ফেসবুক কি সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান হতে চায়?

ছবি: সংগৃহীত

'ফেসবুক' বা 'মেটা' সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দীর্ঘকাল ধরে রাজত্ব করে আসা এক প্রতিষ্ঠানের নাম। আলফাবেট, অ্যামাজন, অ্যাপল কিংবা মাইক্রোসফটের মতো বিশ্বের নামকরা সব প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বরং মাস্টারপ্ল্যানের দিক দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে মেটা। যার পুঁজি হচ্ছে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত ডেটা এবং কৌশলে তাদের ম্যানিপুলেট করার দক্ষতা। জনসম্মুখে উন্নত প্রযুক্তির দুয়ার খুলে দেওয়ার সম্ভাবনা দেখালেও বিগত পরিকল্পনাগুলোর উদ্দেশ্য বলছে ভিন্ন কথা। 

কিনছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান

ফেসবুক প্রতিষ্ঠার পর থেকে মার্ক জাকারবার্গ তার ব্যবসায়িক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক বাজিমাত করে আসছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তালিকায় ফেসবুকের পরেই আসে ইনস্টাগ্রাম আর হোয়াটসঅ্যাপের নাম। যা এখন প্যারেন্ট কোম্পানি ফেসবুক বা মেটার অধীন। ২০১২ সালে ১৩ জন কর্মচারী নিয়ে চলমান ইনস্টাগ্রাম ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্তকে নিছক জাকারবার্গের বোকামি বলে ধরে নিয়েছিলেন অনেকেই। 

ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু জাকারবার্গ যে ভবিষ্যত দেখতে পান সে সম্বন্ধে এখন দ্বিমত পোষণ করার যুক্তি বোধহয় কারও নেই। 

তিনি অনুমান করতে পেরেছিলেন, ইনস্টাগ্রাম খুব শিগগিরই ফেসবুকের অন্যতম প্রতিযোগীতে রূপান্তরিত হবে। ফেসবুককে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতে পারে। তাই আশঙ্কা সত্যিতে পরিণত হওয়ার আগেই কিনে নেন ইনস্টাগ্রাম বা আইজি। পরিসংখ্যান অনুসারে, বর্তমানে ইনস্টাগ্রামের মাসিক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন এবং প্রতিদিন প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী এটা ব্যবহার করছেন। ২০১০ সালে ১ বিলিয়ন ডলারের ফটো শেয়ারিং অ্যাপ মাত্র ৮ বছর পরে ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ, ফেসবুক ইতোমধ্যে ১০০ গুণ আয় করেছে ইনস্টাগ্রাম থেকে।            

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ইনস্টাগ্রাম কেনার ঠিক দুই বছর পর ফেসবুক আবার হোয়াটসঅ্যাপের মতো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান কিনল কেন? যেখানে ফেসবুকের নিজস্ব ম্যাসেজিং অ্যাপ মেসেঞ্জার এবং ইনস্টাগ্রামের মালিকানা ছিল। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপের মূলনীতি বিজ্ঞাপন এবং ইন-অ্যাপ পার্চেজবিরোধী থাকার পরও। মার্ক জাকারবার্গ এক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন তার ভিন্ন অভিসন্ধি। হোয়াটসঅ্যাপের অত্যধিক জনপ্রিয়তার ফলে মেসেঞ্জার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে বসেছিল। 

তাই স্বাভাবিকভাবে মনে হবে, ফেসবুক সেই ক্ষতিপূরণের ধান্দায় হোয়াটসঅ্যাপের মালিকানা নিজের করে নেয়। সত্যি বলতে, ফেসবুক ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে শুধু ২ মিলিয়ন ব্যবহারকারী কিনে নেয়নি, কিনে নিয়েছে তাদের ব্যক্তিগত তথ্যাদিও। হোয়াটসঅ্যাপ যেখানে তাদের গ্রাহকদের গোপনীয়তা নিয়ে বেশ সচেতন ছিল, সেখানে ফেসবুকের মূলনীতি সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা ব্যবহারকারীর তথ্য বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে উপার্জন করছে বিলিয়ন ডলার। অন্য প্রতিষ্ঠানের থেকেও এগিয়ে যাচ্ছে বহুগুণ। অর্থাৎ, যত বেশি তথ্য, তত বেশি অর্থ।

ভার্চুয়াল কারেন্সি চালুর পরিকল্পনা

এ তো গেল ফেসবুকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার কৌশলের কথা। এরপর ফেসবুকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর। ২০১৯ সালের ফেসবুকের নিজস্ব গ্লোবাল কারেন্সি 'লিব্রা'র ঘোষণার উদ্দেশ্য এটারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। একুশ শতকের প্রযুক্তির উন্নয়ন অর্থনীতি ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলেছে। উদ্ভাবন হয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সি, বিটকয়েন, ব্লকচেইন, এনএফটি এবং ডিজিটাল ওয়ালেটের। ফেসবুকের বক্তব্য অনুযায়ী, লিব্রা মূলত ক্রিপ্টোকারেন্সির গতানুগতিক ধারার একটা আপডেট ভার্সন। এটি পেপাল ও বিকাশের মতো ই-ওয়ালেট হিসেবে কাজ করবে। 

ছবি: সংগৃহীত

অর্থাৎ, একাউন্ট থাকা সাপেক্ষে ডিজিটালি টাকা আদান-প্রদান এবং কেনাকাটা করা যাবে। যেকোনো দেশে এটি ব্যবহার করা যাবে। তাছাড়া এটির মূল্য স্থির থাকবে, রাতারাতি বৃদ্ধি বা হ্রাসের আশঙ্কা নেই। যা অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির অন্যতম সীমাবদ্ধতা। এছাড়া সরাসরি ফেসবুক মেসেঞ্জার এবং হোয়াটসঅ্যাপ থেকেও এই লিব্রা কয়েন আদান-প্রদান করা সম্ভব হবে। এজন্য অন্যান্য ডিজিটাল ই-ওয়ালেটের মতো ক্যাশ-ইন করতে বা আউট করতে হাই ক্রেডিট কার্ড চার্জ বা ব্যাংক চার্জ বা এই ধরনের কোনো ক্যাশ ইন চার্জ বহন করতে হবে না। আর যদি কোনো ফি-ও বহন করতে হয়, তবে তা হবে খুবই সামান্য। 

তবে ২০২০ সালের শুরুর দিকে লিব্রা প্রজেক্ট শুরুর হওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা সম্ভব হয়নি। কারণ লিব্রার প্রচলন হলে মার্ক জাকারবার্গ হয়ে যেতেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। পুরো বিশ্বের অর্থব্যবস্থা চলে আসতে পারে তার হাতের মুঠোয়। শোনা যায়, সে চাইলে টাকা ছাপাতে এব মজুদ করার ক্ষমতা রাখবে। এক কথায় লিব্রার প্রচলন হলে ব্যাংকিং ব্যবস্থাও নড়বড়ে হয়ে যেত। তাছাড়া মানি লন্ডারিংও সহজ হয়ে যেত বলে আশঙ্কা করেছে বৈশ্বিক নীতিনির্ধারক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। ফলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র। 

তারপরও থেমে যায়নি ফেসবুক। ২০২০ সালে লিব্রার নাম পরিবর্তন করে ডিয়েম-এ রূপান্তরিত হয়ে সুইজারল্যান্ডকে টার্গেট করেছিল তারা। ডিয়েমের কাজ শেষ হলে তাদের নোভি ওয়ালেটের বাজারে আসার অপেক্ষা করছিল। কিন্তু হঠাৎ ডিয়েমের অর্থনীতি ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা ডেভিড মার্কাস পদত্যাগ করলে ফেসবুক তার পরিকল্পনা নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। তারপর পেপাল, ইবে, স্ট্রাইপ, ভিসা, মাস্টারকার্ডের মতো প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে এটি বাতিল করে ফেসবুক। কিন্তু মার্ক জাকারবার্গ যখন কোনো বিষয়ে ছক করে ফেলেন, তাকে পিছু হটানো সম্ভব হয় না। নিশ্চিত হয়ে বলাই যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পরে অর্থনীতিতেও তার রাজত্ব প্রসার করবেন।

ভবিষ্যতের সামাজিকমাধ্যম মেটাভার্স

ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি ফেসবুক তাদের প্যারেন্ট কোম্পানি 'মেটা' নামে রূপান্তরিত করেছে। মার্ক জাকারবার্গের ভাষ্যমতে, এটি হলো ইন্টারনেটের দ্বি-মাত্রিক জগৎ থেকে উন্নয়নের অর্থাৎ মেটাভার্সের প্রথম পদক্ষেপ। তবে সমালোচকরা বলছেন ভিন্ন কথা। সাম্প্রতিকালে ফেসবুকের সাবেক কর্মী ফ্রান্সেস হাউগেনের তাদের গবেষণা নথি ফাঁস করে দেওয়ার বিতর্ক এড়াতে এমন উদ্যোগ নিয়েছে ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়া প্রযুক্তিবিদদের মতে, বর্তমানে যে পরিমাণ তথ্য ব্যবহারকারীর নিকট থেকে ফেসবুক নিতে পারছে, ভবিষ্যতে এর পরিমাণ হবে কয়েকগুণ। কেন না মেটাভার্সের ধারণা অনুযায়ী, ইন্টারনেটের ত্রিমাত্রিক ডাইমেনশনে মানুষ তার বাস্তব জগতের থেকে অধিক সময় সেখানে কাটাবে। এটির কার্যকারিতা এমনভাবে প্রকাশ করা হবে যে, চাইলেও এ থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না।  

টিকটকের ধাক্কা

সম্প্রতি টিকটকের প্রভাবে ফেসবুকের শেয়ারমূল্য কমেছে। টিকটক ও ইউটিউবের ভিডিও কনটেন্টের প্রতি তরুণ ব্যবহারকারীর ঝোঁকের ফলাফল এটি। দীর্ঘ ১৮ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দৈনিক সক্রিয় গ্রাহকের সংখ্যা কমেছে। ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শেষ ত্রৈমাসিকে ফেসবুকের সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১৯২ কোটি ৯০ লাখ। এর আগের ত্রৈমাসিকে এই সংখ্যা ছিল ১৯৩ কোটি। অর্থাৎ ওই ৩ মাসে ১০ লাখ ব্যবহারকারী হারায় ফেসবুক। এই খবরের প্রভাবে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা প্ল্যাটফর্মস ইনকরপোরেশনের শেয়ারের দাম কমে যায়। একদিনে ২৯ বিলিয়ন ডলার হারান সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ। 

ছবি: সংগৃহীত

যার মূল কারণ হলো ব্যবহারকারীরা ফেসবুকের চেয়ে টিকটক এবং ইউটিউবে বেশি সময় ব্যয় করছেন। এক্ষেত্রে একদিকে যেমন কমছে ব্যবহারকারী, তেমনি কমছে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপনের হার। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ফেসবুকের জন্য এরকম সংকট নতুন নয়। তবে এবারের ধাক্কা সামলাতে ফেসবুকের বেশ হিমশিম খেতে হবে বলে ধারণা করছেন প্রযুক্তিবিদগণ। 

মার্ক জাকারবার্গের বক্তব্য অনুযায়ী, ভবিষ্যতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনেকটা টিকটকের মতো হয়ে যাবে। ইনস্টাগ্রাম রিলসকে এক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলেও খুব একটা সুবিধা করা যাবে না। কারণ সেটির প্রতি বেশি বয়সের মানুষের আকর্ষণ ধরে রাখা কষ্টসাধ্য হবে। আর মেটাভার্সের উপযোগিতা পাওয়াও অনেক সময়ের ব্যাপার। মার্ক জাকারবার্গ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ফেসবুকেও চালু করেছেন রিল সুবিধা। যার উদ্দেশ্য হলো টিকটক, ইউটিউব শর্টসের মতো প্রতিযোগীতের প্রভাব হ্রাস। এখন দেখার অপেক্ষা কতটা সফল হন।

আজকের টেক জায়ান্টের শুরুটা হয় ২০০৩ সালের ২৮ অক্টোবর ফেসম্যাশ ডট কম নামের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। জনপ্রিয়তা লাভের আশায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেটাবেজ হ্যাক করে শিক্ষার্থীদের ছবি ব্যবহার করে ভিজিটরদের 'হট' অথবা 'নট' ভোটের ফন্দি এঁটেছিলেন মার্ক জাকারবার্গ। পরে বিতর্কের মুখে পড়ে বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দেন ওয়েবসাইটটি। তারপর ২০০৪ সালে আবার নতুন আঙ্গিকে কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্র অ্যাডওয়ার্ডো সেভারিন, জাস্টিন মস্কোভিজ এবং ক্রিস হিউজেসের সহযোগিতায় মার্ক জাকারবার্গ তৈরি করেন দ্য ফেসবুক। যা পরে ফেসবুক নামে পরিচিতি লাভ করে।        

Comments

The Daily Star  | English

Leading univs withdrawing from cluster system

Undergraduate admission tests under the cluster system faces uncertainty for the 2024-25 academic year, as several prominent universities have decided to withdraw and conduct their own admission tests independently. 

7h ago