লিবিয়ায় বাংলাদেশি সাংবাদিক ও প্রকৌশলী নিখোঁজ

সাংবাদিক জাহিদুর রহমান ও প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম (বাঁ দিক থেকে)। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা থেকে লিবিয়ায় যাওয়া বাংলাদেশি সাংবাদিক জাহিদুর রহমান গত ৫ দিন ধরে নিখোঁজ আছেন। ঢাকার সাভার এলাকার বাসিন্দা জাহিদুর রহমান (৪৮) এনটিভির বিশেষ প্রতিনিধি।

জাহিদের সঙ্গে থাকা লিবিয়ার বাংলাদেশি প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম ও তাদের লিবিয়ার গাড়িচালক মোহাম্মদ খালেদও একই সময় থেকে নিখোঁজ।

জাহিদের পরিবার বলছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে তাদের অপহরণ করা হয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছেন।

তবে, লিবিয়ায় থাকা প্রকৌশলী সাইফুল ইসলামের পরিবারের ধারণা, ত্রিপলিতে যেহেতু মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণ কম কাজেই ক্ষমতাসীন সরকারের কোনো বাহিনীর কেউও তাদের ধরে নিয়ে যেতে পারে।

অবশ্য লিবিয়ার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল এস এম শামিম উজ জামান গতকাল রাতে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তারা এখন ধারণা করছেন কোনো মিলিশিয়া গ্রুপই তাদের ধরে নিয়ে যেতে পারে।'

লিবিয়ার ত্রিপোলিতে সাংবাদিক জাহিদুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

গত ২১ মার্চ লিবিয়ায় যান জাহিদুর। তার স্ত্রী তাসলিমা রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২৩ মার্চ দুপুরে আমাদের সঙ্গে তার সর্বশেষ কথা হয়। এরপর থেকে তার ফোন বন্ধ। আমরা প্রথমে বিষয়টি বুঝতে পারিনি। ২৪ ঘণ্টা পর অনেকেই আমাদের জানাতে থাকেন তার সঙ্গে অনলাইনে বা ফোনে যোগাযোগ করতে পারছেন না। তার ফোন  কখনো বন্ধ থাকে না। আমার তখন উদ্বিগ্ন হই। ২৪ ঘণ্টা পর আমরা প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমানকে জানাই। তিনি পরে খোঁজ নিয়ে জানান- তিনি যে হোটেলে ছিলেন সেই কোরিনথিয়া হোটেলে ফেরেননি।'

জাহিদুর রহমান অবশ্য ২৩ মার্চ দুপুর ১টা ৪৯ মিনিটে কোরিনথিয়া হোটেল থেকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এরপর থেকে তার কোনো পোস্ট পাওয়া যায়নি। তিনি আর ফেসবুকে সক্রিয় ছিলেন না। জাহিদুর রহমান এনটিভির বিশেষ প্রতিনিধির পাশাপাশি সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরও পরিচালক। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।

তাসলিমা রহমান জানান, প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে দূতাবাস থেকে খোঁজ জানাতে বলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পরে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করা হয়। এরপর তারা জানতে পারেন জাহিদুর রহমানকে কে বা কারা অপহরণ করেছে। পরে এনটিভি থেকেও আমাদের এটি জানানো হয়।

জাহিদুর রহমানের ছেলে ফারহান আসিফ রহমান একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাবাকে নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আমাদের বলা হয়েছে যদি লিবিয়ার পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তাহলে পাওয়া যাবে। গতকালও আমরা এনটিভি থেকে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য গিয়েছিলাম। তারা বলছে দেখছে।'

লিবিয়া যাওয়ার বিষয়টি আগে থেকে জানতে কী না জানতে চাইলে তার ছেলে বলেন, 'বাবা যেদিন লন্ডন গেলে সেদিন জানালো লিবিয়া যাবে।'  

২২ মার্চ দুপুরে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির ময়দানে সোহাদা নামে পরিচিত গ্রিন স্কয়ারে গিয়ে একাধিক ছবি তোলেন। সেখান থেকে তিনি লেপসিস ম্যাগনা এলাকায় যান। গ্র্রিন স্কোয়ারে লিবিয়ায় জাতীয় পতাকা হাতে এক বৃদ্ধের সঙ্গে তিনি একাধিক ছবিও পোস্ট করেন নিজের ফেসবুকে। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশি প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম টিপু এবং তাদের লিবিয়ান গাড়িচালক মোহাম্মদ খালেদ।

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, গাদ্দাফির সময় এই এলাকাটি গ্রীন স্কয়ার নামে পরিচিত ছিল। তবে, ২০১১ সালের ২১-২২ আগস্ট লিবিয়ার বিদ্রোহীরা এই জায়গার নিয়ন্ত্রণ নেন। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিহতদের স্মরণে তারা এই জায়গাকে শহীদদের স্মরণে মার্টিয়াড স্কয়ার নাম দেন। এখানে গিয়ে লিবিয়ার পতাকা হাতে ছবি তোলার পরপরই সরকারি লোকজনের সন্দেহ হয়। এসবের জের ধরে কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হতে পারে।

জাহিদুর রহমানের সঙ্গে থাকা প্রবাসী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম টিপুর বাবা দারুল ইসলাম গতকাল বিকেলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, 'ঢাকা থেকে জাহিদুর রহমান নামে একজন সাংবাদিক আসেন। তাকে নিয়ে আমার ছেলে টিপু ও লিবিয়ান ড্রাইভার খালেদ বের হন। ২৩ মার্চ থেকে তারা নিখোঁজ। লিবিয়ায় নানা সংকট থাকলেও ত্রিপলিতে মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণ নেই। ড্রাইভার খালেদ তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমরা ধারণা করছি সাংবাদিক জাহিদুর রহমান বিভিন্ন স্থানে গিয়ে ছবি তোলায় তাকে হয়তো সরকারের কোনো বাহিনী ধরে নিয়ে যেতে পারে। রোববার রাষ্ট্রদূতসহ দূতাবাসের কর্মকর্তারা বের হয়ে নানা জায়গায় খোঁজখবর শুরু করেছেনে। দেখা যাক কী হয়।'

যুদ্ধাবস্থার কারণে লিবিয়ায় অনেক বছর ধরে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানো বন্ধ ছিল। তবে, গতমাসে লিবিয়ায় কর্মী পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু, এখনো কর্মী যাওয়া শুরু হয়নি। সাংবাদিক জাহিদ অবশ্য ঢাকা থেকে লিবিয়ার ভিসা নিয়ে গিয়েছেন।

পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, গত ৩ মার্চ সাংবাদিক জাহিদ তার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে পারিবারিক ভিসা নিয়ে লন্ডনে যান। সেখান থেকে আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ঘুরে ২১ মার্চ তিনি লিবিয়ায় পৌঁছান। পরদিন ২২ মার্চ তিনি নিজের ফেসবুকে ত্রিপোলী থেকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে জানান, গৃহযুদ্ধ কবলিত দেশটিতে প্রবেশ ছিল রীতিমতো বেশ চ্যালেঞ্জের। লন্ডনে যাওয়ার আগেই বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ঢাকা থেকে ভিসা সংগ্রহ করেন। অবশ্য লন্ডন থেকে জাহিদুর রহমানের একাধিক রিপোর্ট এনটিভিতে প্রচার হয়েছে।

জাহিদুরের নিখোঁজের বিষয়ে জানতে চাইলে এনটিভির হেড অব নিউজ জহিরুল আলম গতরাতে বলেন, 'আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি।'

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল এস এম শামিম উজ জামান গতকাল রাতে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম সরকারের কোনো সংস্থা তাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। এখন মনে হচ্ছে তাকে কোন মিলিশিয়া গোষ্ঠীও ধরে নিয়ে যেতে পারে। আমরা এখনো ঠিক নিশ্চিত নই। তবে, ২৩ মার্চ কোন জায়গা থেকে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেটি আমরা এখন মোটামুটি জানতে পেরেছি। ত্রিপোলিতে সাংবাদিক জাহিদুর রহমান নানা জায়গায় ছবি তুলছিলেন। এখানে ছবি তোলা নিষেধ। এটি একটি বড় কারণ। বিষয়টি নিয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন।'

প্রকৌশলী সাইফুল ইসলামের বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, 'তাদের ৩ জনকে একসঙ্গে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে, ইতোমধ্যে আমরা জানতে পেরেছি গাড়ির চালক তার পরিবারকে ফোন করেছিলেন। তাদের সম্ভবত এখন আলাদা করে রাখা হয়েছে। যাই হোক তাদের উদ্ধারের জন্য আমরা আমাদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আপনারা দোয়া করেন। এটা আমাদের জন্য এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ।'

শরিফুল হাসান, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। 

Comments