মুক্তিযুদ্ধ

৫ অক্টোবর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধে ৪ রমজান

ছবি: সংগৃহীত

(পবিত্র কোরআনে রমজানকে রহমতের মাস বলা হলেও, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা এই মাসে বর্বরোচিত গণহত্যা, নৃশংস নির্যাতন-নিপীড়ন, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ চালায়। অন্যদিকে, প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য এ মাসে রণাঙ্গনে প্রাণপণে লড়াই করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। রোজা পালনরত অবস্থাতেই স্বদেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা। মুক্তিযুদ্ধের রমজান মাস কেমন ছিল, তা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজনের তৃতীয় পর্বে আজ রইল ৪ রমজানের ঘটনাপ্রবাহ।)

মুক্তিযুদ্ধের ৪ রমজান পালিত হয় ২৫ অক্টোবর। দিনটি ছিল সোমবার। অন্যান্য দিনের মতো এদিনও গণহত্যা, নির্যাতন ও নৃশংসতা অব্যাহত রেখেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

চতুর্থ রমজানের দিন টাঙ্গাইলের নাগরপুরের গয়াহাটা ইউনিয়নের বনগ্রামে লুটপাট-ধর্ষণ শেষে পৈশাচিক গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই গণহত্যায় শহীদ হন শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ নিরীহ ৫৭ জন গ্রামবাসী। এর আগে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে টাঙ্গাইলের নাগরপুরের গয়াহাটা ইউনিয়নের বনগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গোপনে অবস্থান নেন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল। তাদের সহযোগিতা করেন স্থানীয় গ্রামবাসী।

স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের বিষয়টি জানতে পেরে পাকিস্তানি বাহিনী ২১ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারাও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি এক মেজরসহ ৩ হানাদার নিহত হয়। রোজা পালনরত অবস্থাতেই শহীদ হন ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। এক পর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীও নিজ ক্যাম্পে ফিরে যায়। পরে ২৫ অক্টোবর চতুর্থ রমজানের দিন প্রতিশোধ নিতে হানাদার বাহিনীর বড় একটি দল ফের বনগ্রামে যায়। তারা প্রতি বাড়িতেই লুটপাট চালায়, ১২৯টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। পরে ব্রাশফায়ার করে নিরীহ ৫৭ গ্রামবাসীকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়।

মুক্তিযুদ্ধের চতুর্থ রমজানের দিন কুড়িগ্রামের রাজিবপুর থানার কোদালকাঠি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর গ্রামে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় হামলা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই হামলায় অর্ধশতাধিক নিরীহ সাধারণ গ্রামবাসী শহীদ হন।

চতুর্থ রমজানে সিলেটের গোপালগঞ্জ থানার পশ্চিম আমুড়া ইউনিয়নের সুন্দিশাইলে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পৈশাচিক গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই গণহত্যায় শহীদ হন ২৩ জন নিরীহ গ্রামবাসী।

রণাঙ্গনে চতুর্থ রমজান

চতুর্থ রমজানের দিন সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার মন্দভাগ, মঙ্গলপুর, শ্রীপুরে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি অবস্থানে বিমান হামলা চালায় পাকিস্তানি বাহিনীর ৪টি এফ ৮৬ যুদ্ধবিমান। একইসঙ্গে হানাদার বাহিনীর আর্টিলারিও মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে।

আগের কয়েকদিনের যুদ্ধে ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধারা রোজারত অবস্থাতেই দুর্ধর্ষ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক শেলিং করলেও মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে সেই আক্রমণ অনেকাংশে ভেস্তে যায়। মুক্তিবাহিনী তখন আরও বেশি আক্রমণের জন্য বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যায়। এরপর তারা চতুর্মুখী আক্রমণ গড়ে তুললে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। প্রায় ৩ ঘণ্টাব্যাপী এই সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনী ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৫৮ সেনা নিহত হয়। অন্যদিকে রোজারত অবস্থাতেই অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করে শহীদ হন ২ জন মুক্তিযোদ্ধা। আহত হন আরও ৯ মুক্তিযোদ্ধা।

ফেনীর পরশুরামে মুক্তিযুদ্ধের চতুর্থ রমজানের শেষ রাতে আগেভাগেই সেহরি খেয়ে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল আর্টিলারির সহযোগিতায় হানাদার বাহিনীর চিথলিয়া ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে হানাদার বাহিনীর ২টি জিপ ধ্বংস হয়। আক্রমণের এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুললে ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। হানাদার বাহিনীর ৭ সেনা নিহত হয়।

চতুর্থ রমজানে ইফতারের কিছুক্ষণ আগে খুলনার তালার মাগুরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। এ সময় প্রথমে হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা সুশীল। পরে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে  তুলে সামনে অগ্রসর হতেই শেলের আঘাতে রোজারত অবস্থায় শহীদ হন আকবর ও বকর নামে আরও ২ জন মুক্তিযোদ্ধা।

চতুর্থ রমজানের দিন সিলেটের শাহবাজপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শাহবাজপুর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। ওই সময় সেখানে একদল রাজাকারও অবস্থান করছিল। মুক্তিবাহিনীর হামলায় ৩ রাজাকার নিহত হয় এবং ৮ হানাদার ও রাজাকার আহত হয়।

সিলেটের বিয়ানীবাজারে চতুর্থ রমজানে দুপুরের দিকে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালায়। হানাদার বাহিনীও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে ৮ রাজাকার ও ২ হানাদার সেনাসহ মোট ১০ জন নিহত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের চতুর্থ রমজানের রাতে ৫ নম্বর সেক্টরের সারিগোয়াইন ব্রিজে পাহারারত রাজাকার ও হানাদার পুলিশের ওপর হামলা চালান এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা। এ সময় ৫ রাজাকার নিহত হয়। অন্য রাজাকার ও হানাদার পুলিশ তখন ১টি ৩০৩ রাইফেল ও বেশকিছু গোলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়। পরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা বিস্ফোরক লাগিয়ে ওই সেতু উড়িয়ে দেন।

চতুর্থ রমজানের দিন রাজশাহীতে ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল লালপুর থানা আক্রমণ করে। এ সময় থানার হানাদার পুলিশ আত্মসমর্পণ করে। একই দিনে রাজশাহীর বাঘার মারিয়া ইউনিয়নে ৮ জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার কালীগঞ্জ বাজারে ছিল রাজাকারদের শক্ত ঘাঁটি। এই ঘাঁটি থেকে নিয়মিতই রাজাকাররা নির্যাতন, নিপীড়ন ও লুণ্ঠন চালিয়ে যাচ্ছিল। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনীর একটি বড় দল কালীগঞ্জ বাজারের ক্যাম্পে রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালায়। এই হামলায় ৩০ রাজাকার নিহত হয় এবং ২৫ রাজাকার আহত হয়। আহতদের বেশিভাগই মুক্তিবাহিনীর কাছে ধরা পড়ে। পরে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প থেকে ব্যাপক গোলাবারুদ উদ্ধার করে ক্যাম্পটি পুড়িয়ে দেয়।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র অষ্টম এবং দশম খণ্ড

একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর/ সুকুমার বিশ্বাস

 

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

How a 'Dervish Baba' conjured crores from a retired nurse

Want to earn easy money? Just find someone who thinks their partner is cheating on them, then claim to be a “Genie King” or “Dervish Baba,” and offer solutions to “relationship problems” for a fee

3h ago