ইউক্রেনে ক্যাম্পে আটক বাংলাদেশিরা ‘মানব ঢাল’
জুরাভিস। ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী একটি শহর। ইউক্রেন-বেলারুশ সীমান্ত থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। জুরাভিস থেকে পোল্যান্ড সীমান্তের দূরত্বও প্রায় একই। এই শহরের একটি ক্যাম্পে, যেটি আগে ছিল ডিটেনশন সেন্টার, আটকে আছেন বিভিন্ন দেশের নারী ও শিশুসহ মোট ১২০ জন মানুষ। তাদের মধ্যে ৫ জন বাংলাদেশি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে দেশটি ছেড়ে লাখো মানুষ পাড়ি জমাচ্ছেন আশেপাশের দেশগুলোতে। কিন্তু এই ১২০ জন মানুষ নিরাপদ জায়গায় যাওয়া তো দূরে থাক এই ক্যাম্প থেকে বেরই হতে পারছেন না। তাদের অভিযোগ, 'মানব ঢাল' হিসেবে ব্যবহার করতেই তাদেরকে এখানে আটকে রাখা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা হয় ক্যাম্পে আটকে থাকাদের একজন রিয়াদ মালিকের সঙ্গে। তিনি জানান, এই ডিটেনশন সেন্টারে আগে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকলেও যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সেগুলো আর নেই। খাবার, পানি, বিদ্যুৎসহ সব বিষয়েই সংকটে রয়েছেন তারা।
তিনি বলেন, 'আমাদের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে, আমাদের ফোন কেড়ে নিয়েছে। আমার এই ফোনটি লুকিয়ে রেখেছিলাম বলে আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারছি। আমরা কোনো মিডিয়ার সঙ্গে যেন যোগাযোগ করতে না পারি সে জন্যই ফোন নিয়ে নিয়েছে। আমাদেরকে তারা এখানে আটকে রেখেছে, জিম্মি করে রেখেছে। আমাদেরকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ঠিকমতো খেতেও দেওয়া হচ্ছে না।'
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিচালনাধীন এই ক্যাম্পে যারা আছেন তারা অনেক খারাপ অবস্থায় আছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'আমাদের এই ক্যাম্পের চারপাশে ইউক্রেন সামরিক বাহিনীর অনেক সদস্য জড়ো হয়েছেন, প্রায় ৫ হাজারের মতো হবে। রাশিয়া বোমা বা ক্ষেপনাস্ত্র মারলে আমরা সবাই মারা যাব। তখন ইউক্রেন বলবে, রাশিয়া বেসামরিক নাগরিক হত্যা করছে। আমরা এখন মানব ঢালে পরিণত হয়েছি।'
ক্যাম্প থেকে বোমাবর্ষণ ও গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছেন তারা। এখন পর্যন্ত কোনো আঘাত না এলেও নিশ্চিত মৃত্যুর জন্যই যেন দিন গুনছেন এই মানুষগুলো।
রাশিয়া বরাবরই বলে আসছে বেসামরিক মানুষ তাদের লক্ষ্য নয়। সামরিক বাহিনীকে লক্ষ্য করে রুশ সেনারা এই এলাকায় হামলা চালালে 'মানব ঢাল' এই ১২০ জনের মধ্যে অনেকে বা সবাই মারা যেতে পারেন।
রাশিয়া বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করছে না এবং ইউক্রেনীয় সেনারা আক্রমণ না করে আত্মসমর্পণ করলে তাদেরও রুশ সেনারা হত্যা করছে না বলে জানান দেশটির একটি ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশি।
কাজের খোঁজে ইউরোপ পাড়ি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশিরা বিভিন্ন রুট ব্যবহার করে। তার মধ্যে অন্যতম রাশিয়া। রাশিয়া থেকে ইউক্রেন হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করেন অনেকেই। এই রুট ধরেই ইউরোপের উদ্দেশে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন রিয়াদ।
উদ্ধার পাওয়ার আশায় পোল্যান্ডে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন রিয়াদ মালিক। কিন্তু সেখান থেকে সব শুনে 'ঠিক আছে' বলা হলেও কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কি না তা তাদের জানানো হয়নি বলে অভিযোগ তার।
রিয়াদ মনে করেন, 'আমাদের এখান থেকে উদ্ধার করার জন্যে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ দরকার। সরকার যদি রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলে, যেভাবে নাবিকদের উদ্ধার করা হলো সেভাবে আমাদের উদ্ধার করতে পারে। পোল্যান্ড দূতাবাস কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না।'
'পুরো কিয়েভ, খারকিভসহ সব পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এত বোমা মারা হয়েছে…। বাংলাদেশি জাহাজে বোমা মারা হয়েছে, একজন মারা গেছেন। আজ কিয়েভে, খারকিভে বোমার আঘাতে ভারতীয় শিক্ষার্থী মারা গেছেন,' আতঙ্কগ্রস্ত গলায় গত বৃহস্পতিবার বলছিলেন রিয়াদ।
ইউক্রেনের মিকোলাইভ শহরের অপর একটি ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে আছেন আরও প্রায় ৬০ জন, যাদের মধ্যে ২ জন বাংলাদেশি।
রাশিয়া হয়ে ইউরোপ যাওয়ার উদ্দেশে ২০২০ সালের বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া এই ২ জনকে আদালত ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেও পোল্যান্ড সীমান্ত থেকে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার দূরের এই ক্যাম্পে জোর করে আটকে রাখা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্যাম্পের একজন বাংলাদেশি বলেন, 'এই শহরটি গতকাল রাশিয়া দখল করে নিয়েছে। রাশিয়ার বোমায় স্থানীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংস হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ নেই। তীব্র শীতে হিটিং সিস্টেম চলছে না। এখানে পানি নেই। এত শীতের দেশে হিটার ছাড়া থাকা যে কী কষ্টের তা বুঝাতে পারব না। আমাদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার জন্যই শুধু তারা আটকে রেখেছে।'
ক্যাম্পের অপর বাংলাদেশি জহিরুল ইসলাম। নোয়াখালী জেলার বাসিন্দা জহিরুল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আদালত আমাদের ছেড়ে দিতে বললেও কর্তৃপক্ষ ছাড়ছে না। ছেড়ে দিলে আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারতাম। এখানে যুদ্ধ হচ্ছে, একটু আগেও আমাদের ক্যাম্পের সামনে দিয়ে রাশিয়ান ট্যাংক গেল। ক্যাম্পের ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমান উড়ছে। গতকাল (বুধবার) সারাদিন আমরা বাঙ্কারে ছিলাম।'
বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে জুরাভিস ক্যাম্পে আটকে থাকা রিয়াদ মালিক বলেন, 'জুরাভিস থেকে গাড়ি, বাস ফ্রিতে নিয়ে যাচ্ছে সীমান্তগুলোতে। বাংলাদেশ সরকার যদি উদ্যোগ নেয়, তাহলে আমাদের প্রাণ বাঁচতে পারে।'
Comments