‘আশঙ্কা করছি শান্তিচুক্তির আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছি’

গত ৬ মার্চ বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে গুলিতে নিহত মগ পার্টির সদস্যদের মরদেহ উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সই হওয়ার পর ২৫ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই অঞ্চলের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে অনেকটাই খারাপ হয়ে উঠেছে। চুক্তিতে পার্বত্য অঞ্চলে সংঘাত ও সহিংসতার অবসান হওয়ার কথা থাকলেও, এ অঞ্চলের বিশিষ্টজনেরা মনে করছেন সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ের পরিস্থিতি অনেকটা চুক্তির আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে এবং কিছু ক্ষেত্রে তা আগের চেয়েও খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখছি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা চুক্তির আগের অবস্থায় ফিরে গেছি এবং কিছু ক্ষেত্রে চুক্তির আগের অবস্থার চেয়েও খারাপ অবস্থায় পৌঁছে গেছি।'

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, 'আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকার পাহাড়ে কয়েকটি আঞ্চলিক দলের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে, অথচ তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছত্রছায়ায় থাকা সশস্ত্র গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।'

'আশঙ্কা করছি আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আগের অবস্থানে ফিরে যাচ্ছি,' তিনি বলেন।

গৌতম দেওয়ান আরও বলেন, 'যতদিন চুক্তি বাস্তবায়ন না হবে, ততদিন পর্যন্ত সমস্যাগুলো আরও প্রকট হবে এবং পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।'

অধিকার কর্মী লেলুং খুমী বলেন, 'নির্বিচারে গ্রেপ্তার, তল্লাশি অভিযান, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নিরীহ গ্রামবাসীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে বিভিন্ন সময় জুম্ম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।'

পাহাড়িদের জমি ও বসতবাড়িতে ক্রমাগত অবৈধ দখল এই অঞ্চলের সঙ্কটকে আরও জটিলতর করে তুলছে বলে মনে করছেন অধিকার কর্মীরা।

লেলুং বলেন, 'চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংকটের সমাধান না করে যদি দমন-নিপীড়নের নীতি অনুসরণ করা হয়, তাহলে এর ভুক্তভোগীরা নিজেদের প্রতিরোধ এবং প্রতিরক্ষা করা চেষ্টা করবে।'
        
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে দীর্ঘ সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১৯৯৮ সালে  ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল।

কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতি শান্তিচুক্তির কিছু প্রধান ধারা বাস্তবায়ন না হওয়ার সাক্ষ্য বহন করে। এগুলোর মধ্যে ভূমি বিরোধ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। এটি এখন পর্যন্ত অমীমাংসিত রয়ে গেছে বলে মনে করছেন এই অঞ্চলের বিশিষ্টজনেরা।

শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়াকে তারা গত কয়েক বছর ধরে পাহাড়ে বেড়ে যাওয়া সংঘাতের কারণ হিসেবে দেখছেন।

সম্প্রতি বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় স্থানীয়ভাবে মগ পার্টি নামে পরিচিত মগ লিবারেশন পার্টির অন্তত ৪ সদস্য নিহত হয়েছেন বলে জানান বান্দরবানের পুলিশ সুপার জেরিন আক্তার।

তিনি বলেন, 'যখন শুধু কয়েকটি দল ছিল, বান্দরবানের অবস্থা তখন ভালো ছিল। কিন্তু এখন এখানে অনেকগুলো দল হওয়ায় পরিস্থিতি খারাপ পর্যায়ে যাচ্ছে।'

এর আগে গত শনিবার দুপুরে রোয়াংছড়ি উপজেলার নতুন পাড়া এলাকায় (বুখ্যং পাড়া) এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সদস্য উনু মং মারমাকে মগ পার্টির সদস্যরা গুলি করে বলে জানিয়েছে পুলিশ ও পিসিজেএসএস।

রোয়াংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল মান্নান জানান, গুলি করার পরে দুর্বৃত্তরা উনু মংকে তুলে নিয়ে যায়।

ওসি বলেন, উনু মং জীবিত না কি মৃত, তা আমরা জানি না। তবে পিসিজেএসএস সূত্র জানিয়েছে যে উনু মং পরে মারা গেছেন।

স্থানীয়রা জানান, মগ পার্টির হুমকিতে গ্রামবাসীরা নির্ঘুম রাত পার করছে।

এই অঞ্চলে ধারাবাহিক হত্যা ও অপহরণের পর এলাকার গ্রামবাসীরা এখন চরম আতঙ্কে রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

গত ৪ জানুয়ারি বান্দরবানের লামায় এমএলপির একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

গত ২ ফেব্রুয়ারি উভয় পক্ষের গুলাগুলিতে এক সেনা সদস্য এবং পিসিজেএসএসের ৩ জন সশস্ত্র অপরাধী নিহত হয় বলে আইএসপিআর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল।

২৬ ফেব্রুয়ারি প্রত্যন্ত রোয়াংছড়ি উপজেলায় ১ জন পাহাড়িকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর বান্দরবানের চেমি ডলু পাড়া এলাকায় পিসিজেএসএসের এক নেতাকে মগ পার্টির সদস্যরা অপহরণের পর হত্যা করে।

তিনি পিসিজেএসএস বান্দরবান থানা শাখার সেক্রেটারি ছিলেন।

২০২১ সালের ১৯ জুলাই একই চেমি ডলু পাড়া এলাকা থেকে পাহাড়ি সম্প্রদায়ের এক গ্রাম্য ডাক্তারকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়।

বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পিসিজেএসএস-এমএন লারমা সংস্কারপন্থী দলের এক সদস্যকে ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর গুলি করে হত্যা করা হয়।

২০২০ সালের ৭ জুলাই বান্দরবান সদর উপজেলার বাঘমারা এলাকায় পিসিজেএসএস-এমএন লারমা গ্রুপের বান্দরবান জেলা শাখার সভাপতি ও ২ কেন্দ্রীয় নেতাসহ ৯ সদস্য নিহত হন।

২০২০ সালের ১৭ এপ্রিল রোয়াংছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত কেনাইজু পাড়া এলাকায় মগ পার্টির এক সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

একই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি জেলার জামছড়ি এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং সে সময় ৫ জন গুরুতর আহত হন।

১৫ জুন বান্দরবানের কুহালং ইউনিয়নের এক ইউপি সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

পিসিজেএসএসের কেন্দ্রীয় নেতা কে এস মং মারমা এর আগে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন যে, 'পিসিজেএসএস কখনও হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না এবং আমরা এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাই।'

পিসিজেএসএস নেতৃবৃন্দ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের কয়েকজন সদস্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্যের সহায়তায় অপরাধীদের আশ্রয় দেয় এবং এই অঞ্চলের সম্প্রীতি নষ্ট করতে তাদের দিয়ে মগ পার্টি গঠন করে।'

তারা আরও বলেন, 'মগ বাহিনীর লোকজন পরে বান্দরবানে নবগঠিত এম এন লারমা দলে যোগ দিয়ে বান্দরবানের সম্প্রীতি নষ্ট করছে।'

২০২০ সালের ১৩ মার্চ চট্টগ্রামে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দলটির বান্দরবান ইউনিট গঠন করা হয়।

২০১৯ সালের ৭ মে একই এলাকায় পিসিজেএসএসের এক সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং একই দিনে সদর উপজেলার রাজবিলা ইউনিয়ন থেকে অপর আরেক পিসিজেএসএস সদস্যকে অপহরণ করা হয়।

এর ২ দিন পর একই উপজেলার বাকিছড়া রাবার বাগান এলাকায় মগ পার্টির গুলিতে আরেক পিসিজেএসএস সমর্থক নিহত হয়।

একই বছরের ১৯ মে রাজবিলায় স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং পার্শ্ববর্তী রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলায় স্থানীয় যুবলীগের এক নেতাকে নিজ বাড়িতে হত্যা করা হয়।

২০১৯ সালের ২৫ মে বান্দরবান সদরের কুহালং ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের বান্দরবান শাখার সাবেক সহসভাপতি চ থোয়াই মং মারমার (৫৩) মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

বান্দরবানের ৫নং ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার চ থোয়াইকে ২০১৯ সালের ২২ মে রাতে তার খামারবাড়ি থেকে অপহরণ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ আছে।

একই বছরের ২৫ জুন বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় পিসিজেএসএসের এক সমর্থককে গুলি করে হত্যা করা হয়।

পিসিজেএসএস নেতাদের অভিযোগ, তাদের সমর্থক এবং গ্রামবাসীদের হত্যার সঙ্গে 'মগ পার্টি'  জড়িত।

স্থানীয়রা জানান, তারা যেন পিসিজেএসএসকে সমর্থন না করেন, এজন্য মগ পার্টির সদস্যরা প্রতিনিয়ত তাদের হুমকি দেয়।

সশস্ত্র সংঘাতের অবসান এবং দেশ ও অঞ্চলে শান্তি আনয়নে রাজনৈতিক চুক্তি কীভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে, বিশ্বের ইতিহাসে তার বেশ কয়েকটি উদাহরণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো বেলফাস্ট চুক্তি। 

উত্তর আয়ারল্যান্ডে শান্তি প্রক্রিয়া এবং সংকট সমাধানের পথ উন্মোচনকারী বেলফাস্ট চুক্তি গুড ফ্রাইডে চুক্তি নামেও পরিচিত যেটি ১৯৯৮ সালের ১০ এপ্রিল সই হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের বিশেষ উপদেষ্টা সিনেটর জর্জ জে মিচেল এ চুক্তি স্বাক্ষরে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করায় তিনিও সে বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির মাত্র কয়েক মাস পরেই স্বাক্ষরিত বেলফাস্ট চুক্তি উত্তর আয়ারল্যান্ডের ৩০ বছরের সেখানকার সংঘাতের অবসান ঘটাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছিল।

ব্রিটিশ সরকার চুক্তিটি বাস্তবায়নের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছিল এবং তারা রাজনৈতিক চুক্তি বাস্তবায়ন করে একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhoury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands.

3h ago