শব্দ নিয়ে ভাবি

শব্দ নিয়ে ভাবি একা একাই। মানুষ তো বিনা কারণে কোনো শব্দ তৈরি করেনি! কোনো একটি শব্দে যখন ভাব প্রকাশকে যথার্থ বলে মনে হয়নি, কিংবা তৃপ্তি মেটেনি, তখন নতুন শব্দের জন্ম অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রায় একই অর্থ বহন করে বলে মনে হয় অথচ একই নয়, এরকম একাধিক শব্দের আবিষ্কারের কারণ কী?

যেমন ইংরেজি শব্দ 'সেনসিবল' আর 'সেনসটিভ' শব্দ দুটো প্রায় একইরকম শোনায়, আমরা তো না বুঝে এক করেও ফেলি মাঝে-মাঝে। বাংলায় প্রথমটি 'সংবেদনশীল' আর দ্বিতীয়টি 'স্পর্শকাতর'। এই দুটো শব্দ কি একই অর্থ বহন করে? না, করে না। সংবেদন হলো সেই বিরল গুণ যা একজন মানুষকে অপরের বেদনায় নিজেকেও বেদনার্ত হতে শেখায়। সেই 'অপর' আবার কেবল মনুষ্যজাতি নয়, জগতের সকল প্রাণের সকল ধরনের বেদনায় কাতর হবার মতো হৃদয় থাকে তাদের, যারা সংবেদন নামক দুর্লভ গুণের অধিকারী। সংবেদনশীল মানুষ মাত্রই অন্যের দুঃখে কাতর হন, অন্যের দুর্ভোগে অশ্রুসজল হন। আর স্পর্শকাতরতা হলো সেই সহজলভ্য গুণ যা একজন মানুষকে কেবল নিজের অনুভূতি নিয়েই ব্যস্ত থাকতে সহায়তা করে, অন্য কারো কথা ভাববার সময় বা মন তার নেই। অহরহ অনুভূতি আহত হয় স্পর্শকাতর মানুষদের, আহত হতে হতে অনেক সময় নিহতও হয়ে যায় তাদের অনুভূতি। এই দু-ধরনের মানুষ কিন্তু একরকম নয়! আমাদের চারপাশে এখন স্পর্শকাতর মানুষের ভিড়, সংবেদনশীল মানুষের দেখা মেলাই ভার। 

আবার 'ইমোশন' আর 'সেন্টিমেন্ট' শব্দ দুটোর কথা ভাবা যাক। আমরা প্রায় একই ধরনের আচরণ দেখে দুটো শব্দই ব্যবহার করি, যদিও দুটোর অর্থ এক নয়, প্রয়োগও এক হওয়ার কথা নয়। দুটো শব্দই আবেগের সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু দুই আবেগ দু'রকম। আমরা যখন 'ইমোশনাল' শব্দটি ব্যবহার করি কারো সম্বন্ধে, সম্ভবত বোঝাতে চাই, মানুষটি আবেগপ্রবণ। আর 'সেন্টিমেন্টাল' ব্যবহার করলে হয়তো বোঝাতে চাই, মানুষটি অনুভূতিপ্রবণ। সেই অনুভূতি আবার খুবই উঁচু তারে বাঁধা, টোকা লাগলেই বেজে ওঠে, কখনো-কখনো ছিঁড়েও যায়। আর তাই, শব্দটি সম্ভবত ব্যবহার করা যায় স্পর্শকাতর মানুষের জন্য। খুবই কাতর তারা, তাকে কে কী বললো, তার সম্বন্ধে কে কী ভাবলো, কেন বললো, কেন ভাবলো, এইসব আর কি! অন্যদের নিয়ে ভাববার সময় নেই তার, কেবলই নিজেকে নিয়ে ভাবনা, নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। অন্যদিকে ইমোশন শব্দটি অপরের অনুভূতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আবারও বলি, অপর মানে কেবল অপর মানুষই নয়। সব কিছু। কিছু মানুষ যেমন পশুপাখির কষ্ট দেখে কাঁদে, তেমনই সিনেমা দেখে কাঁদে, গান শুনে কাঁদে, কবিতা বা গল্প-উপন্যাস পড়ে কাঁদে। এরা সব ইমোশনাল মানুষ। তবে কি এই অনুভূতি কেবল কান্নার জন্ম দেয়? না, তা নয়, গভীর আনন্দেরও দেখা পান তারা। উচ্চতর আনন্দ। জগৎকে ভালোবাসার আনন্দ, অন্যের জন্য গভীর মমতার আনন্দ। আমাদের চারপাশে সেন্টিমেন্টাল মানুষের ছড়াছড়ি এখন, ইমোশনাল মানুষ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। 

আবার কাছাকাছি তিনটি শব্দের কথা ভাবা যাক। নীরবতা, নৈঃশব্দ্য, নির্জনতা। এই তিনটি শব্দ কি একই অর্থ বহন করে? যদি করবেই তাহলে ভিন্ন ভিন্ন শব্দ কেন? অভিধানে যা-ই লেখা থাকুক, আমরা প্রায়ই এই ধরনের কাছাকাছি শব্দগুলো ব্যবহার করে ফেলি বিনা চিন্তায়। শব্দের আভিধানিক অর্থ কখনো কখনো ব্যবহারিক প্রয়োগে হারিয়ে যায়, উৎপত্তি জানলেই যে খুব বেশি লাভ হয়, তা নয়। বরং শব্দের অর্থকে আবিষ্কার করার ভেতরে একটা আনন্দ আছে।
 
যেমন 'নীরব' শব্দটির কথা ধরা যাক। এ কি এমন একটা অবস্থা/পরিস্থিতি যেখানে রব নেই? রব মানে তো ডাক, যেমন রবাহুত; রব মানে তো কোলাহলও, যেমন কলরব; রব মানে উচ্চস্বরও যেমন সরব; তার মানে কি এই যে, নীরবতা মানে ডাক নেই, কোলাহল নেই? নিচুস্বরের শব্দাবলি কি থাকতে পারে? থাকলে কি নীরবতা সেখানে রচিত হবে? কিংবা যদি নৈঃশব্দ্য শব্দটির কথা ধরি, সেটি কি নীরবতার মতোই? নৈঃশব্দ্য মানে তো শব্দই নেই। অর্থের দিক থেকে নীরবতার চেয়ে এটি ভারী, খানিকটা অধিক নীরব। কিন্তু নির্জনতা? নীরবতা বা নৈঃশব্দ্য শব্দ দুটোর ভেতরে জনমানবহীন পরিবেশের উল্লেখ নেই, বাধ্যবাধকতাও নেই। মানুষের উপস্থিতিতেই তৈরি হতে পারে নীরবতা ও নৈঃশব্দ্য। কিন্তু নির্জনতা? যেখানে জন নেই? মানে এ এমন এক নীরবতা, এমন এক নৈঃশব্দ্য, যেখানে জনমানবের উপস্থিতি নেই? এমনকি উপস্থিতি নেই অন্য কোনো প্রাণের; পশু, পাখি বা পতঙ্গের? যদি কিছুই না থাকে তাহলে যে নীরবতা বা নৈঃশব্দ্য রচিত হবে তা তো প্রায় অলৌকিক। নির্জনতা বলতে কি আমরা এরকমই এক অলৌকিক অবস্থার কথা বোঝাই?   

আরো দুটো শব্দের কথা ভাবা যাক- 'একা' এবং 'নিঃসঙ্গ'। এই দুটো শব্দকে আমরা যত্রতত্র সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করি কিন্তু নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্ব কি এই ব্যাপার? যিনি নিঃসঙ্গ আর যিনি একা, তাঁরা কি একই মানুষ? কখনো মনে হয়, একই, কোনো পার্থক্য নেই তাদের মধ্যে। পরের মুহূর্তে  এও মনে হয়, একই হলে দুটো আলাদা শব্দ কেন? অভিধানের সাহায্য নিচ্ছি না, লেখাটিকে ভাষাতাত্ত্বিক জটিল আলোচনায় রূপান্তর করার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই, কিন্তু দুটো আলাদা শব্দ যে আমাকে ভাবায়, সেটি না বলেও পারছি না। একজন মানুষের আশেপাশে অনেক মানুষ আছে কিন্তু তাকে সঙ্গ দেয়ার মতো কেউ নেই- মনে মন মিলছে না, চিন্তায়-দর্শনে-আবেগে মিলছে না, তাই সঙ্গও মিলছে না, এমন মানুষই কি নিঃসঙ্গ মানুষ? তাহলে একা কে? যার আশেপাশে কোনো মানুষই নেই, সঙ্গ দেয়া তো দূরের কথা- এমন কেউ? যদি তাই হয়, তাহলে আরেকটি প্রশ্ন্ও আসে, মানুষ কি একা বাঁচতে পারে? তার পাশে কিছু মানুষ তো থাকেই, নিঃসঙ্গ হলেও থাকে। অবশ্য শব্দের ব্যঞ্জনাকেও অস্বীকার করা চলে না। জীবনানন্দ যখন লেখেন, 'তবু কেন এমন একাকী? /তবু আমি এমন একাকী', তখন যে ব্যঞ্জনা তৈরি হয়, 'তবু কেন এমন নিঃসঙ্গ? /তবু আমি এমন নিঃসঙ্গ' লিখলে নিশ্চয়ই সেই ব্যঞ্জনা তৈরি হতো না। কিন্তু কেবল শব্দের ব্যঞ্জনা তৈরির জন্যই দুটো আলাদা শব্দের জন্ম হয়েছে, তাও মনে হয় না।

হয়তো আলাদা অর্থ আছে এদের, আলাদা তাৎপর্য।  কী সেই অন্তর্নিহিত তাৎপর্য? আমার মনে হয়, যিনি নিঃসঙ্গ, তিনি সব অর্থেই নিঃসঙ্গ। মানুষ তো বটেই এমনকি জগতের কোনোকিছুই তাকে সঙ্গ দিতে পারে না, কিংবা তিনি কাউকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন না। অন্যদিকে, যিনি একা তিনি হয়তো মানবিক সঙ্গ থেকে বঞ্চিত, কিন্ত এও তার অজানা নয় যে, মানুষ ছাড়াও আরো অনেক কিছুর কাছ থেকে সঙ্গ পাওয়া যায়। নিসর্গের নানা অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে পারে তার সঙ্গী- যেমন প্রাণীকূল, পাখিকূল, এমনকি পতঙ্গও। শুধু তাই নয়, বৃক্ষজগতের সঙ্গেও অনেক মানুষের সম্পর্ক রচিত হয়। তখন বৃক্ষই হয়ে ওঠে তার আপনজন, তার সঙ্গী। নদী, সমুদ্র, পাহাড় এমনকি ফসলী মাঠও হয়ে ওঠে কারো কারো সঙ্গী। আবার কিছু মানুষের সঙ্গী হয় সাহিত্য, সংগীত কিংবা শিল্পকলার বিবিধ প্রসঙ্গ। এদের সঙ্গে কেটে যায় দিন-রাত, এদের সহায়তায়ই বহন করে নেয়া যায় দুর্বহ এই জীবন। এইদিক থেকে দেখতে গেলে, সকল নিঃসঙ্গ মানুষই একা কিন্তু সকল একা মানুষ নিঃসঙ্গ নন। হয়তো সে-কারণেই মানুষ এই দুটো আলাদা শব্দ আবিষ্কার করেছে। 

মানুষের তৈরি করা শব্দ নিয়ে তবু দু-চার কথা বলা যায়, আবিষ্কারের চেষ্টা করা যায় এসবের অন্তনির্হিত অর্থ। কিন্তু শব্দের মালিকানা তো কেবল মানুষেরই নয়। পাখি বা পতঙ্গ, জীবজন্তু বা গাছপালা, নদী বা সমুদ্রেরও তো আাছে বিবিধ শব্দ। সেসব ব্যাখ্যা করার উপায় কী? একই জাতের দুটো পাখি বা দুটো বিড়াল যদি পৃথিবীর দুই প্রান্তে বাস করে, তাহলে তাদের ডাকের অর্থ কি একই হবে? ওরা কি একই ভাষায় কথা বলে? না, এই প্রসঙ্গ আজ নয়, অন্য কোনো সময়ে আলাপের জন্য তোলা থাকুক। 

Comments

The Daily Star  | English

4 years could be maximum one can go before election: Yunus tells Al Jazeera

Says govt's intention is to hold election as early as possible

31m ago