মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: শহীদ ফজলুর রহমান খন্দকার, বীর উত্তম

শহীদ ফজলুর রহমান খন্দকার, বীর উত্তম। ছবি: সংগৃহীত

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের পর্বে রইল শহীদ ফজলুর রহমান খন্দকার, বীর উত্তম'র বীরত্বগাঁথা)

ফজলুর রহমান খন্দকার লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা যুদ্ধে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও আত্মত্যাগের জন্য তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। তার সনদ নম্বর ৪২।  

১৯৭১ সালের শুরুতে ফজলুর রহমান খন্দকার কর্মরত ছিলেন ১০ নম্বর ইপিআর উইংয়ে। তার পদবী ছিল সুবেদার। ১০ নম্বর ইপিআর উইংয়ের অবস্থান ছিল রংপুরে। এই উইংয়ের উইং কমান্ডার এবং ২ জন সহকারী উইং কমান্ডারের একজন ছিলেন অবাঙালি। এই উইংয়ের আওতাধীন ছিল ৫টি কোম্পানি এবং একটি সাপোর্ট প্লাটুন। 

২৫ মার্চ রাতে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের অন্যান্য স্থানের মতো রংপুরেও পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। এদিন রাত ১২টার পর পাকিস্তানি সেনারা রংপুরস্থ বাঙালি ইপিআরের ওপর আক্রমণ করে। সারারাত তারা গোলাবর্ষণ চালিয়েছিল। ২৬ মার্চ বিকেলে সহকারী উইং কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওজায়েশ উদ্দিন তিস্তা নদী অতিক্রম করে টোগরাইহাট পালিয়ে যান। সেখান থেকে তিনি চিলমারী, মোগলহাট ও অন্যান্য স্থানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন।

২৭ মার্চ রাত ৮টার দিকে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে থাকা পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি ইপিআর সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এসময় সুবেদার ফজলুর রহমান খন্দকারসহ বাঙালি ইপিআর সদস্যরা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ব্যারাক থেকে বের হয়ে ৫ মাইল দূরের একটি গ্রামে অবস্থান নেন।

২৮ মার্চ কালীগঞ্জ থানার এমসিএ করিমউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন সুবেদার ফজলুর রহমান। এমসিএ করিমউদ্দিনের সঙ্গে ৩০ জন ছাত্র এই দলের সঙ্গে যোগ দেয়। এরপর আরও ৩০০ আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র-জনতা একটি বাহিনী গঠন করে। এসময় থানা থেকেও ১৫০টি রাইফেল সংগ্রহ করা হয়।

২৮ মার্চ ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ বাঙালি কোম্পানি কমান্ডার, মহকুমা প্রশাসক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সুবেদার ও হাবিলদারদের নিয়ে  টোগরাইহাটে এক সভায় মিলিত হন। এই সভায় সুবেদার ফজলুর রহমানও ছিলেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভিন্ন কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের বন্দী করে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের রংপুরের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ২৮ মার্চ ইপিআর ক্যাম্পে হানা দিয়ে ১০০ বাঙালি ইপিআর সদস্যকে গ্রেপ্তার করায় ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি সেনারা এ হামলায় পূর্বপরিকল্পনা মতো যোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। রংপুর উইং হেডকোয়ার্টার থেকে যেসমস্ত বাঙালি ইপিআর সদস্য পালাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, তারা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী হয়েছিলেন, নয়তো নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। এরপর ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ তার হেডকোয়ার্টার করলেন কুড়িগ্রামে।   

২৮ মার্চের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০ মার্চ কোম্পানিগুলোকে নানা প্রান্তে মোতায়েন করা হয়। এরমধ্যে বি কোম্পানি অর্থাৎ সুবেদার ফজলুর রহমানের কোম্পানি ছিল তিস্তা নদীর পাড়ে, এ কোম্পানি কুড়িগ্রামকে পেছনে রেখে, সি কোম্পানি সাপটানা চরে, ডি কোম্পানি লালমনিরহাট বিমানবন্দরের কাছে। এরমধ্যে বি কোম্পানিতে ছিলেন সুবেদার ফজলুর রহমান।

১ এপ্রিল সুবেদার ফজলুর রহমানসহ ইপিআরের জওয়ানরা তিস্তা সেতুর ওপর ব্যারিকেড দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর অ্যামবুশ চালিয়ে মেজর এজাজ মোস্তফাসহ ১৫ পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন। 

২ এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর শেলিংয়ে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হলে এদিন সন্ধ্যায় পাকিস্তানি বাহিনী শক্তি সঞ্চয় করে তিস্তা সেতুতে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। এতে সিপাহী এরশাদ আলী ও আতাহার আলী মল্লিক শহীদ হন।

৮ এপ্রিল ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের আহ্বানে এক কনফারেন্সে রংপুরকে সেক্টর হিসেবে ঘোষণা করে সুবেদার ফজলুর রহমানকে সাহেবগঞ্জ সাব সেক্টরে পাঠানো হয়। 

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সাহেবগঞ্জ সাব সেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল কুড়িগ্রাম মহকুমার বেশীরভাগ এলাকা। ৬ নম্বর সেক্টরে এই সাব সেক্টরেই সবচেয়ে বেশী যুদ্ধ হয়েছে। এই সাব সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল ভারতে।

ভুরুঙ্গামারিতে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। জুলাই মাসের শেষ এবং আগস্ট মাসের প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা ২ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভুরুঙ্গামারি পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন।

এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সুবেদার ফজলুর রহমান। এই যুদ্ধের পর ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে পাটগ্রাম সাব সেক্টরের কমান্ডার করে সুবেদার মেজরের দায়িত্ব দেওয়া হয় ফজলুর রহমানকে।

মুক্তিযুদ্ধে সীমান্তবর্তী পাটগ্রাম সাব সেক্টর এলাকা ছিল বড়খাতা, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ ও পাটগ্রাম এলাকা নিয়ে গঠিত। পাটগ্রাম সাব সেক্টরের আওতাধীন বুড়িমারীতে ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের সেক্টর হেডকোয়ার্টার।

হাতীবান্ধা থানা সদরে ছিল পাকিস্তানিদের শক্তিশালী অবস্থান। এই ক্যাম্পে ছিল ২ কোম্পানি পাকিস্তানি সেনা, ২ কোম্পানি ইপিসিইএফ এবং ১ হাজার ৪শ'র বেশি রাজাকারের এক বিশাল বাহিনী। তাদের কভারিংয়ে ছিল সম্পূর্ণ আর্টিলারি ব্যাটারি, কামান, হেভি মেশিনগান, ২ ও ৩ ইঞ্চি মর্টার, রকেট লঞ্চার এলএমজিসহ নানা অস্ত্র। শিঙ্গিমারিতে এসময় ছিলেন কোম্পানি সুবেদার ফজলুর রহমান ও তার বাহিনী এবং এর পশ্চিম পাশে সুবেদার মেজর বোরহানউদ্দিনের বাহিনী, পশ্চিমে ছিলেন মেসবাহউদ্দিন এবং তার এফএফ কম্বাইন্ড বাহিনী, তার পাশে সুবেদার মেজর আবদুল মালেক ও তার বাহিনী। পাশেই ছিলেন সুবেদার মেজর গোলাম মোস্তফার বাহিনী। তিস্তার অপর পাড়ে প্রটেকশন দেওয়ার জন্য ছিল সুবেদার মেজর নাজমুল হকের নেতৃত্বে এফএফদের আরও একটি কোম্পানি। মুক্তিযোদ্ধাদের এই কোম্পানিগুলোতে সর্বমোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিলেন ৩০০। মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে ছিল মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি।   

২৭ সেপ্টেম্বর ভোরে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের ফায়ারিং শুরুর মাধ্যমে আক্রমণ শুরু হয়। এদিন সারাদিন যুদ্ধ চলে। বিকেলে উভয়পক্ষের গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যার দিকে নিঃশব্দে অ্যাডভান্স করে সুবেদার ফজলুর রহমান তার গ্রুপকে পাকিস্তানিদের ডিফেন্স লাইনের দিকে কয়েকশ গজ টেনে নিয়ে যান। সুবেদার ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরা পজিশন নিয়ে ফায়ার শুরু করে দেন।  ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান গোটা বাহিনীকেই এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তারা মুহূর্তের মধ্যেই বাঙ্কার ছেড়ে সামনের দিকে দৌড়াতে শুরু করেন। এসময় পাকিস্তানিরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। সন্ধ্যা ৭টার মধ্যেই যুদ্ধের মোড় মুক্তিবাহিনীর পক্ষে চলে আসে। সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী আর্টিলারি হামলা চালানো শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় ছত্রভঙ্গের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। পাকিস্তানিদের সেনা সংখ্যা কিছুক্ষণের মধ্যেই চতুর্গুণ বেড়ে গেলেও মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কার ছেড়ে বের হননি। কেউ যেন মনোবল না হারায়, একটি বাঙ্কার থেকে আরেকটি বাঙ্কারে যুদ্ধরত সেনাদের দিকে গিয়ে সাহস জোগান ক্যাপ্টেন মতিউর। এরইমধ্যে চলে বৃষ্টির মতো শেলিং আর মেশিনগানের গুলি।

রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে পাকিস্তানিদের মুখোমুখি বাঙ্কার থেকে ওয়্যারলেসে সুবেদার ফজলুর রহমান বলেন, তিনি নিজ বাঙ্কারে আহত হয়েছেন। সেখানে পাকিস্তানিদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে আরও এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। বাকিরাও এখন জানবাজি রেখে লড়াই করছে। সুবেদার ফজলুর রহমানকে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান আহত কীরূপ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, 'আমার আঘাত সামান্য। আমার ছেলেদের এখনো জানতে দিইনি। প্রত্যেককে নিজ নিজ বাঙ্কার থেকে বীরত্বের সঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে যেতে বলেছি। আমার আহত হওয়ার খবর তারা যেন না পায়।'

কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান নিখুঁতভাবে জেনে নিলেন ফজলুর রহমানের বাঙ্কারটি ফ্রন্টলাইনের কোথায়। প্রায় ৬০০ গজ পেছনে ছিলেন মতিউর রহমান। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিজ দায়িত্ব দিয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন। সম্মুখ দিক থেকে তখন ধেয়ে আসছিল শত্রুসেনাদের  মেশিনগানের গুলি আর মর্টারের গোলা। তার মধ্যেই ফজলুর রহমানকে বাঁচাতে ২ সহযোদ্ধাসহ দ্রুত ক্রলিং করতে লাগলেন তিনি। এরইমধ্যে ওয়্যারলেসে ক্ষীণ হয়ে আসছে ফজলুর রহমানের গলা। ক্রমশ জড়িয়ে আসছিল তার কণ্ঠ। ওয়্যারলেসে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান জানান, তিনি কিছুক্ষণের মধ্যে তার কাছে পৌঁছে যাবেন। ফজলুর রহমানের বাঙ্কারে পৌঁছানোর আগেই ঢলে পড়ে যান ফজলুর রহমান। শহীদ হন সুবেদার  ফজলুর রহমান খন্দকার, বীর উত্তম। তার রক্তে ভিজে যায় হাতীবান্ধার মাটি।

২৭ সেপ্টেম্বরের সেই রাত ছিল মাতৃভূমির জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার লড়াই। এতো অসংখ্য শত্রুসেনার বিরুদ্ধে যেখানে টিকে থাকাই ছিল আশ্চর্যজনক, সেখানে অবিস্মরণীয় বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। যতক্ষণ গুলি ছিল ফায়ার করে গেছেন। এক ইঞ্চি পরিমাণ ও পিছু হটেননি মুক্তিযোদ্ধারা।

ফজলুর রহমানের খন্দকারের জন্ম বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার আউলিয়াপুর গ্রামে ১৯৩০ সালে। ১৯৫০ সালে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে যোগ দেন তিনি।  

সূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ৬

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ১০ম খণ্ড

আহমাদ ইশতিয়াক

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

How a 'Dervish Baba' conjured crores from a retired nurse

Want to earn easy money? Just find someone who thinks their partner is cheating on them, then claim to be a “Genie King” or “Dervish Baba,” and offer solutions to “relationship problems” for a fee

6h ago