ইউক্রেন থেকে রোমানিয়া হয়ে যেভাবে বাংলাদেশের পথে ২৮ নাবিক

উদ্ধারকারী জাহাজে বাংলাদেশি নাবিকেরা। ছবি: সংগৃহীত

অবশেষে দেশে ফিরছেন ইউক্রেনে বাংলাদেশি জাহাজে হামলা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া ২৮ নাবিক। গত ২ মার্চ জাহাজে রকেট হামলায় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান তারা।

আগামীকাল বুধবার দুপুর নাগাদ তারা ঢাকা পৌঁছাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

তবে তাদের মতো ভাগ্য সহায় হয়নি জাহাজে তাদের আরেক সহকর্মী নাবিক হাদিসুর রহমানের। 'বাংলার সমৃদ্ধি' জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর প্রাণ হারান। প্রায় ২১ ঘণ্টা পর জাহাজটি থেকে নাবিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে একটি বাংকারে আশ্রয় পান তারা।

দুই দিন পর মলদোভা হয়ে রোমানিয়া পৌঁছান তারা। গতরাতে একটি বিশেষ ফ্লাইটে বাংলাদেশের উদ্দেশে বুখারেস্ট ত্যাগ করেছেন বাংলাদেশি জাহাজ ক্রুরা।

রোমানিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. দাউদ আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, টার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ ফ্লাইটে জাহাজের ২৮ ক্রুর সবাই দেশে ফিরবেন।‌

'ইস্তাম্বুলে বিরতি নিয়ে তারা ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করবেন। আশা করা যাচ্ছে, কাল দুপুর নাগাদ তারা ঢাকায় থাকবেন,' বলেন তিনি।

'নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারলেও জাহাজে হামলা ও এক সহকর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।'

জাহাজের এক ক্রুর সঙ্গে ডেইলি স্টার কথা বলেছে। যিনি রোমানিয়া থেকে ফোনে জানিয়েছেন সেখানে কী ঘটেছিল।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি জাহাজটি তুরস্কের কারাদেনিজ এরেগলি বন্দর থেকে ইউক্রেনের ওলভিয়া বন্দরে যায়।‌ সেখান থেকে ইতালিতে সিমেন্ট ক্লে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তাদের।

পরের দিনই জাহাজটি ইউক্রেনের বন্দরে পৌঁছায়।

গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাহাজের ওই ক্রু জানান, 'আমরা যখন বন্দরে পৌঁছালাম তখন সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। ২৪ ফেব্রুয়ারি, রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করে।'

এরপর জাহাজটি ওই বন্দরেই আটকে থাকে।

তবে ২ মার্চ আটকে থাকার হতাশা পরিণত হয় ভয় আর আতঙ্কে।

নাবিক বলেন, 'বিকাল ৫টা ৫ মিনিটের দিকে একটি ক্ষেপণাস্ত্র জাহাজে আঘাত হানে। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান সেই সময় নেভিগেশন ব্রিজে ছিলেন, ফোনে কথা বলছিলেন।'

সেসময় সহকারী প্রধান প্রকৌশলী, সেকেন্ড অফিসার ও ডেক ক্যাডেটও সেখানে ছিলেন।

হামলার পরপরই জাহাজে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তিন জন প্রাণে বাঁচলেও হাদিসুর ফিরতে পারেননি।

'আমি হাদিসুরের কাছ থেকে মাত্র ১০ ফুট দূরে ছিলাম। আমিও ফোনে কথা বলছিলাম। আমি ভেবেছিলাম আমি আমার পা হারিয়েছি। ধাতস্ত হতে আমার প্রায় ৩০ সেকেন্ড সময় লেগেছিল। তারপরই বুঝতে পারি আমি আঘাত পাইনি। পুরো জাহাজটাই প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছিল। তখনও আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না হাদিসুর মারা গেছে,' বলেন তিনি।

জাহাজের সবাই আগুন নেভাতে শুরু করে। প্রায় তিন ঘণ্টা লেগেছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে।

তারপর তারা জাহাজের সবচেয়ে নিচে ইঞ্জিন কন্ট্রোল রুমে যান, যাকে জাহাজের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান বলে ধরা হয়।

'আমাদের নিয়ম অনুসারে যখন মাথা গোনা শুরু হয় তখনই আমরা বুঝতে পারলাম হাদিসুর নেই,' ধরে আসা গলায় বলছিলেন এই নাবিক। 

'আমরা ইঞ্জিন রুম থেকে সবাই বেরিয়ে আসি। নেভিগেশন রুমের দিকে যাই হাদিসুরকে খুঁজতে।'

'আমি ভেবেছিলাম ও পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে এবং বেঁচে গেছে। কিন্তু তা হয়নি। আমরা ওর মরদেহ খুঁজে পাই।'

হামলার পরপরই জেনারেটর নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে জাহাজের বিদ্যুৎ ছিল না।

'আমরা সারারাত কন্ট্রোল রুমে কাটাই। এতো ভয়ঙ্কর এক সময় আমরা পার করেছি সেই সঙ্গে সহকর্মীকে হারানোর কষ্ট। কারও সঙ্গে যোগাযোগের কোনো উপায়ও ছিল না।'

পরের দিন দুপুর আড়াইটায় জাহাজ থেকে তাদের উদ্ধার করে একটি টাগবোটে করে নিরাপদ বাংকারে নিয়ে যাওয়া হয়।

'আমরা সেখানে দুই দিন ছিলাম। সেখানে আমাদের ইন্টারনেট সংযোগ ছিল। কিন্তু আমরা জাহাজ থেকে আমাদের কোনো জামাকাপড় সঙ্গে আনতে পারিনি।'

বাংলাদেশ সরকার, কয়েকজন বাংলাদেশি প্রবাসী এবং ইউক্রেন বন্দর কর্তৃপক্ষের সহায়তায় জাহাজ থেকে নাবিকদের উদ্ধার করে।

বাংলাদেশ সরকার ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি পাঠায় যাতে জাহাজটি পরিত্যক্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়, যা উদ্ধার কাজকে সহজ করে।

জাহাজের ক্রুরা ৫ মার্চ পর্যন্ত বাংকারে ছিলেন। আরও একদিন আগে তাদের মলদোভা সীমান্তে পৌঁছানোর কথা ছিল। তবে নিরাপত্তার অভাবে সেটি আর হয়নি।

৫ মার্চ তারা সবাই দুটি মাইক্রোবাসে সকাল সোয়া ৮টার দিকে মলদোভা সীমান্তের দিকে যাত্রা শুরু করেন। তবে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছাড়পত্র পেতে চার ঘণ্টা লেগে যায়।

মলদোভা সীমান্তে যাওয়ার পথে মোট ১৭টা সামরিক চেকপোস্ট পার হতে হয় তাদের। ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে ইউক্রেনীয় সেনারা তাদের সঙ্গে ছিলেন।

জাহাজের নাবিক জানান, 'সবগুলো চেকপয়েন্ট ইউক্রেনের সেনারা নিয়ন্ত্রণ করছিল। তারা আমাদের অনেক সাহায্য করেছে।'

তিনি বলেন, 'আমরা ৬ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে মলদোভার পালানকাকে ঢুকি এবং মলদোভা-রোমানিয়া সীমান্তে পৌঁছাই ভোর সাড়ে ৫টার দিকে। তার এক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা রোমানিয়া সীমান্ত পার হই এবং দুপুর ১টার দিকে বুখারেস্টে পৌঁছাই।'

ইউক্রেন থেকে রোমানিয়ায় তাদের যাওয়ার পথে মলদোভা এবং রোমানিয়া দুই দেশের অভিবাসন কর্মকর্তারাই জাহাজের নাবিকদের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন এবং দ্রুত সীমান্ত অতিক্রম করতে সাহায্য করেন বলেও জানান বাংলাদেশি এই নাবিক।

'আমরা যখন বুখারেস্টের হোটেলে পৌঁছাই, তখন আমরা ভীষণ ক্লান্ত। কিন্তু নিরাপদ একটি জায়গায় পৌঁছাতে পেরে তার স্বস্তিও ছিল। নিরাপদে ফিরে আসার জন্য যারাই আমাদের সাহায্য করেছেন সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা আমাদের নেই।

গত ৭ মার্চ রাতে তারা রোমানিয়ায় বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের বাসায় রাতের খাবার খেয়েছেন।

নাবিক বলেন, 'মিসাইল'হামলার পর থেকে আমরা বুখারেস্টের হোটেলে পৌঁছনো পর্যন্ত, কেউই ঠিকমতো খেতে পারিনি।

'জাহাজ ছেড়ে আসার সময় আমরা আমাদের সাথে কিছু শুকনো খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা কিছু বিস্কুট, মুড়ি, আলু আর গম খেয়ে চার দিন বেঁচে ছিলাম।'

'আমরা সবাই মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। এটি নতুন করে জীবন ফিরে পাওয়া। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমাদের জন্য দোয়া করুন যাতে আমরা নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছাতে পারি।'

Comments

The Daily Star  | English
Major trade bodies miss election deadline

Major trade bodies miss election deadline as reforms take centre stage

Elections at major trade bodies have missed the 90-day deadline as new administrators of the business organisations seek amendments to the governing rules.

18h ago