আটকে থাকা থেকে উদ্ধার, সেই ৯ বাংলাদেশির রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা

‘গত কয়েকটি দিন কীভাবে কেটেছে তা কারও পক্ষে বলা সম্ভব না। বেঁচে থাকাটা এখন অলৌকিক ঘটনা মনে হচ্ছে। ইউক্রেনের সুমি থেকে গতকাল আমরা যখন বের হচ্ছিলাম, তখন অন্তত ৫০টি রাশিয়ান ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান শহরটিতে ঢুকছিল। এখন হাসতে হাসতে কথা বললেও সেই আতঙ্ক-ভয় কতটা ভয়ঙ্কর—তা বোঝাতে পারব না।’

'গত কয়েকটি দিন কীভাবে কেটেছে তা কারও পক্ষে বলা সম্ভব না। বেঁচে থাকাটা এখন অলৌকিক ঘটনা মনে হচ্ছে। ইউক্রেনের সুমি থেকে গতকাল আমরা যখন বের হচ্ছিলাম, তখন অন্তত ৫০টি রাশিয়ান ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান শহরটিতে ঢুকছিল। এখন হাসতে হাসতে কথা বললেও সেই আতঙ্ক-ভয় কতটা ভয়ঙ্কর—তা বোঝাতে পারব না।'

কথাগুলো বলছিলেন, সুমি শহর থেকে উদ্ধার হওয়া ৯ বাংলাদেশির একজন, ব্যবসায়ী রুবায়াত হাবিব। 

বুধবার (৯ মার্চ) বিকেল ৩টার দিকে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় রুবায়াত হাবিবের সঙ্গে। তখন তারা সুমি শহর থেকে সীমান্ত শহর লিভিভে যাচ্ছিলেন। এই ৯ জনকে নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কয়েকটি সংবাদ প্রকাশ করেছে।

ছবিতে ৯ বাংলাদেশির ৩ জন, ট্রেনে ইউক্রেনের সীমান্ত শহর লাভিভে যাচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ান আগ্রাসন শুরুর পর সুমি শহরে তারা একধরনের অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন। কখনো বাসায়, কখনো বাঙ্কারে কেটেছে তাদের দিন-রাত।

গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে ইউক্রেনের সুমি শহরে আটকে থাকা নিজেদের নাগরিকদের সঙ্গে এই ৯ বাংলাদেশিকে রেডক্রসের সহায়তায় উদ্ধার করেছে ভারতীয়রা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ জন্য টেলিফোনে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে।

১২ বছর ধরে ইউক্রেনে বসবাসরত আইটি কনসালটেন্ট রুবায়াত হাবিব কীভাবে সুমি শহর ছাড়লেন সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছিলেন, 'গতকাল সকাল ৯টার দিকে আমরা ইউক্রেনের বাসা-বাঙ্কার থেকে বের হই। ৭০০ ভারতীয় শিক্ষার্থী ও আমাদের ৯ জন বাংলাদেশির জন্য ৫০টি বাস অপেক্ষা করছিল। ৫০টি বাসে আমরা রওনা হই। প্রথমে আমাদের বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয় পোলতাবা নামের একটি স্থানে। পোলতাবায় পৌঁছানোর জন্য সময় লাগার কথা ৩ ঘণ্টা। কিন্তু আমাদের পোলতাবায় পৌঁছতে সময় লাগে ১২ ঘণ্টা।'

৪ গুণ বেশি সময় কেন লাগল সে বিষয়ে রুবায়াত বলেন, '৫০টি বাস একসঙ্গে যাওয়ার জন্য কিছুটা ধীরে চালাতে হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার জন্যে যে গ্রিন চ্যানেল করে দিয়েছে সেটি ঘোরা পথ। আমরা সকাল ৯টায় রওনা দিয়ে রাত ৯টায় পোলতাবা পৌঁছাই।'

'৫০টি বাসের প্রতিটিতে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী ছিলাম। সারাক্ষণ ছিল গুলি-বোমা-মৃত্যুর আতঙ্ক।'

রুবায়াত, তার স্ত্রী এবং ২ সন্তানের সবার বসার জন্য আসন ছিল না বাসে।

'দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা যাত্রার পুরোটা সময় আমি ও আমার স্ত্রী দাঁড়িয়ে থেকেছি। ২ সন্তানকে সিটে বসিয়ে পথ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় কেটেছে ১২ ঘণ্টা। বেঁচে থাকার আনন্দের কাছে এই কষ্ট যেন কিছুই না। বেঁচে থাকব, একটা সময়ে তো এমন আশাই করতে পারছিলাম না,' বলছিলেন রুবায়াত হাবিব।

পোলতাবা থেকে ট্রেন ছাড়ার পর কিছুটা স্বস্তি ফিরতে থাকে উল্লেখ করে রুবায়াত বলছিলেন, 'আমরা এখন ইউক্রেনের সীমান্ত শহর লিভিভের কাছাকাছি চলে এসেছি। এই অঞ্চলের পরিস্থিতি শান্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে লিভিভে পৌঁছাব। এখন ভয়, মৃত্যু আতঙ্ক অনেকটাই কেটে গেছে। লিভিভে ট্রেন থেকে নেমে বাসে আবার ৬ ঘণ্টার যাত্রা শেষে পৌঁছাব ইউক্রেন-পোল্যান্ড সীমান্তে। রেডক্রস এবং ভারতীয়রা সব ব্যবস্থা করবে।'

কথাগুলো বলার সময় মনে হচ্ছিল যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ছেন তিনি। যেন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে জীবন ফিরে পেয়েছেন।

সীমান্ত থেকে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে যেতে তাদের আরও অন্তত ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় লাগবে।

সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে বেসামরিক নাগরিকদের বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে রাশিয়া। এই সাময়িক বিরতির মধ্যেই চলছে আক্রমণ। দীর্ঘ যাত্রা পথে কোনো ধরনের সমস্যার মুখে পড়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের বাস-ট্রেনে রেডক্রসের চিহ্ন দেওয়া আছে। যুদ্ধবিরতিতে রাশিয়া ও ইউক্রেনীয় বাহিনীর সম্মতিতেই আমাদের গাড়িগুলো চলেছে। যে কারণে কোনো বাহিনীর বাধার মুখেই আমরা পড়িনি, কেউই আমাদের আটকায়নি।'

যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই কী সুমি শহরে বাঙ্কারে ছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'পুরো সময় না, যখনই সাইরেন শুনতে পেতাম তখনই বাঙ্কারে ঢুকে যেতাম। সাইরেনের শব্দে চারিদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ত। জীবনে কোনোদিন এমন অভিজ্ঞতার মুখামুখি হতে হবে—স্বপ্নেও ভাবিনি। যা কল্পনা করা যায় না, তেমন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে বেঁচে ফিরলাম। সাজানো একটা দেশ চোখের সামনে তছনছ হয়ে গেল। প্রতিদিন প্রায় ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা বাঙ্কারে থাকতে হয়েছে। রাশিয়ার বোমার আঘাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ক্ষতি হওয়ায় মাঝে ২ দিন বিদ্যুৎ ছিল না, পানি ছিল না। মাইনাস ৫ ডিগ্রির নিচে এখানকার তাপমাত্রা। হিটিং সিস্টেম ছাড়া ওই ২ দিন যে কী কষ্ট হয়েছে তা বোঝাতে পারব না।'

স্ত্রী ও ২ সন্তান নিয়ে সুমি শহরে বসবাস করছিলেন রুবায়াত। সেখানেই তার ব্যবসা। বাসা ছেড়ে আসার দিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, 'আমরা বাসা ছেড়ে শেল্টারে আসার কিছু সময় পরেই ওই এলাকায় বোম্বিং হয়েছে। আমার বাসা থেকে ১৫০ মিটার দূরে রাশিয়া বোমা বর্ষণ করেছে। বোমার আঘাতে ২ শিশুসহ ২২ জন মারা গেছেন। এই খবর যখন পেলাম তখন বেঁচে যাওয়ায় আনন্দিত হব, নাকি এতগুলো মানুষের মৃত্যুতে দুঃখিত হব বুঝতে পারছিলাম না। একেবারে হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। আমাদের বাসার এত কাছে বোমা ফেলা হয়েছে, চলে আসার সুযোগ না পেলে ২২ জনের মধ্যে হয়তো আমরাও থাকতাম! কত জীবন কত সংসার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কয়েকদিনের যুদ্ধে। ইউক্রেনের মানুষের ভাগ্যে সামনে যে আরও কী অপেক্ষা করছে!'

পোল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লার কাছে তাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এর আগে এই ৯ জনের মধ্যে থাকা ৪ মেডিকেল শিক্ষার্থীও বারবার বলেছেন রাষ্ট্রদূতের কথা। রাত-দিন ঠিক ছিল না, সারাক্ষণ রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। রাত ৩-৪টায় ফোন করেও তারা রাষ্ট্রদূতকে পেয়েছেন। তিনি তাদের সাহস যুগিয়েছেন, উদ্ধারে কাজ করেছেন। বাংলাদেশি সবাই ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ পোল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লার কাছে। বারবার সেই কথাই বলছিলেন রুবায়াত।

তিনি বলেন, 'আমি বিশ্বের অনেক দেশে গিয়েছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লার মতো কাউকে পাইনি। বাংলাদেশিদের প্রতি তার যে ভালোবাসা, যে দরদ তা আর কোনো রাষ্ট্রদূতের মাঝে কোনোদিন দেখিনি। প্রথম থেকে প্রতিনিয়ত তিনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে গেছেন। তিনি আমাদের মানসিক সাপোর্ট দিয়ে গেছেন, সব সময় জানিয়েছেন যে, যত দ্রুত সম্ভব আমাদের উদ্ধারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি আমাদের জন্য যেভাবে কাজ করে গেছেন… আমরা তার প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ। এই ঋণ শোধ করা সম্ভব হবে না কোনো দিন।'

পোল্যান্ড সীমান্তের দিকে যত এগোচ্ছেন, ততই যেন নির্ভার হচ্ছেন রুবায়াত। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার আনন্দ যেন তাকে আচ্ছন্ন করছে, নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার সত্যিকারের আনন্দ।

রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুধু এই ৯ জন নয়, ইউক্রেনের যেখানে বাংলাদেশিরা আটকে আছেন তাদের সবাইকে সরিয়ে আনার জন্য কাজ করছি। এই ৯ জনকে উদ্ধারে আমরা সব সময় রেডক্রসসহ সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলাম। ভারতীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে অনুরোধ করেছিলাম, আমাদের ৯ জনকে যেন তাদের সঙ্গে নিয়ে আসা হয়। রেডক্রসকেও এ কথা বলেছিলাম। রেডক্রসের সহায়তায় ভারতীয়রা আমাদের ৯ জন নাগরিককে সরিয়ে এনেছে। এ জন্য আমরা তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছি।'

কিয়েভসহ আরও কিছু স্থানে বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক নাগরিক আটকে আছেন। তাদের সরিয়ে আনার বিষয়ে রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা বলেন, 'কিয়েভে ২৫ জনের মতো বাংলাদেশি আছেন। তারা অনেক বছর ধরে আছেন। তাদের ব্যবসা-চাকরি-গাড়ি-সংসার সবকিছু সেখানে। সবকিছু ছেড়ে তারা এখনই সরে আসতে চাইছেন না। তাদের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে। সম্মতি দিলেই তাদের সরিয়ে আনা হবে।'
 

Comments

The Daily Star  | English

Unrest emerges as a new threat to RMG recovery

The number of apparel work orders received by Bangladeshi companies from international retailers and brands for the autumn and winter seasons of 2025 dropped by nearly 10 percent compared to the past due to major shocks from the nationwide student movement and labour unrest in major industrial belts over the past two and half months.

11h ago