একজন লেখকও সামাজিক সংকটের মধ্যেই বাস করেন
চলছে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে তাম্রলিপি প্রকাশনী থেকে এসেছে কথাসাহিত্যিক বাদল সৈয়দের 'দ্বিতীয় যৌবন' বাতিঘর থেকে 'বুড়ো নদীটির পায়ের কাছে'। তিনি বইমেলা ও নিজের গল্প নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।
দ্য ডেইলি স্টার: আপনার গল্পগুলো মনস্তাত্বিক চিন্তাধারার। সেখানে সামাজিক সংকট আসে। সামাজিক মুক্তি বিষয়টা লেখক হিসেবে কতটা ভাবায়?
বাদল সৈয়দ : একজন লেখক চারপাশে বিরাজমান সামাজিক সংকট থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন না। কারণ নিজেও সামাজিক সংকটের মধ্যেই বাস করেন। প্রতিটি সংকটের আবার মনস্তাত্বিক দিক আছে। তাই সব লেখকের লেখাতেই সামাজিক সংকট এবং এর সাথে জড়িত মনস্তাত্বিক ব্যাপারটি উঠে আসে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই।
তাছাড়া আমি সামাজিক মুক্তি ভাবনায় জীবন যাপন করি এবং আমি বিশ্বাস করি ভাবলে, কাজ করলে সামাজিক মুক্তি সম্ভব। আর আমি সবসময় আমার চরিত্রগুলোর মধ্যে সামাজিক সংকট একই সাথে এর মনস্তত্ব বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিভিন্ন সংকটে মানব আচরণ কী ধরনের হতে পারে তা ফুটিয়ে তুলি, আগামীতেও তা করে যেতে চাই।
আপনার গল্পে গতানুগতিকতার বাইরের বিষয় থাকে, লেখার উপকরণ কীভাবে সংগ্রহ করেন?
বাদল সৈয়দ : গতানুগতিকতার বাইরের বিষয় আমাকে আকৃষ্ট করে, ভাবায়। মাঝে মাঝে পাঠককে জানাতেও ইচ্ছে করে। সেই ইচ্ছে ও আগ্রহ থেকে উপকরণ সংগ্রহ করি।
প্রসঙ্গত অঞ্জন দত্তের গানের 'বেলা বোস' কে তা জানতে ইচ্ছে করে, তাকে আবিষ্কার করা নিয়ে গল্প লেখতে ইচ্ছে করে। আবার লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিখ্যাত ছবি 'মোনালিসা'-এর মডেল লিসা গারদিনির সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির সাথে যে বংশলতিকার একটি সম্পর্ক আছে- তা নিয়ে খুব ভালো গল্প হতে পারে বলে আমার ধারণা। তাই এ সম্পর্কে জানার জন্য আমি এমনকি ফ্লোরেন্স পর্যন্ত গিয়েছি, বইপত্র পড়েছি, তারপর এ নিয়ে গল্প লিখেছি।
মোদ্দা কথা হলো, গতানুগতিক বিষয় আমার তেমন টানে না, পড়াশুনা করে নতুন বিষয় তুলে আনতে ভালো লাগে। এজন্য আমার সাম্প্রতিক উপন্যাস 'বুড়ো নদীটির পায়ের কাছে;- এর বিষয়বস্তু মূলত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং ইন্ড্রাস্টিয়াল এসপিওনিয়াজকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে- যা গতানুগতিক বিষয় নয়।
রাষ্ট্রের বহুমাত্রিক সংকট আছে, একজন সৃষ্টিশীল মানুষ তা কীভাবে দেখেন?
বাদল সৈয়দ : রাষ্ট্রের বহুমাত্রিক সংকট, একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে শুধু ভাবায় না, সাধারণ মানুষকেও ভাবায়। কারণ তিনি এসব সংকটের মধ্য দিয়ে চলেন। তবে পার্থক্য হচ্ছে সৃষ্টিশীল মানুষ এ সংকট লেখার মাধ্যমে তুলে ধরতে সক্ষম। এটি একটি ক্ষমতা, যা সবার নেই। তাই তার উচিত এসব সংকট তুলে ধরা। ব্যক্তিগতভাবে আমি এগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করি। এটা আমাকে তাড়িত করে। আমার প্রায় সব গল্প/উপন্যাসে এসব সমস্যা এসেছে। কিছু জীবনভিত্তিক বই লিখেছি, সেখানেও এ সমস্যাগুলো, এ থেকে উত্তরণের কথাবার্তা এসেছে। আছে প্রেরণার গল্প।
আপনার লেখার চরিত্র বাস্তবতা থেকে কতটা নেন, আর কতটা নির্মাণ করেন?
বাদল সৈয়দ : চরিত্রগুলো কখনো বাস্তবতা থেকে উঠে আসে, কখনো কল্পনা থেকে। তবে সত্যি বলতে কী আমার মনে হয় একেবারে অকৃত্রিম মৌলিক চরিত্র বলে কিছু নেই। যখনই কোনো চরিত্র সৃষ্টি করি কোনো না কোনো বাস্তব চরিত্র তাতে প্রভাব ফেলে- তবে আমি বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে চরিত্র নিয়ে খেলতে পছন্দ করি। সাম্প্রতিক 'দ্বিতীয় যৌবন' বইটিতে আমি এ চেষ্টাই করেছি।
ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চা কতটা সমর্থন করেন? গোষ্ঠীপ্রীতি সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর কি?
বাদল সৈয়দ : ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চা একেবারেই সমর্থন করি না। সাহিত্যের কোনো কেন্দ্র কেউ নির্ধারণ করতে পারে না। কেউ কি এটা ঠিক করে দিতে পারেন যে, অমুক এলাকার বাগানেই শুধু সেরা ফুল ফুটবে? পারেন না। ঠিক তেমন সাহিত্যের ক্ষেত্রেও আপনি বলতে পারেন না অমুক শহরেই শুধু সেরা লেখা রচিত হবে। মালি ভালো হলে দূর গ্রামের বাগানে যেমন সবচে সুন্দর ফুল ফুটবে, তেমনি লেখক ভালো হলে যেকোনো জায়গায় সেরা লেখা রচিত হবে। লেখককে ভৌগলিক সীমায় আবদ্ধ করার চেষ্টা মূর্খতা।
গোষ্ঠীপ্রীতি সাহিত্যের জন্য চিরকালই ক্ষতিকর ছিলো। যে কোনো লেখককে ভৌগলিক সীমায় আবদ্ধ করার চেষ্টা এক ধরনের মূর্খতা।
Comments