হুমায়ুন আজাদ বেঁচে ছিলেন ‘অন্যদের’ সময়ে

হুমায়ুন আজাদ। ছবি: সংগৃহীত

বেঁচে থাকতেই 'প্রথাবিরোধী' লেখকের অভিধা পেয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। বহুমাত্রিকতা ছিল তার লেখক ও ব্যক্তিসত্ত্বার আরেক অলংকার।

এই প্রথাবিরোধীতার পথ মাড়াতে গিয়েই দেড় যুগ আগে জঙ্গিদের চাপাতির নিচে নিজের জীবনকে সঁপে দিতে হয়েছিল এই ভাষাবিজ্ঞানী ও ঔপন্যাসিককে। তার লেখার কারণেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর চক্ষুশূল।

২০০৪ সালে তার 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' উপন্যাসটি প্রকাশিত হলে মৌলবাদীরা তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। আলোচিত ওই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়ে জামায়াতে ইসলাম এ দেশে ব্যাপক যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়েছিল।

পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সেইসময়ে সংসদে দাঁড়িয়ে হুমায়ুন আজাদের এই উপন্যাসটি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিলেন।

গত শতকের আশির দশকের শেষ ভাগে প্রকাশিত 'প্রবচনগুচ্ছ'র এক জায়গায় তীব্র আশাবাদ নিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, 'পৃথিবীতে যতোদিন অন্তত একজনও প্রথাবিরোধী মানুষ বেঁচে থাকবে, ততোদিন পৃথিবী মানুষের।'

কিন্তু হুমায়ুন আজাদ নিজে বাঁচতে পারেননি। লেখার জন্য সাম্প্রদায়িক হুমকি পেতে থাকা এই কবি ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির রাতে বাংলা একাডেমির সামনে হামলার শিকার হন। একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাকে জখম করা হয়।

দেশ ও দেশের বাইরে কয়েক মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর ২০০৪ সালের আগস্টে গবেষণার জন্য জার্মানিতে যান এই লেখক। ওই বছর ১২ আগস্ট মিউনিখে নিজের ফ্ল্যাট থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

এর আগেই বাংলা সাহিত্যের মননশীল এই কবি লিখেছিলেন,

আমি নতজানু হওয়ার বদলে নিগ্রহকে বরণ করেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।

আমি পিঠ কুঁজের বদলে বুকে ছুরিকাকে সাদর করেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।

আমি গলার বদলে হাতেপায়ে শেকল পড়েছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।

আমি অন্যদের সময়ে বেঁচে ছিলাম। আমার সময় তখনো আসেনি।

দেড় যুগ পর রায়, ৪ জঙ্গির ফাঁসি

আজ বুধবার হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আল-মামুন।

রায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ৪ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত।

তারা হলেন—সালাহউদ্দিন সালেহীন, আনোয়ারুল আলম ওরফে আনোয়ার, মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ ও নূর মোহাম্মদ। রায় ঘোষণার সময় মিনহাজ ও আনোয়ার আদালত কক্ষে উপস্থিত ছিলেন।

রায় ঘোষণার আগে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আদালত চত্বরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। জোরদার করা হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে আসামিদের আদালত প্রাঙ্গণে আনা হয় সকাল ৮টার আগেই। পরে রায় ঘোষণার আগে সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে আদালত কক্ষে আনা হয় মিনহাজ ও আনোয়ারকে।

আসামিদের নির্লিপ্ততা

বিচারক দুপুর ১২টার দিকে রায় পড়া শুরু করেন। এ সময় আদালত কক্ষে উপস্থিত ২ আসামিকেই নির্লিপ্ত দেখা যায়। ৫ মিনিটের মধ্যে বিচারকের রায় পড়া শেষ হয়। তবে মৃত্যুদণ্ডের রায় পাওয়ার পরেও ২ আসামির মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

বিচারক আদালত কক্ষ ছেড়ে যাওয়ার সময় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জেএমবি জঙ্গি মিনহাজ সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন, 'সাংবাদিক বন্ধুরা, আপনারা খুশি তো? মনমতো রায় পেয়েছেন তো?'

এ সময় আনোয়ার কোনো কথা বলেননি।

রায় ঘোষণার সময় আদালত কক্ষে হুমায়ুন আজাদের কোনো স্বজন কিংবা আসামি পক্ষের কাউকে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়নি।

'অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ ছিল না'

আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন, 'আসামিরা একটি জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। প্রত্যেক আসামি সংগঠনের নির্দেশে সারা দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর বোমা হামলা চালিয়ে আসছিল।'

'তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য বিভিন্ন মুক্তমনা লেখকের ওপর হামলা চালিয়েছে। বিষয়টি সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।'

আদালত আরও বলেন, 'হুমায়ুন আজাদের মতো একজন বিশিষ্ট লেখকের ওপর হামলা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আসামিরা যে ধরনের জঘন্যতম অপরাধ করেছেন, তা ক্ষমার অযোগ্য। তাই তাদের প্রতি অনুকম্পা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই বিধায় তাদের সবাইকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।'

মামলার পূর্বাপর

হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার পরদিন তার ছোট ভাই মঞ্জুর কবির রমনা থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। মৃত্যুর পর আদালতের আদেশে অধিকতর তদন্তের পর সেই মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক লুৎফর রহমান মামলাটি তদন্তের পর ২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

২০১২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।

মিনহাজ ও আনোয়ার বাদে মামলার অপর ২ আসামি সালাহউদ্দিন সালেহীন ও হাফিজ মাহমুদকে গ্রেপ্তার হলেও ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে তাদের ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা। সে সময় সালেহীন পালিয়ে যান। তবে হাফিজ মাহমুদ পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন। এ ছাড়া মামলার আরেক আসামি নূর মোহাম্মদ শুরু থেকেই পলাতক।

হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ওয়াজে বিষোদগার করা যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে প্রথমে এ মামলার আসামি করা হলেও পরে তার নাম বাদ দেওয়া হয়।

এ মামলায় মিনহাজ ও আনোয়ার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ৫৮ সাক্ষীর মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তাসহ সাক্ষ্য দেন মোট ৪১ জন।

Comments

The Daily Star  | English

Economic expectations: Did govt fall short?

When an interim government was sworn into office following the ouster of the Awami League regime just 100 days ago, there was an air of expectation that the Prof Muhammad Yunus-led administration would take steps to salvage a scam-ridden financial sector and rescue an ailing economy.

7h ago