অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত দুনিয়ার বিবর্তন

ছবি: সংগৃহীত

মানুষের বিবর্তন নিয়ে আলোচনা আমাদের পেছনের দিকে চোখ ফেরালেও, প্রযুক্তি এবং সংস্কৃতির যে বিবর্তন প্রতিনিয়ত ঘটছে তা মানুষের জেনেটিকের বিবর্তনের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে। বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ডাইনোসর, মানুষের অস্তিত্ব তথা অস্ট্রালোপিথেকাস, হোমো ইরেকটাস, নিয়ান্ডারথালস নয় বরং বর্তমানেও এই পরিবর্তনগুলো কেমনভাবে স্বয়ংক্রিয় হচ্ছে কেমনভাবে পরিবর্তনের ঘটনা ঘটছে এবং ভবিষ্যতে তা কেমন পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে সে বিষয় নিয়েই এই আলাপ।

পৃথিবীর পরিবর্তনগুলো অধিকসময় পূর্বানুমান করা যায় না। তবে ভবিষ্যতে কী ঘটবে সে সম্পর্কে আমরা সাধারণত আমাদের অতীতের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোকে কথা বলি, ধারণা করি। লিখিত উপাদান শেষ যেখানে সেখানেই সাধারণত ঐতিহাসিকরা থেমে যান, কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকরা লিখিত ইতিহাসের উৎস ছাড়াও মানুষের অতীত জীবনের বস্তুগত নিদর্শনকে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণের মধ্য দিয়ে অতীত সমাজ, মানুষের জীবনাচার এবং অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষের জীবনমানের অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তরিত তথ্য-উপাত্ত হাজির করেন।

৬ মিলিয়ন বছর ধরে চলে আসা বিবর্তনের, বিশেষ করে যদি চিন্তা করি তাহলে গত ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন বছর থেকে পাথর সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে এই প্রাগ-ইতিহাসের সূচনার অগ্রগতি হয়েছে সাম্রাজ্য, নগর ও শহরের মধ্য দিয়ে। ১ লাখ বছর ধরে মানুষের কাছাকাছি অন্যান্য যে এপস আছে এরা বিভিন্ন গোত্র উপগোত্রে বিভক্ত হয়েছে। এই বিভক্ত হওয়ার পেছনে সাগর, পাহার-পর্বত, পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের অনুঘটক কোথাও ভিন্ন ধরনের আবহাওয়া, দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস-রুটিন, জীবনধারা তার বিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে।

অঞ্চল ও খাদ্যাভ্যাসভেদে আমরা মানুষের চেহারা আকৃতির গঠনেও বৈচিত্র্য লক্ষ্য করি। বিশেষ করে গত ১০ হাজার বছর ধরে এই বিবর্তন বেশ সক্রিয়। পরবর্তী সময়ে কৃষিভিত্তিক জীবন ও সভ্যতা গড়ে তোলায় এই পরিবর্তন নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এর পরবর্তীতে সভ্যতার উত্থান ও নব নব প্রযুক্তির আবিষ্কার সব মানুষকে আবার পরস্পরের কাছাকাছি করে দিয়েছে।

এই কাছাকাছি হওয়ার ক্ষেত্রে কখনো যুদ্ধের বিজয়, রাজ্যবিস্তার, উপনিবেশ স্থাপন ভূমিকা রেখেছে। কখনোবা ব্যবসাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কারণে একজন মানুষকে আরেক জায়গাতে যেতে উৎসাহিত করেছে। বর্তমানে রাস্তাঘাট, রেল, উড়োজাহাজ, ইন্টারনেট আমাদেরকে আবার পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত করেছে।

নবোপলীয় সংস্কৃতিতে কৃষিভিত্তিক জীবন ব্যবস্থায় মানুষ যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী বসতি গড়েছে। ফলে নির্দিষ্ট কিছুদিন পরিশ্রম করে পরবর্তী দিনগুলোতে শুয়ে বসে আরামে দিন কাটাত। যা মানুষের হাড়ের ঘনত্ব কমিয়ে এনেছে। এখন বর্তমান সময় আমরা অনেক বেশি ডেস্কে বসে সময় পার করি, যা হয়ত আমাদের এই হাড়ের ক্ষয়মান আরও চলমান রাখবে। অন্যান্য এপ বা বানর প্রজাতির সাথে মানুষের কল্পনা করলে মানুষের মাসেলও কমে আসছে। বিশেষ করে আমাদের শরীরের উপরের।

আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রাণী শিকার, শিকড় খনন করতে হতো, পরবর্তীতে তারা খেত খামারে খনন ও ফসল কাটত। কিন্তু বর্তমান চাকরি বলতে মানুষের সাথেই মানুষের বোঝাপড়া, শব্দের ব্যবহার, কোডিং এর ব্যবহার। এতে ব্রেইনের ওপর প্রেসার বাড়লেও শরীরের উপর বাড়ছে না। একথা কৃষক, মৎস্যজীবী, কাঠুরের বেলায়ও প্রযোজ্য। তারাও কাজের সহযোগিতায় মেশিন নির্ভর হচ্ছে। ট্রাকটর, হাইড্রোলিকস, চেইনশ এর উপর ভিত্তি করে তাদের কাজগুলো সম্পাদন করছে। বর্তমানে শারীরিক শক্তির খুব একটা প্রয়োজন নাই, পেশীর ব্যবহার কমে যাওয়ায় আমাদের পেশীও হয়ত অদূর ভবিষ্যতে সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। আমাদের চোয়াল এবং দাঁতও ছোট হয়ে আসছে। আগের তৃণভোজী মানুষের লতাপাতা ঘাস খেতে গিয়ে পেষণ দাঁত ও চোয়ালের ব্যবহার বেশি হতো, এরপর থেকে যখন মাংসভোজীতে ফিরল তখন রান্নাবান্নার কারণে দাঁত ও চোয়াল সঙ্কুচিত হয়ে এলো। বর্তমানে প্রস্তুতকৃত খাবার- চিকেন বল, চিকেন নাগেট, বার্গার, আইসক্রিম এগুলো খেতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় আমাদের চিবিয়ে খাওয়ার প্রয়োজন কমে গেছে। চোয়ালও চিকন হয়ে আসছে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের দাঁত ও দাঁতের শক্তি কমে আসছে।

আমাদের দাদা-দাদী যখন ৫০ মাইল দূরে গিয়ে বন্ধু বা স্বজনের সঙ্গে দেখা করত, এখন আমরা ৪০০০ মাইল দূরে গিয়ে স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। বর্তমান বিশ্বায়নে আমরা পৃথিবীর নানাপ্রান্তে নানা ধর্মের, বর্ণের, গোত্রের মানুষদের সঙ্গে দেখা করি, যা একধরনের নতুন হাইব্রিড জেনারেশন তৈরি করছে। আফ্রিকান, আমেরিকান, ইউরোপিয়ান, এশিয়ান, অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে সংযোগ ঘটাচ্ছে। যা কিনা পরবর্তীতে আমাদের বিবাহিত জীবনের মধ্য দিয়েও বিবর্তন ঘটাবে।

কিছু বিজ্ঞানীরা মনে করছেন পৃথিবী আজ সভ্যতার সর্বোচ্চ শিখরে ধাবিত হচ্ছে। অতীতে যে অনুঘটকরা শক্তি, ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিল, বিশেষ করে- দূর্ভিক্ষ, মহামারী, যুদ্ধবাজ শিকারী প্রাণীদের মধ্যে সিংহ, নেকড়ে, মেছো বাঘ এরা এক সময় দাপুটে থাকলেও এখন প্রাণীগুলো সেই ক্ষমতা হারিয়েছে।

বর্তমানে সারের প্রয়োগে খাদ্য-শস্যের ব্যাপক উৎপাদন হচ্ছে। এর ফলে ক্ষুধা এবং দূর্ভিক্ষ অনেকটা পৃথিবীতে কমে এসেছে। পরিবার পরিকল্পনা বেড়েছে। তুলনামূলক ভায়োলেন্স ও যুদ্ধাবস্থা কমে এসেছে আগের সময়ের তুলনায়। মহামারী, গুটিবসন্ত, কালো জ্বর, কলেরার প্রতিষেধক হিসেবে ভ্যাকসিন, আ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়েছে। বেড়েছে পরিস্কার পানির ব্যবহার।

এর মধ্য দিয়ে বিবর্তন কিংবা পরিবর্তন থেমে যায়নি বরং তা প্রাকৃতিক দূর্যোগ কিংবা সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি দিলেও অপরদিকে আমাদের নিজেদের তৈরি করা কৃত্রিম পরিবেশ- সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, শহর এগুলো আবার আমাদের নতুন সংকট তৈরি করছে। মানুষের গড়া এই নতুন কৃত্রিম বিশ্বের সাথে মানুষেরই আবার নতুন করে খাপ খাওয়াতে হচ্ছে।

এটি আমাদের জানান দিচ্ছে যে বরফযুগ আন্তবরফ যুগের মতো এই সময়ে মানুষের তৈরি করা পৃথিবীতে মানুষকে আবার নতুন করে অভিযোজিত হতে হবে। এর প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, আমাদের খাদ্যভ্যাস শস্য, দুগ্ধ যেগুলো খাই সবই প্রসেস ফুড খাওয়া প্রাণীদের মাধ্যমে, যা খেয়ে আমরা বেড়ে উঠছি। জনসংখ্যার ঘনত্বে রোগবালাই বাড়ছে, কিছু কিছু কারণে আমাদের ব্রেইনের আকারও ছোট হয়ে আসছে। কৃত্রিম পরিবেশ আমাদের ন্যাচারাল সিলেকশন এর ভূমিকায় আবর্তিত হচ্ছে।

আমাদের ও অন্যান্য প্রাণীদের মস্তিস্ক ছোট হয়ে আসছে। ইউরোপে যদি আমরা দেখি তাহলে ১০ হাজার-২০ হাজার বছর আগে যখন কিনা কৃষির বিকাশ ঘটেছে তখন থেকে আমাদের মস্তিস্ক ছোট হতে শুরু করেছে। আমাদের প্রাচীন মানুষদের চেয়ে বর্তমান সময়ের মানুষদের মস্তিস্ক আরও ছোট হচ্ছে। কিন্তু কেন এমনটি হচ্ছে তা এখনও স্পষ্ট না। এমন হতে পারে ফ্যাট এবং প্রোটিনের ঘাটতি যেটি একসময় ছিল, পরবর্তীতে চাষাবাদে ফেরার কারণে বড় মস্তিস্ক ছোট হয়ে আসছে। ব্রেইনের ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন ২০ শতাংশ ক্যালরি ক্ষয় করে।

সভ্যতায় এসে শিকারি মানবদের মতো মানুষের আর শিকার করার জন্য লড়াই করতে হয়নি, গাছ থেকে ফলমূল খুঁজতে হয়নি। তীর ধনুক এর সূক্ষ্ম ব্যবহার করতে হয়নি, ফাঁদ খুঁজতে হয়নি, ফলে যখন আমরা শিকার করা ছেড়ে দিয়েছে তখনই বোধ হয় মানুষের ব্রেইনের আকার ছোট হয়ে এসেছে। পাথর যুগের মানুষের বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠতে হতো- শিকারি, ট্র্যাকিং, তন্ন তন্ন করে গাছের মূল খোঁজা, হারবাল মেডিসিন ও বিষ তৈরি করা, হস্তশিল্প, যুদ্ধ করা, ম্যাজিক ও গানের চর্চায় তাদের দক্ষ হতে হতো। সে হিসেবে বর্তমান মানুষদের দক্ষতার পরিসর সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ে তাদের বড় ধরনের সময় ব্যয় হচ্ছে, শারীরিকভাবে পরিশ্রম করতে হয় এমনটি কমে গেছে। বর্তমান সভ্যতায় আমরা সবাই ব্যবসা নির্ভর হয়ে পড়ছি, এরপর আমরা অন্যকিছু করছি।

গত দুই শতকে পুষ্টি, ওষুধ, স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন করায় উন্নত দেশগুলোতে যুবকদের মৃত্যুহার ১ শতাংশে নেমে এসেছে। পুরো বিশ্বজুড়ে গড় আয়ু ৭০ বছর যেটি উন্নত দেশে ৮০ বছরে পৌঁছেছে। এটি সম্ভব হয়েছে স্বাস্থ্যসুরক্ষার কারণে, বিবর্তনের কারণে নয়। কিন্তু এই ঘটনাটি বিবর্তনে ভূমিকা রাখছে।

অস্ট্রালোপিথেকাস আফরেনসিস এবং হোমো হ্যাবিলিস আকারে ছিল ছোট, উচ্চতায় ৪-৫ ফিট। পরবর্তীতে হোমো ইরেকটাস, নিয়ান্ডারথালস, হোমো স্যাপিয়েন্স তাদের উচ্চতা বেশি দেখি, ঐতিহাসিক যুগে এ উচ্চতা আমরা আরও বাড়তে দেখি, এর পেছনে অনুঘটক হিসেবে পুষ্টির একটা বড় ভূমিকা আছে।

কেন এমনটি বাড়ছে, এই পুরো ব্যাখ্যাটা এখনও পরিস্কার নয়, তবে দীর্ঘ জীবন মানুষের গ্রোথ বাড়াতে ভূমিকা রাখে। কিন্তু এক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ উভয়ের ভূমিকা আছে। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আকৃতিতে বড় মানুষদের পাওয়া যায় ইউরোপে, যারা কিনা নিয়ান্ডারথাল বংশধরদের প্রতিনিধিত্ব করছে। এদের পুরুষদের গড় উচ্চতা ৬ ফিট, মেয়েদের ৫ ফিট ৬ ইঞ্চি। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে মানুষ আরও বেশি লম্বা হতে পারে।

সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনও আমাদের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। শিকারি মানুষেরা একসাথে হাজারখানেক বসবাস করত। এখন এক একটা শহরে লাখ লাখ মানুষ বসবাস করে। অতীতে আমাদের সম্পর্ক পরস্পরের কম ছিল হয়ত, একবার দেখা হলে সারা জীবনে আর দেখাও হতো না। কিন্তু বর্তমানে ভার্চুয়াল জগত, চাকরির জগত মিলে হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন সম্পর্ক। বর্তমান সমাজ আমাদেরকে পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত করছে। প্রত্যেকেই যে মানসিকভাবে এই বর্তমান পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে বিষয়টি তেমন নয়। তবে আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি পাথরযুগের মানুষের চেয়ে অনেক বেশি ভয় ও প্রত্যাশা বাড়িয়েছে।

আধুনিক সমাজে আমরা বস্তুগত উপাত্ত নিয়ে আমাদের মস্তিস্ক বিভোর, কিন্তু মানসিকভাবে আমাদের অবস্থা যে কোনো সময়ের চেয়ে খারাপ। যার কারণে বর্তমান মানুষ অনেক বেশি নিঃসঙ্গতা অনুভব করে, দুশ্চিন্তা, হতাশা অনুভব করে। নেশা মাদকে জড়িয়ে যায়। মানসিকভাবে সবাই খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে এতে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে বেশি।

একটা সময় পৃথিবীতে মানুষের কাছাকাছি ৯ ধরনের প্রজাতি ছিল, বর্তমানে আমরাই। ভবিষ্যতে কী হবে?

যদি মানুষ সাংস্কৃতিকভাবে আলাদা হয়, ধর্ম, শ্রেণি, জাত, এমনকি রাজনীতিও মানুষকে আলাদা করতে পারে। এইচ.জি ওয়েলস তার উপন্যাসে লিখেছিলেন, ভবিষ্যতে শ্রেণিভিত্তিক মানুষের বিবর্তন ঘটবে। উচ্চবিত্তকে দেখতে সুন্দর দেখাবে, নিম্নবিত্তকে দেখাবে কুৎসিত।

অতীতে আমরা দেখেছি ধর্ম ও জীবনধারা মানুষকে জেনেটিক্যালি পার্থক্য করেছে। উদাহরণ হিসেবে ইহুদি ও জিপসি পপুলেশনকে বলা যায়। বর্তমানে রাজনীতি আমাদেরকে পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা করে দেয়। উদারমনা মানুষ আরেকজন উদারমনার কাছে যায়। রক্ষণশীল যায় রক্ষণশীলের কাছে। সংস্কৃতি যত বৈচিত্র্যময় হবে মানুষ জেনেটিকভাবে তত বেশি বৈচিত্র্যময় হতে পারে।

ভবিষ্যত সম্পর্কে দ্য কনভারসেশন এ প্যালিওঅনটোলোজিস্ট-ইভোলশনারি বায়োলোজিস্ট নিকোলাস এর প্রকাশিত আর্টিকেলে তিনি এ বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করেছেন। তিনি ধারণা করেছেন ভবিষ্যতে মানুষ হয়ত আরও বেশি লম্বা হবে, আয়ু বাড়বে, কম আক্রমনাত্মক হবে, হাসি-খুশি থাকবে, আমরা হয়ত পরস্পর বন্ধুভাবাপন্ন হবো, কিন্তু দিন দিন হয়ত ব্রেইন সাইজ কমে আসবে।

বর্তমান দুনিয়ায় মানুষ বেশ কিছু বিষয়ের মুখোমুখি হয়েছে যে বিষয়ে তার অতীত অভিজ্ঞতা ছিল না। ওয়াদ্দাহ খানফার তার লেখায় এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো - 'স্থানের' সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। ইন্টারনেট এবং সোস্যাল মিডিয়া এসে 'স্থান' সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে দিয়েছে। এখন মানুষ একই সময়ে ভৌগোলিক স্থানের পাশাপাশি বৈশ্বিক জায়গাতেও রয়েছে।

এরপর আরেকটি পরিবর্তন দেখা যায় ব্যক্তি ও শাসন ক্ষমতার মাঝে। এখন ভৌগোলিক সীমার উর্ধ্বে বিস্তৃত ইন্টারনেট দুনিয়া যে কাউকে বয়সের গন্ডিতে আটকে না রেখে ইন্টারনেটের প্রশস্ত পরিসরের নিয়ে এসেছে, তার সামনে নব নব দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। এখন তাকে চাকরির পদ, গোত্রীয় পরিচয়, সামাজিক অবস্থান এমনকি তার প্রাচুর্য কোনো কিছুই বেধে রাখতে পারে না। আর ইন্টারনেট দুনিয়া প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্বের চেয়ে ব্যক্তি নেতৃত্বের বিকাশ বেশি করে।

শিক্ষার ক্ষেত্রেও বিপ্লবসাধিত হয়েছে। জ্ঞান ও তথ্যের অভূতপূর্ব সরবরাহ হয়েছে। বিভিন্ন প্লাটফর্ম থেকে খুব সহজেই দেশ বিদেশের গবেষণালদ্ধ জ্ঞান নেওয়ার সুযোগ ঘটেছে। এ সময়ে এসে প্রাকৃতিক ও মানবীয় জ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক জুড়েছে। বস্তুগত পরিস্থিতি থেকে ধীরে ধীরে জ্ঞান ও তথ্যমুখী হয়েছে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভাবনীয় অগ্রগতি, জ্ঞানের সার্বজনীনতা এবং সাধারণ মানুষের মাঝে তার বিকাশ, নানা বিশেষায়িত জ্ঞানের সমন্বয়, অ্যাকাডেমিক আর্টিকেলের ক্ষেত্রে জাতীয় ভূমিকা ও অবদান-এসবই মানুষের অগ্রগতির এক অভূতপূর্ব পথ খুলে দিয়েছে। মানুষের মাঝে নতুন নীতি ও গুরুত্ব তৈরি করেছে।

অন্যতম আরেকটি পরিবর্তন হলো- বস্তুর সাথে প্রাণের যোগ, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আবিস্কার যেমন ন্যানো টেকনোলজি, বায়োলজিক্যাল টেকনোলজি, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেমোরি সংরক্ষণ, সাইকোলজিক্যাল নানা গবেষণাপত্র, পশু এবং মানুষের জীন আবিষ্কার, রোবট এবং কৃত্রিম অস্তিত্ব তৈরিতে তার সক্ষমতা ইত্যাদি। এই ধরনের স্রোতগুলোর সাথে মানুষের আগে পরিচয় ছিল না। দর্শন ও গবেষণার কারণে চলমান বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার মাধ্যমে কিংবা এই বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়েছে। আর এখান থেকেই বাস্তবতা এবং চিন্তার দূরত্ব ব্যাপক হয়ে পড়েছে। এখন আমাদের চিন্তা ও বাস্তবতার মাঝে ফারাক বিশাল পরিখা সমান। বায়োজেষ্ঠ্য মানুষ এ পরিবর্তন না ধরতে পারার কারণে মেন্টরের ভূমিকায় থাকতে পারছেন না।

এই পুরো প্রক্রিয়া অনুধাবন করে অতীত সাপেক্ষে ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য ইতিহাসের সাথে আমাদের সম্পর্কটা নতুন করে ফিরিয়ে আনা দরকার। তবে মাথায় রাখতে হবে ইতিহাসের যোগই হলো প্রাচীন দুনিয়ার সাথে, তা আর কখনো ফিরিয়ে আনা যাবে না তবে অতীত থেকে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা নেওয়া যাবে।  সুতরাং আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত বোধ ও চিন্তা গড়তে হলে তা হতে হবে অতীতকে আমলে নেওয়ার মধ্য দিয়েই। সার্বিক বিবেচনায় ভবিষ্যত বিবর্তন, পরিবর্তনের বিষয়ে আমাদের নতুন ও উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা ও সিলেবাস গড়ে তোলা উচিত। যেখানে বর্তমানের এই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে যে অভূতপূর্ব বিশ্বব্যবস্থার মুখোমুখি সেটি স্থান পাবে এবং একই সঙ্গে আমাদের স্বপ্ন ও মূল্যবোধ উন্নত করার জন্য এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়ক হয় তেমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে দেওয়া উচিত যেখানে বস্তুর সাথে প্রাণের মেলবন্ধন ঘটবে। মনুষত্ব, মানবিকতা চারিত্রিক মাধুর্যের বিকাশে প্রযুক্তির ব্যবহার হবে।

 

মুতাসিম বিল্লাহ: শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

mutasim.b@cou.ac.bd 

Comments

The Daily Star  | English

$14b lost to capital flight a year during AL years

Bangladesh has lost around $14 billion a year on average to capital flight during the Awami League’s 15-year tenure, according to the draft report of the committee preparing a white paper on the economy.

10h ago