প্রত্যক্ষদর্শী এক শহীদজায়ার স্মৃতিতে জগন্নাথ হল গণহত্যা
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নৃশংস গণহত্যা চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। এই গণহত্যায় শহীদ হন জগন্নাথ হলের নৈশপ্রহরী সুনীল চন্দ্র দাস।
সুনীল চন্দ্র দাসের স্ত্রী বকুল রাণী দাস জগন্নাথ হল গণহত্যার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী। ওই গণহত্যার শহীদজায়াদের মধ্যে একমাত্র তিনিই বেঁচে আছেন। সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন বকুল রাণী দাস। তার কথায় উঠে এসেছে ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর পৈশাচিকতা ও বর্বরতা।
বকুল রাণী দাস বলেন, 'আমার স্বামী সুনীল চন্দ্র দাস ছিলেন জগন্নাথ হলের নৈশপ্রহরী। তখন জগন্নাথ হলের পূর্বদিকে ছিল টিনশেডের একটি ছাত্রাবাস। তার পাশে একটা কামরায় আমরা আমাদের ২ সন্তান নিয়ে থাকতাম। আমার ছোট ছেলেটার বয়স তখন দেড় মাস আর বড় মেয়েটার বয়স আড়াই বছর।
২৫ মার্চ রাত ১০টার দিকে আমার স্বামী প্রতিদিনের মতো ডিউটির জন্য বের হয়ে যাওয়ার সময় আমাকে বলল, ''বাচ্চাদের নিয়ে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।'' এরপর বাইরে থেকে ঘরে তালা দিয়ে চলে যায় সে। আমিও বাচ্চাদের নিয়ে শুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে যাই। রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টা হবে তখন। হঠাৎ শুনি বিকট শব্দ। যেন চারপাশে ভূমিকম্প শুরু হলো। ধুপধাপ শব্দ। তখন আসলে পাকিস্তানি মিলিটারিরা পূর্ব পাশের গেট ভেঙে হলে ঢুকছে। এরপর একটানা গুলির শব্দ।
আমি ছেলেমেয়ে দুটোকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে বসে রইলাম। এর কিছুক্ষণ পর দেখি মিলিটারির গাড়ির শব্দ। একের পর এক গাড়ি ঢুকছে। আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন এক বৃদ্ধা। সবাই তাকে অরুণের ঠাকুরমা বলে ডাকত। কিছুক্ষণ পরে দেখি তিনি দরজা ধাক্কাচ্ছেন আর বলছেন ''ও বকুলি, ও বকুলি কী করিস? দরজা খোল।'
এদিকে তো আমার ঘরে তালা দিয়ে চলে গেছে আমার স্বামী। আমি তখন বললাম, ''দিদিমা, আমি তো ঘরে। আমাকে তালা দিয়ে চলে গেছে। আমার বের হওয়ার তো উপায় নেই।'' তিনি বললেন, ''আচ্ছা দেখি, আমি অরুণকে দিয়ে চাবিটা আনতে পারি নাকি।''
এর কিছুক্ষণ পর রাত ১২টা বা সাড়ে ১২টার দিকে দেখি আমার স্বামী চলে এসেছে। তালাটা খুলে সে বলল, ''চলো, আমরা এদিক থেকে সইরা যাই।'' এরপর আমরা সেই দিদিমা ও তার পরিবারসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে বের হলাম। এক পর্যায়ে দেখি, হলের মাঠে পাকিস্তানিরা ছাত্রদের লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করছে। আমরা প্রাণভয়ে কী করব ভাবতে লাগলাম।
মাঠের একপাশে ছিল অ্যাসেম্বলি ভবন। অ্যাসেম্বলি ভবনের পাশে একটি ছোট ঘরে সরস্বতী পূজা হতো। ওদিকটা বেশ অন্ধকার হওয়ায় আমরা সেখানে ঢুকে সরস্বতীর প্রতিমার পেছনে গিয়ে লুকালাম। আমার স্বামীও সেখানে গিয়ে লুকালো।
তখন আমাদের সবার বুক ভয়ে ধড়ফড় করছে। প্রতি মুহূর্তকে মনে হচ্ছে কয়েক বছর। কপাল দিয়ে দরদর করে ঘাম বের হচ্ছে। ঠিক তখনই অরুণের ৬ মাস বয়সী মেয়েটা কেঁদে উঠল। মিলিটারিরা সেই শব্দ পেয়ে ৫ ব্যাটারির টর্চ দিয়ে আমাদের খুঁজতে থাকে।
চারপাশে খুঁজতে গিয়ে আমার স্বামীকে দাঁড়ানো অবস্থায় খুঁজে পায় তারা। আমাদের মেয়েটা স্বামীর কোলে ছিল। মিলিটারিরা আমার স্বামী ও মেয়েকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি বললাম, 'আমার স্বামীকে কোথায় নেন?' প্রথমে তারা কিছু বলল না। এরপর আবার যখন জিজ্ঞেস করলাম, তখন তারা আমাকে লাথি মারল। ছেলেসহ পড়ে গেলাম। এরপর আমার মেয়েকে ধাক্কা মেরে ফেলে আমার স্বামীকে নিয়ে গেল তারা। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
ওরা আমার চোখে জল ছিটালে আমার জ্ঞান ফিরে এল। আমার সঙ্গে থাকা প্রতিবেশীরা বলল, ''লও আমরা গেইটের দিকে যাই।'' ওইদিকে যাওয়া শুরু করলে মিলিটারিরা আমাদের বসতে বলল। আমরা বসার পর দেখলাম, হাউস টিউটর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকে নিয়ে আসছে ওরা। এরপর প্রথমে তাকে উর্দুতে কি যেন জিজ্ঞেস করল পাকিস্তানি সেনারা। তিনিও উর্দুতে জবাব দিলেন। এরপর আমার স্বামীকে যেদিকে নিয়ে গিয়েছিল, তাকেও সেদিকে নিয়ে যাওয়া হলো।
একটু পরই আমি টানা গুলির শব্দ শুনলাম। রাত প্রায় ৪টার দিকে আমাদের মধ্যে একজন বলল, ''চলো, আমরা মাঠের দিকে যাই।'' গিয়ে দেখি অনেককেই ধরে আনা হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে আমি আমার স্বামী ও হাউস টিউটরকে দেখলাম না।
অনেককে দেখলাম লাশ টেনে এনে গণকবরের পাশে জড়ো করছে। একটু পর তাদেরকেও ব্রাশফায়ার করে হত্যা করল পাকিস্তানি সেনারা। আমি দেখে আবারও অজ্ঞান হয়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরলে দেখি বুলডোজার দিয়ে গর্ত করা হচ্ছে। গর্ত করা শেষে একটার পর একটা লাশ ফেলতে শুরু করল পাকিস্তানিরা। এরপর মাটিচাপা দিয়ে দিলো।
আমি তখন টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম। বাইরে কারফিউ। কিছুক্ষণ পর কারফিউ উঠে গেলে আমরা মেডিকেলের দিকে রওনা দিলাম। মেডিকেলে পৌঁছার পর দেখি, বহু মানুষ সেখানে। আহতদের অনেককেই আনা হয়েছে।
এদিকে আমার ছোট মেয়েটা তখন কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ''মাগো, খাওন দাও।'' আমার চোখে জল চলে এল। কিন্তু আমি তো ঘর থেকে কিছুই নিয়ে আসিনি। সঙ্গে টাকাও নেই। খাবার দেবো কীভাবে! তখন একটা ছেলে এগিয়ে এসে বলল, ''মাসি, আমার দোকান থেকে আপনি রুটি নেন আর বাচ্চাটার জন্য দুধ নেন।'' এরপর ওরা বাচ্চাটার জন্য কাপের মধ্যে একটু দুধ দিলো। আমি মেয়েটাকে দুধ খাওয়ালাম আর নিজে রুটি খেয়ে নিলাম।
রাতটা ওখানে থাকলাম। এরপর হঠাৎ একজন চিৎকার করে বলে উঠল, ''এই মিলিটারি আইতাছে, মিলিটারি আইতাছে।'' সঙ্গেসঙ্গে আমরা মেডিকেলের বেডে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু মেডিকেলে কোনো মিলিটারি আসেনি। সকালবেলা আবার মেয়েটা কান্না করতে শুরু করল।আবার খাবার চাচ্ছে। মেয়ের কান্না শুনে তখন ওই দোকানের ছেলেটাই আমাকে একটা রুটি আর আরেক কাপ দুধ দিলো। ওখানে আমরা থাকলাম ১টা পর্যন্ত।
আমার সঙ্গে যারা ছিল তারা বলল জিঞ্জিরার দিকে যাওয়ার কথা। প্রথমে আমরা সদরঘাটে গেলাম। যাওয়ার পর বিহারীরা আমাদের তাদের বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেও আমরা যাইনি। তখন আমার সঙ্গে যারা ছিল, সবাই ঢাকাইয়া। ওরা বুঝতে পেরেছিল, এটা আসলে ওদের একটা টোপ। ওরা আমাদের নিমন্ত্রণ করে ফাঁদে ফেলে মারবে।
সদরঘাটের খেয়াঘাটে যখন এলাম, তখন দেখি নদী পার হতে টাকা লাগছে। কিন্তু আমার সঙ্গে কোনো টাকা ছিল না। তখন এক মাঝি এসে বলল, ''দিদি, নৌকায় আপনার কোনো ভাড়া দেওয়া লাগবে না। আপনি উঠেন।''
জিঞ্জিরা যাওয়ার পথে মাঝনদীতে একটা নৌকা হঠাৎ উল্টে গেল। নৌকায় থাকা যাত্রীরা নদীতে পড়ে গেল। সেই যাত্রীদের মধ্যে ম্যাট্রিক পড়ুয়া ২ বোন ছিল। ওরা সাঁতার জানত না বলে পানিতে ডুবে গেল। আর তাদের বাবা-মা সাঁতার কেটে নদীর অপর পাড়ে উঠে বিলাপ করতে থাকল। ২ ঘণ্টা পরে ওই ২ মেয়ের লাশ ভেসে উঠে।
আমার মেয়ে তখনও ক্ষুধার যন্ত্রণায় খাবার চাচ্ছে। একটু পর শুভাড্যা থেকে এক মুড়ি বিক্রেতা নারী বস্তা ভরে মুড়ি আনল, সঙ্গে গুড়। আমার তখন গলা দিয়ে খাবার নামবে না বলে আমি খাইনি। আমার মেয়েটা বসে বসে খাচ্ছে। এরপর আমার সঙ্গে থাকা বাকিরা শুভাড্যার দিকে যেতে চাইল। মুড়ি বিক্রেতা ওই নারীই বললেন, ''আমার সঙ্গে আমাদের বাসায় চলেন।'' ওই বাসায় আমরা গেলাম। তার পরিবারের সদস্যরা আমাদের জন্য রান্নাবান্না করল। আমার বাচ্চা দুটো যে খেতে পেরেছে, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। ওখানে আমরা ৭ দিন ছিলাম। এরপর আমরা বিক্রমপুরের রাধানগরে চলে যাই।'
Comments