মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা
মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা যে কতটা ভয়াবহ ছিল, তার বড় একটি প্রমাণ পাওয়া যায় পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী গওহর আইয়ুবের লেখা 'গ্লিমপসেস ইনটু দ্য করিডর অফ পাওয়ার' বইয়ে। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে একটি লেখা সংগ্রহ করেছিলেন গওহর আইয়ুব।
লেখাটি ছিল অনেকটা এমন-
যুদ্ধের এক বছর পরে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির একটি সামরিক হাসপাতালে এক তরুণ পাকিস্তানি অফিসারকে আনা হয় মানসিক চিকিৎসার জন্য। সেই তরুণ অফিসার যুদ্ধ শেষে পাকিস্তান ফিরে যাওয়ার পর গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত হন। যুদ্ধের কথা মনে হলেই তার পুরো শরীরে খিঁচুনি দিয়ে জ্বর উঠত। ঘুমাতে গেলেই দুঃস্বপ্নে ভেঙে যেত ঘুম। কেউ যেন তাকে বলত, ফিরে যেতে হবে বাংলাদেশে। সেখানে থাকা হিন্দুদের মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। নয়তো তার মুক্তি নেই।
মূলত দিনের পর দিন ওই অফিসারের নির্দেশে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। পুরো মুক্তিযুদ্ধে তিনি একাই হত্যা করেছিলেন ১৪ হাজারের বেশী নিরীহ মানুষকে। পরে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
১৯৭২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দিনাজপুর টিঅ্যান্ডটি অফিসের একটি টর্চার সেলের বিবরণ পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে লেখা ছিল, 'দিনাজপুরে টিঅ্যান্ডটি অফিসে একটি টর্চার সেলে প্রায় ১০ হাজার বাঙালিকে নির্যাতন করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। সেলের মেঝেতে ৩ ইঞ্চি পুরু রক্ত জমাট বাঁধা ছিল।'
মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার কথা বলতে গেলেই উঠে আসে খুলনার চুকনগর গণহত্যার কথা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বল্প সময়ে একক স্থানে সবচেয়ে বড় গণহত্যা ছিল এটি। চুকনগর ছিল খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম।
মুক্তিযুদ্ধের ২০মে মাত্র এক প্লাটুন পাকিস্তানি সেনা ৪ ঘণ্টায় ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে অন্তত ১২ হাজার নিরীহ মানুষকে। প্রকৃতপক্ষে এই গণহত্যায় এরচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন। চুকনগরের পাশে ভদ্রা নদীর পানিতে লাশ ভাসিয়ে দেওয়ায় নিহতের প্রকৃত সংখ্যা পাওয়া যায়নি। স্থানীয়ভাবেও সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। কারণ ওই গণহত্যায় শহীদদের বেশিরভাগ চুকনগর, ডুমুরিয়া বা খুলনার বাসিন্দা ছিলেন না।
চুকনগরের গণহত্যার একটি বর্ণনা পাওয়া যায় পাশের গ্রাম রুস্তমপুরের শিক্ষক সরদার মুহাম্মদ নূর আলীর কাছে।
তিনি বলেন, 'সে এক নারকীয় দৃশ্য! ভোলা যায় না। আমাদের এলাকায় প্রায় ৪ মাইলব্যাপী এই হত্যাযজ্ঞ চলে। কিছু লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। দুর্গন্ধ এড়াতে কিছু লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়। এলাকার লোক ২ মাস পর্যন্ত ওই নদীর মাছ খায়নি। ভয়ে লোকজন ৫-৬মাস পর্যন্ত বাজারেও আসেনি।'
ঢাকার গণহত্যাগুলোও ছিল বড় আকারের। এসব গণহত্যার মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় জিঞ্জিরা গণহত্যার কথা। ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৫টায় শুরু হওয়া এই গণহত্যা থেমেছিল দুপুর আড়াইটায়। জিঞ্জিরা গণহত্যায় শহীদ হয়েছিলেন ২ হাজারেরও বেশি নিরীহ মানুষ।
মুক্তিযুদ্ধে ঢাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নৃশংসতা দেখেছে মিরপুর। মুক্তিযুদ্ধের সময় মিরপুর যেন জলজ্যান্ত এক কসাইখানা ছিল। এই মিরপুরে পাকিস্তানপন্থী বিহারী ও অবাঙালিরা গড়ে তুলেছিল অসংখ্য টর্চারসেল। ছিল বধ্যভূমি। তখন মিরপুর ছিল অনেকটা বিরান জনপদ। সেজন্যই এখানে এসব ঘটনা বেশি ঘটেছে।
মিরপুরে বধ্যভূমি ছিল ২৩টি। এরমধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি। একাত্তরে এই জায়গার একপাশে ছিল জঙ্গল। এই জঙ্গলে হাজার হাজার মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। বর্তমানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা ভবন থেকে কমার্স কলেজ যেতে যে কালভার্টটি পড়ে, সেখানে স্বাধীনতার পরে পাওয়া গিয়েছিল ৬০ বস্তা মাথার খুলি।
অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান মিরপুরের কুখ্যাত শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি দেখে এসে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় লিখেছিলেন, 'কসাইখানায় কসাইকে দেখেছি জীবজন্তুর গোস্ত কিমা করে দিতে। আর শিয়ালবাড়িতে গিয়ে দেখলাম কিমা করা হয়েছে মানুষের হাড়। একটা মানুষকে ২ টুকরো করলেই যথেষ্ট পাশবিকতা হয়। তাকে কিমা করার মধ্যে কোন পাশবিকতার উল্লাস?'
মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে অন্যতম শিরনিরটেক। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখানে ৩ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা।
মুক্তিযুদ্ধের ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা বিহারী ও রাজাকারদের সহযোগিতায় ঘিরে ফেলে পুরো আলোকদী গ্রাম। ২৪ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে ২৫ এপ্রিল দুপুর ১টা পর্যন্ত সেখানে পৈশাচিক গণহত্যা চালায় তারা। এই গ্রামের মোট ৮টি কুয়া পূর্ণ হয়ে যায় মানুষের মরদেহে। এ ছাড়া, পাশের জলাশয়ের ধারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নির্বিচারে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় নিরীহ গ্রামবাসীকে। এই গ্রামে শহীদের সংখ্যা ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজারের মতো।
একক শহর হিসেবে দেখলে মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায় চট্টগ্রামে। ১১৬টি বধ্যভূমি সেখানে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল দামপাড়া বধ্যভূমি। বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীর গরিবুল্লাহ শাহর মাজার যেখানে, সেখানেই ছিল দামপাড়া বধ্যভূমি। প্রতিদিন রাতে বেশ কয়েকটি ট্রাক ভর্তি করে মানুষ ধরে আনা হতো সেখানে। এরপর তাদের দিয়ে গর্ত খনন করিয়ে তাদেরকেই গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দিতো পাকিস্তানি বাহিনী।
প্রতিটি গর্ত যখন পূর্ণ হয়ে যেত, তখন খুলি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হতো। ধারণা করা হয়, এখানে প্রায় ৪০ হাজারের মতো মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সেনারা।
মুক্তিযুদ্ধে ৩০ মার্চ আর পরবর্তী কয়েকদিনে চট্টগ্রামের লালখান বাজারে পাকিস্তানি বাহিনী ও বিহারীরা একত্রিত হয়ে হত্যা করে প্রায় আড়াই হাজার বাঙালিকে। ৩০ মার্চ পানি সরবরাহের আশ্বাসে ওয়াসার মোড়ে গণহত্যা চালানো হয়।
মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের অন্যতম বড় বধ্যভূমি ছিলো পাহাড়তলী বধ্যভূমি। এই বধ্যভূমিতে পাওয়া যায় প্রায় ১০০ গর্ত। এরমধ্যে একটি গর্তেই পাওয়া যায় ১ হাজার ৮২টি খুলি।
মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যায় নৃশংসতার তালিকা করলে প্রথম দিকে থাকবে নীলফামারীর গোলাহাট গণহত্যা বা অপারেশন খরচাখাতা। অপারেশন খরচাখাতায় ৪৪৮জন মাড়োয়ারিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বিহারী ও পাকিস্তানি সেনারা।
নীলফামারীর সৈয়দপুরে বসবাসরত বিপুল সংখ্যক অবাঙালি বা মাড়োয়ারিদের উদ্দেশে মুক্তিযুদ্ধের ৫ জুন পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন মাইকে একটি ঘোষণা দেয়। বলা হয়, হিন্দু মাড়োয়ারিদের নিরাপদ স্থান ভারতে পৌঁছে দেওয়া হবে। আর এজন্য একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ট্রেনটি ১৩ জুন চিলাহাটি সীমান্ত দিয়ে ভারতের জলপাইগুড়ি পৌঁছে দেবে আটকে পড়া মাড়োয়ারিদের।
১২ জুন রাত থেকে মাড়োয়ারিদের ঢল নামে সৈয়দপুর রেলস্টেশনে। ভারতে নেওয়ার কথা বলে সৈয়দপুর স্টেশন থেকে ৪টি বগিতে তোলা হয় মাড়োয়ারিদের। পরে গোলাহাটে নিয়ে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করা হয় ৪৪৮ জন মাড়োয়ারিকে।
সেদিনের সেই পৈশাচিক গণহত্যা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া গোবিন্দ চন্দ্র দাস বলেন, 'থেমে থাকা ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে ঢুকেই পাকিস্তানি সেনারা চিৎকার করে উর্দুতে বলতে থাকেন, ''একজন একজন করে নেমে আসো। তোমাদের মারতে এসেছি আমরা। তবে পাকিস্তানের দামি গুলি খরচ করা হবে না। সবাইকে কোপে বলি দেওয়া হবে।'' সঙ্গেসঙ্গে শুরু হয়ে যায় বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞ। ওই হত্যাযজ্ঞ থেকে শিশু, বৃদ্ধ, নারীরাও রেহাই পাননি।'
মুক্তিযুদ্ধে ঢাকার বাইরে বুদ্ধিজীবী গণহত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনা এই সৈয়দপুরেই ঘটে। ২৫ মার্চ রাতে সৈয়দপুর শহর থেকে প্রায় ১৫০ জন বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। এরপর টানা ১৮ দিন পৈশাচিক নির্যাতনের পর ১২ এপ্রিল মধ্যরাতে রংপুর সেনানিবাসের পশ্চিম পাশের উপ-শহরে নিয়ে গুলি করা হয় তাদের।
এই গণহত্যা বালারখাইল গণহত্যা নামেও পরিচিত। বালারখাইল গণহত্যার মূল উদ্দেশ্য ছিল, সৈয়দপুর শহরকে বুদ্ধিজীবী শূন্য করে দেওয়া। বালারখাইল গণহত্যাই ছিল দেশের প্রথম পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী গণহত্যা।
মুক্তিযুদ্ধে দেশে কতগুলো গণহত্যা হয়েছে এবং কতগুলো গণকবর আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায় না। তবে গণহত্যা নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র জানিয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত ২০টি জেলায় ৪ হাজার ৬০০ এর বেশি বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতন কেন্দ্র চিহ্নিত করেছে।
তথ্যসূত্র:
চুকনগর গণহত্যা-মুনতাসীর মামুন
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র,অষ্টম খন্ড (পৃষ্ঠা ৩৭৬-৩৭৮)
গোলাহাট গণহত্যা-আহম্মেদ শরীফ
একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর-সুকুমার বিশ্বাস
Glimpses into the corridors of power-Gohar Ayub Khan
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments