিভিন্ন গ্রহের মালিক হিসেবেও দাবি করেছেন এবং চাঁদে জমি বিক্রিও শুরু করে দিয়েছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশি এক নাগরিক বিবাহবার্ষিকীতে স্ত্রীকে চাঁদে কেনা জমির কাগজ ও হস্তান্তর করেছেন। 

মহাকাশ নিয়ে বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর মাঝে যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তা হয়তো হলিউডের বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্র 'স্টার ওয়ার্স'-এর যুদ্ধের মতো নয়। তেমন কিছুর প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। তবে, এটাও সত্য যে এই বিষয়টা কেবল এখন আর কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ নেই। 

ছবি: সংগৃহীত

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ ইতোমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন ভূমি থেকে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে কক্ষপথের কৃত্রিম উপগ্রহ ধ্বংসের প্রমাণ দিয়েছে। প্রতিরক্ষার নামে মহাকাশে বিভিন্ন দেশের এমন সামরিক উপস্থিতি নিয়ে তাই ভবিষ্যতে একটা মহাকাশ যুদ্ধের শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া কঠিন।

শুধু সামরিক দখলদারিত্ব নয়, বর্তমানে আর্থিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে মহাকাশ। মুক্তবাজারের বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো সরকারবিহীন মহাকাশকে রীতিমতো বাজারে পরিণত করে ফেলেছে। আর এই বাজারকে লক্ষ্য করে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অন্তত ১০ হাজার কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফোর্বসের একটি তথ্যসূত্রে জানা যায়, বর্তমানে এসব কোম্পানির সম্মিলিত বাজার মূল্য ৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

এই অসীম মহাকাশ, সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য নক্ষত্র, গ্রহ-উপগ্রহ ও গ্রহাণুতে থাকা মহামূল্যবান খনিজ সম্পদের মালিক কে? মহাকাশ যুদ্ধের সম্ভাবনা ও ঝুঁকি কতখানি? মহাকাশ নিয়ে কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি আছে কি না? কোনো দেশ এ যুদ্ধের মুখ্য লক্ষ্যবস্তু হতে পারে কি না? মহাকাশ বাহিনী গঠন ও সেখানে অস্ত্রের মজুদ ও ব্যবহারের ফলাফল কেমন হবে এবং আচমকা মহাকাশ অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে ওঠার কারণ নিয়ে থাকছে মহাকাশের মালিকানা ও অর্থনীতি।
 

ছবি: ডেইলি মেইল

মহাকাশের মালিকানা

মহাকাশ অসীম, যার একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ হচ্ছে আমাদের সৌরজগৎ, আর একটা ক্ষুদ্র অংশে আছে পৃথিবী। যে পৃথিবীর অনেক উৎস ইতোমধ্যেই ফুরিয়ে গেছে শুধুমাত্র মানুষের বিলাসী জীবনের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে। উন্নত দেশ ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাই এখন নজর দিয়েছে উন্মুক্ত মহাকাশে। 

ড. ডেনিজ এম হোপ নামে এক ব্যক্তি তো কয়েক কদম এগিয়ে সৌরজগতের সব গ্রহ ও তাদের উপগ্রহের মালিকানাও দাবি করে বসেছেন। চাঁদে জমি বিক্রির জন্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন লুনার অ্যাম্বাসি নামের একটি প্রতিষ্ঠানও। আর সেই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে মাত্র ৪৫ ডলারের বিনিময়ে ২০২১ সালে খুলনার একজন চাঁদের জমি কিনে স্ত্রীকে উপহার দিয়েছেন! 

শুনতে অবাস্তব মনে হলেও এটাই একমাত্র ঘটনা নয়, বিশ্বজুড়ে চাঁদে জমি বিক্রির অনেক ঘটনা আছে। ঘটনার শুরু হয়েছে বেশ কয়েক দশক আগে। আচমকা একজন মার্কিন নাগরিক নিজেকে লুনার অ্যাম্বাসি নামের কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই কোম্পানির প্রধান এবং তার গ্রাহকরা নিজেদেরকে সৌরজগতের সব গ্রহের মালিক দাবি করেছেন। এমনকি সেগুলো রক্ষা করা এবং তা থেকে মুনাফা লাভের ইচ্ছাও পোষণ করেছেন তারা। 

চাঁদে খনন শুরু হলে যেমন দেখাতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

ডয়েচেভেলের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড. ডেনিজ এম হোপের দাবি, ২০০১ সালে সারা পৃথিবী থেকে তার গ্রাহকেরা অন্তত ১ লাখ ৬৩ হাজার ইমেইল পাঠায়। সেখানে তারা জানতে চেয়েছিলেন, পৃথিবীতে থেকে তারা কীভাবে চন্দ্র-দূতাবাসের বিক্রি করা সম্পত্তির রক্ষা করবেন? 

হোপের উত্তরটা ছিল আরও অবিশ্বাস্য, সবকিছু বিবেচনার পর তারা একটা গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং সবশেষে একটা ছায়াপথসংক্রান্ত বা গ্যালাকটিক সরকার গঠন করেন! 

এসব কিছুর শুরুটা হয়েছিল সেই ১৯৮০ সালে। যখন হোপ-এর মাথায় এই উদ্ভট চিন্তাটা আসে। বিবাহ বিচ্ছেদ ও কর্মহীন হোপ চাঁদের বিশালাকার জমির কথা চিন্তা করলেন। চাঁদের প্রায় ১৫ লাখ বর্গমাইলের বিশাল পৃষ্ঠ নিয়ে ব্যবসার পরিকল্পনা করেন তিনি। এ চিন্তা দেখে হোপকে বদ্ধ উন্মাদ ও এসব কাণ্ডকে পাগলামী বলে মনে হতে পারে।

তবে, বর্তমান চিত্র কিন্তু হোপের স্বতন্ত্র ও উন্মত্ত পরিকল্পনার চেয়ে খুব বেশি আলাদা না। চাঁদ ও তার বিভিন্ন সম্পদ ইতোমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নজর কেড়েছে। যার শুরুটা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে চন্দ্রাভিজানের পর থেকে। দ্য ইকোনোমিস্টের একটা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালে মার্কিন কংগ্রেস মহাশূন্যে খননকে বৈধতা দিয়ে একটা আইন পাশ করে।

১৯৬৭ সালে জাতিসংঘের মহাকাশ সম্বন্ধীয় চুক্তিস্বাক্ষর। ছবি: জাতিসংঘ

বিশ্বের প্রথম এমন ধরনের আইন এটি। আমেরিকায় খনিজ সম্পদ আহরণকেন্দ্রিক অসংখ্য প্রতিষ্ঠান আছে, এখন মহাকাশ খনন সংস্থাও প্রতিষ্ঠিত হবে। যারা গ্রহাণুগুলোসহ বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহ খনন করে পানিসহ বিভিন্ন ধাতু উত্তোলন ও তা বিক্রি করতে পারবে। যদিও এখানে বাঁধা হবে জাতিসংঘের মহাশূন্য বিষয়ক এক চুক্তি। যাতে চুক্তিবদ্ধ আছে আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্যসহ ১২৯টি দেশ। আর ওই চুক্তিটি দেখাশোনা করে জাতিসংঘের মহাশূন্য বিষয়ক কার্যালয়।

১৯৬৭ সালে পাস হওয়া এই চুক্তিসূত্রে জানা যায়, মহাকাশকে সমস্ত মানবজাতির দেশ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। মহাশূন্য সব রাষ্ট্র ও মানুষের দ্বারা অনুসন্ধান এবং ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত। কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্র চাঁদ ও অন্যান্য মহাকাশীয় উপাদানকে নিজস্ব সম্পদ বলে দাবি করতে পারবে না। এসব সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে এবং মহাকাশে কোনো মারণাস্ত্র স্থাপন করা যাবে না। 

বিবিসির কাছে এই চুক্তিপত্রকে মহাকাশের সংবিধান বলে উল্লেখ করেছেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের ফেলো ও স্পেস পলিসি জার্নালের সম্পাদক ড. জিল স্টুয়ার্ট। এই চুক্তি ভঙ্গের মতো কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত দেখা না গেলেও মহাকাশকেন্দ্রিক বেগবান হওয়া অর্থনৈতিক কার্যকলাপ শঙ্কার উদ্রেক ঘটায়।

স্পেসেক্সের স্টারশিপ। ছবি: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস

মহাকাশ অর্থনীতি

বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহসহ গ্রহাণুগুলোতে খনন ও খনিজ সম্পদ আহরণ, মহাকাশ পর্যটন, মঙ্গলে বসতি স্থাপনসহ মহাকাশকেন্দ্রিক একটা বিশাল অর্থনীতি ও বাণিজ্য গড়ে উঠতে শুরু করেছে। ইলন মাস্কের স্টারশিপ, স্টারলিংক প্রজেক্টের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনাগুলোর পর থেকেই মূলত মহাকাশ বাণিজ্য হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে। স্টারশিপ প্রজেক্টের মাধ্যমে স্পেসেক্স কেজি প্রতি মাত্র ৫০০ ডলারের বিনিময়ে পৃথিবী থেকে কক্ষপথ ডেলিভারি করতে পারবে। 

যেখানে নাসার স্পেস শাটলে খরচ পড়বে প্রতি কেজি ২০ হাজার ডলার। শুধু মাস্ক-এর স্পেসেক্সই না, মহাকাশ ঘিরে মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে প্রযুক্তি জায়ান্টগুলোও। যার মধ্যে জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন, রিচার্ড ব্রানসনের ভার্জিন গ্যালাক্টিক অন্যতম। এ ছাড়া, চীন, রাশিয়াসহ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের নানামুখী উদ্যোগ তো আছেই। 

সিএনএন বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২৩ সালে নাসার জন্য অন্তত ২৬ বিলিয়ন ডলারের বাজেট চায় বাইডেন প্রশাসন। যা চলতি বছরের বাজেটের চেয়ে অন্তত ৮ শতাংশ বেশি। যা দিয়ে প্রায় ৯টা পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব। 

ছবি: ভার্জিন

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের মতে, ২০১৫ সালে মহাকাশে শুধু বাণিজ্যিক কার্যকলাপের আর্থিক মূল্য ছিল ১১০ বিলিয়ন ডলার। মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে তা ৩ গুণ বেড়ে ২০২০ সালে দাঁড়ায় ৩৫৭ বিলিয়ন ডলারে। মহাকাশে ৪৪৭ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ৮০ শতাংশই ছিল বাণিজ্যিক কার্যকলাপ। ফোর্বস বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে মহাকাশ অর্থনীতি অন্তত ১০ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। 

যেখানে এত বিরাট অর্থনীতি জড়িত সেখানে ক্ষমতার রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হতে খুব একটা সময় নেবে না। এ ছাড়া, বিশ্ব পরাশক্তিগুলো অনুসন্ধান ও প্রতিরক্ষার নামে ইতোমধ্যেই বেশকিছু সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মহাকাশে নানা দেশের সামরিক উপস্থিতিসহ থাকবে এস্যাট ক্ষেপণাস্ত্র, স্যাটেলাইটকেন্দ্রিক পারমাণবিক অস্ত্রের বিকাশ। যা অন্য আরেক দিল আলোচনা করা হবে।

তথ্যসূত্র: 
ফোর্বস, ডয়েচেভেলে, দ্য ইকোনোমিস্ট, জাতিসংঘ, বিবিসি, সিএনএন, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট

 

Comments