লিটনের সেঞ্চুরি, বোলারদের সম্মিলিত অবদান, কুপোকাত আফগানরা
ব্যাট হাতে সুর বেঁধে দিলেন লিটন দাস আর মুশফিকুর রহিম। লিটন করলেন অনবদ্য এক সেঞ্চুরি। মুশফিক অল্পের জন্য পেলেন না সেই স্বাদ। তাদের কাঁধে চড়ে রানের পাহাড়ে চড়া বাংলাদেশ অনায়াসে সারল বাকি কাজটা। অধিনায়ক তামিম ইকবালের ব্যবহার করা সাত বোলারের সবাই পেলেন উইকেট। তাতে আফগানিস্তানকে বড় ব্যবধানে হারিয়ে এক ম্যাচ হাতে রেখে সিরিজ নিজেদের করে নিল টাইগাররা।
শুক্রবার চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৮৮ রানে জিতেছে বাংলাদেশ। টস জিতে আগে ব্যাট করে নির্ধারিত ৫০ ওভারে তারা তোলে ৪ উইকেটে ৩০৬ রান। জবাবে ৪৫.১ ওভারে ২১৮ রানে অলআউট হয় আফগানরা।
এই জয়ে আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ সুপার লিগের পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে উঠে গেছে বাংলাদেশ। ১৪ ম্যাচে ১০ জয়ে তাদের পয়েন্ট ১০০। প্রথম দল হিসেবে পয়েন্টের সেঞ্চুরি করল তারা। দুইয়ে নেমে যাওয়া ইংল্যান্ডের অর্জন ১৫ ম্যাচে ৯৫ পয়েন্ট। ভারত ১২ ম্যাচে ৭৯ পয়েন্ট নিয়ে রয়েছে তিনে।
৩৪ রানের মধ্যে ৩ উইকেট তুলে লক্ষ্য তাড়ায় নামা আফগানিস্তানকে শুরুতেই চেপে ধরে বাংলাদেশ। ওপেনার রিয়াজ হাসান রানআউট হন আফিফ হোসেনের দুর্দান্ত থ্রোতে। তিনে নামা অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শহিদি শরিফুল ইসলামের কিছুটা শর্ট লেংথের ডেলিভারিতে পরাস্ত হন। উইকেটের পেছনে তার ক্যাচটি নেন মুশফিক। টিকে থাকার চেষ্টা ছিল চারে নামা আজমতউল্লাহ ওমারজাইয়ের। কিন্তু হঠাৎ করেই অধৈর্য হয়ে পড়েন। আগে থেকে পরিকল্পনা করে সাকিব আল হাসানকে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে মারতে গিয়ে হন স্টাম্পড।
অন্যপ্রান্তে রহমত শাহ দেখছিলেন সতীর্থদের আসা-যাওয়া। রহমানউল্লাহ গুরবাজ ফিল্ডিংয়ের সময় চোট পাওয়ায় তার জায়গা হয় ওপেনিংয়ে। চতুর্থ উইকেটে তিনি পান যোগ্য সঙ্গী। নাজিবউল্লাহ জাদরানকে নিয়ে গড়েন দারুণ একটি জুটি।
বিশাল লক্ষ্য সামনে থাকায় দ্রুত রান তোলার তাগিদ ছিল। কিন্তু ১০ ওভারের প্রথম পাওয়ার প্লেতে আফগানরা আনতে পারে কেবল ৩৬ রান। বাংলাদেশ তখন চালকের আসনে। তবে চাপ ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করে জাদরান ও রহমতের ব্যাটে। তারা সামনে থাকা সমীকরণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়াতে থাকেন রান। তাদের ৯০ বলে ৮৯ রানের জুটি ভাঙেন তাসকিন আহমেদ। তার বলে বোল্ড হয়ে যান রহমত।
রহমত অবশ্য আগে এক দফা বেঁচে গিয়েছিলেন বিভ্রান্তিকর আউট থেকে। নন স্ট্রাইক প্রান্তে ক্রিজের বাইরে ছিলেন তিনি। স্ট্রাইকে থাকা জাদরানের শটে ভেঙে গিয়েছিল স্টাম্প। কিন্তু স্টাম্পে লাগার আগে সাকিবের হাতে লেগেছিল কিনা তা নিয়ে তৈরি হয় বিভ্রান্তি। থার্ড আম্পায়ার প্রথমে আউটই দিয়ে দিয়েছিলেন। তবে পরে আরেকবার যাচাই করা হলে দেখা যায়, সাকিবের হাতে লাগেনি বল। সিদ্ধান্ত পাল্টে গেলে রক্ষা পান রহমত।
প্রথমে তাসকিন টেরই পাননি বেল পড়ে যাওয়া। পরে বুঝতে পেরে তিনি মেতে ওঠেন উল্লাসে। রহমত বিদায় নেন ৭১ বলে ৪ চারে ৫২ করে। কিছুক্ষণ না যেতেই আবার তাসকিনের আঘাত। আরেক হাফসেঞ্চুরিয়ান জাদরান গ্লাভসবন্দি হন মুশফিকের। থার্ড ম্যান দিয়ে ঠেলে দিতে গিয়ে জীবন হারান তিনি। ৬১ বলে ৭ চারে তিনি করেন ৫৪ রান।
ম্যাচের লাগাম সরে গিয়ে ক্ষীণ একটা শঙ্কা জেগে উঠতে শুরু করেছিল বাংলাদেশ দলের মনে। তবে তাসকিন জোড়া শিকারে গুরুত্বপূর্ণ ব্রেক থ্রু দেওয়ায় ফের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় টাইগাররা। দলের বিপদে মাঠে নামেন উইকেটরক্ষক গুরবাজ। তবে ত্রাতা হতে পারেননি। সাকিবের বলে ইনসাইড এজে বোল্ড হয়ে যান তিনি। ১৫১ রানে আফগানদের ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের জয় হয়ে যায় কেবল সময়ের ব্যাপার।
এরপর মোহাম্মদ নবি ও রশিদ খান মিলে অপেক্ষা বাড়ান স্বাগতিকদের, ব্যবধান কমান নিজেদের হারের। দুজনই বেশ কিছু বাহারি শট খেলেন। ৪০ বলে ৩২ করে নবি আউট হন মেহেদী হাসান মিরাজের বলে। রশিদের ২৬ বলে ২৯ রানের ইনিংস থামে মোস্তাফিজুর রহমানের কাটারে।
বদলি ফিল্ডার মাহমুদুল হাসান জয় সীমানার কাছে নজরকাড়া ক্যাচে মুজিব উর রহমানকে সাজঘরে ফেরান। এই উইকেটটি নেন মাহমুদউল্লাহ। আর ফজলহক ফারুকিকে বোল্ড করে আফগানদের লড়াই থামান আগের ম্যাচে বাংলাদেশের জয়ের অন্যতম নায়ক আফিফ হোসেন।
প্রথম ওয়ানডের মতো তাসকিন এদিনও ছিলেন দুর্দান্ত। মাঝের ওভারগুলোতে দারুণ সব স্পেল আসে তার কাছ থেকে। ১০ ওভারে ২ মেডেনসহ তিনি ২ উইকেট নেন মাত্র ৩১ রানে। সমান সংখ্যক উইকেট নিতে সাকিবের খরচা ৩১ রান। বাঁহাতি মোস্তাফিজের বিবর্ণ দশা অবশ্য কাটেনি। ৮ ওভারে ১ উইকেট নিতে তিনি দেন ৫৩ রান।
এর আগে লিটন ১২৬ বলে খেলেন ১৩৬ রানের ঝকঝকে ইনিংস। ৪৭তম ওভারে ডানহাতি পেসার ফরিদ আহমাদের বলে ডিপ স্কয়ার লেগে ক্যাচ দেওয়ার আগে তিনি মারেন ১৬ চার ও ২ ছক্কা। পরের বলেই সাজঘরের পথ ধরেন মুশফিক। র্যাম্প শট খেলার চেষ্টায় থার্ড ম্যানে ধরা পড়েন ফারুকির হাতে। ৯৩ বলে ৮৬ রানের ইনিংসে তিনি মারেন ৯ চার। লিটন ও মুশফিক মিলে ১৮৬ বলে যোগ করেন ২০২ রান। ওয়ানডেতে তৃতীয় উইকেটে এটাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জুটি।
৪৬ ওভার শেষে বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল ২ উইকেটে ২৮৪ রান। অর্থাৎ স্কোরবোর্ডে ৩২০ বা এর চেয়েও বেশি রান জমা করার জোরালো সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। শেষ ৪ ওভারে টাইগাররা তোলে মোটে ২২ রান। লিটন ও মুশফিকের বিদায়ের পর থাকেনি দ্রুত গতিতে রান তোলার ধারাবাহিকতা। মাহমুদউল্লাহ ৯ বলে ৬ ও আফিফ হোসেন ১২ বলে ১৩ রানে অপরাজিত থাকেন।
প্রথম ওয়ানডেতে শুরুতেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ দল। বাঁহাতি আফগান পেসার ফারুকির আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল টপ অর্ডার। এদিন দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। ৬ ওভারেই স্কোরবোর্ডে জমা পড়ে ৩৬ রান। তাতে দুই ওপেনার লিটন ও তামিম ইকবালের অবদান অবশ্য ছিল কমই। একাদশে ঢোকা ফরিদের এলোমেলো লাইন-লেংথে অতিরিক্ত রান মেলে অনেক।
সপ্তম ওভারে সাজঘরে ফেরেন অধিনায়ক তামিম। তার আউটটি ছিল আগের ম্যাচের কপি! ফারুকির ভেতরে ঢোকা বলে এলবিডব্লিউ হয়ে যান তিনি। রিভিউ নিয়েছিলেন। তাতে কাজ হয়নি। ২৪ বলে ১২ রানে থামে তার ইনিংস। সাকিবের সঙ্গে জমে গিয়েছিল লিটনের জুটি। তবে বড় হতে পারেনি। লেগ স্পিনার রশিদের সোজা বলে বিদায় নেন সাকিব। স্পিন করবে ভেবে খেলতে গিয়ে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে পড়েন। তার সংগ্রহ ৩৬ বলে ২০ রান।
পরের গল্পটা লিটন আর মুশফিকের। ৮৩ রানে ২ উইকেট পড়ে গেলেও রান তোলার গতি শুরু থেকেই ছিল ভালো। পিচ থেকেও তেমন কোনো সুবিধা আদায় করতে পারছিলেন আফগানিস্তানের বোলাররা। কোনো ঝুঁকি নিয়ে না খেললে এমন উইকেটে রান করা কঠিন নয়। সেই পথেই হাঁটেন লিটন ও মুশফিক। তাদের কাঁধে চড়ে প্রতিপক্ষকে বড় লক্ষ্য ছুঁড়ে দেয় টাইগাররা।
জিম্বাবুয়ের সফরে বাংলাদেশের সবশেষ ওয়ানডে সিরিজে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন লিটন। তিন ইনিংস পর আবার তিনি পেলেন তিন অঙ্কের দেখা। তৃতীয় ওভারেই অবশ্য তার বিপক্ষে এলবিডব্লিউয়ের আবেদন করেছিল আফগানিস্তান। আম্পায়ারের সাড়া না পেয়ে রিভিউও নিয়েছিল। কিন্তু ফারুকির বল লেগ স্টাম্পের বাইরে পড়ায় ধোপে টেকেনি তাদের আবেদন।
রশিদের ফ্লাইটেড ডেলিভারিতে কভারের ওপর দিয়ে চার মেরে ১০৭ বলে সেঞ্চুরিতে পৌঁছান লিটন। তখন পর্যন্ত তার ব্যাট থেকে আসেনি কোনো ছক্কা। মাইলফলক স্পর্শ করার পর আগ্রাসী হয়ে ওঠেন তিনি। পরে মুখোমুখি হওয়া ১৯ বলে করেন ৩৪ রান। অন্যদিকে, মুশফিক ক্যারিয়ারের ৪১তম হাফসেঞ্চুরি স্পর্শ করেন ৫৫ বলে। তিনিও রশিদকে চার মেরেই পৌঁছান ব্যক্তিগত অর্জনে। রশিদ ছিলেন একেবারেই নির্বিষ ও খরুচে। তার ১০ ওভার থেকে আসে ৫৪ রান।
বাংলাদেশকে যা কিছুটা ভোগাতে পারেন অফ স্পিনার মুজিব। লিটন ও মুশফিক দুজনই একবার করে বেঁচে যান তার বিপরীতে। ইনিংসের ৩৮তম ওভারে লিটন শর্ট কভারে ক্যাচ তুলেছিলেন। কিন্তু সহজ সুযোগ বেরিয়ে যায় আফগান দলনেতা শহিদির হাত গলে। তখন লিটন ছিলেন ৮৭ রানে।
এরপর ৪২তম ওভারে মুশফিককে স্টাম্পিং করতে ব্যর্থ হন চোট পেয়ে মাঠ ছাড়া গুরবাজের জায়গায় নামা উইকেটরক্ষক ইকরাম আলী খিল। অনেক সময় পেলেও বল হাতেই জমাতে পারেননি তিনি। মুশফিক তখন খেলছিলেন ৬৯ রানে। তবে তিনি দ্বিতীয় জীবনকে সেঞ্চুরিতে রূপ না দিতে পারলেও লিটন সুযোগ কাজে লাগাতে কোনো ভুল করেননি।
Comments