উপাচার্যদের সম্মান, নৈতিকতা ও অনিয়ম
দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অনিয়ম দুর্নীতির খবর বেশ পুরোনো। শিক্ষাখাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন অস্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া, বিচারহীনতা, রাজনৈতিক বিবেচনা ও তদবিরের মাধ্যমে নিয়োগসহ নানা জটিলতার কারণে যোগ্য ব্যক্তিরা উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন না। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) গত ২ বছরে অন্তত ১০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করেছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো তদন্ত চলছে।
ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ প্রতিশ্রুতি না রাখা। দৃঢ়তার অভাব এবং ক্ষমতা পাওয়ার পর আইন, নিয়মকানুন তোয়াক্কা না করার প্রবণতা। উপাচার্যরা মনে করেন নিজের মতো করে আইন করা যাবে এবং তা ভঙ্গ করা যাবে। ক্ষমতার বলয় তৈরি করতে তারা এটি করেন।'
তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে কোনো অনিয়ম হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এটি অনিয়ম বন্ধ না হওয়ার একটি কারণ। অনেক সময় মন্ত্রণালয় ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করে। ফলে, এই বিষয়গুলো থেকে মনোযোগ বা দৃষ্টি সরে যায়। পরে আর বিচার হয় না। আর কোনো অনিয়মের ব্যবস্থা না নিলে অন্যরাও মনে করেন অনিয়ম করলে তো তেমন শাস্তি হয় না। তাই অনিয়ম করেন। দ্রুত সময়ে ব্যবস্থা নিলে অনিয়ম দুর্নীতি কমে আসবে। তাছাড়া, আইন-কানুন দিয়ে দুর্নীতি তেমন বন্ধ করা যায় না। এই পদে যারা বসেন তাদের বিবেক যদি কাজ না করে তবে সেখানে দুর্নীতি বা অনিয়ম বন্ধ করা কষ্টকর।'
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে স্বায়ত্তশাসিত মাত্র ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো এই ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়েও সেই নীতিমালা তেমনভাবে মানা হয় না। দেশে মোট ৫২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। বাকী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগের কোনো নীতিমালা নেই। উপাচার্য নিয়োগে অবশ্যই স্বচ্ছ নীতিমালা থাকা উচিত। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পদ খালি হওয়ার অন্তত ৯ মাস আগে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে যোগ্যদের বাছাই করতে হবে। বাছাইকৃতদের প্রেজেন্টেশন নিতে হবে যেখানে সরকারের বিভিন্ন মহলের ব্যক্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি থাকবেন। এখান থেকে ৩ জনকে নির্বাচিত করে রাষ্ট্রপতি বরাবর পাঠাতে হবে। পুরো প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ হতে হবে। সবাই জানবে কাদের নাম পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে নিয়োগ দেবেন। এখন কে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাবেন তা কেউ জানেন না। কোন বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয় তা শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানে, আর কেউ জানে না। আমাদের দেশে উপাচার্য নিয়োগের স্বচ্ছ প্রক্রিয়া এখনো নেওয়া হয়নি।'
ইউজিসির আরেক সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকদের নিয়োগ দেওয়া দরকার। যারা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আইন ও নিয়মকানুন মেনে চলবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় উপাচার্যরা আইন কানুন মেনে চলেন না। অনেক সময় দেখা যায় উপাচার্যরা বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতার অনুরোধ রাখেন এবং মনে করেন কোনো অনিয়ম করলে সেই নেতারা তাকে রক্ষা করবেন। এ ছাড়া উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষতা, প্রশাসনিক যোগ্যতা এসব বিষয়গুলো দেখতে হবে। তাহল এতোটা দুর্নীতি হয় না।'
তিনি বলেন, 'উপাচার্যদের ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদাবোধ, অতীত ইতিহাস দেখা দরকার। ব্যক্তিত্ব থাকলে অবশ্যই আইন মেনে চলবেন। তিনি বা তার পরিবার লোভী কি না তা দেখা দরকার। তাছাড়া তার প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা যা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সাহায্য করবে তা থাকা দরকার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত করতে গিয়ে আমার এই বিষয়গুলোই মনে হয়েছে।'
উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এই বিষয়গুলো মানা হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যেখান থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয় সেখানে এই বিষয়গুলো তেমন ভালোভাবে মানা হয় না।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইউজিসি সদস্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পরিণতি যদি কিছু না হয়, যেমন তদন্ত হচ্ছে কিন্তু কোনো ফল হচ্ছে না বা শাস্তি হচ্ছে না তাহলে আত্মমর্যাদাহীন ব্যক্তিদের কোনো ভয় থাকে না। অনেক সময় সিন্ডিকেট সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালন করেন না। উপাচার্যদের দুর্নীতির প্রতিবাদ তেমনভাবে করেন না। শুধু উপাচার্যকে তোষামোদি করে চললে হবে না। উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি কোন রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য তা যেন মুখ্য বিষয় না হয়।'
ইউজিসির এই সদস্য বলেন, 'আমাদের দেশ আমলা প্রধান হয়ে যাচ্ছে। এখানে উপাচার্য নিয়োগে শুধু আমলা নির্ভর না হয়ে শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটা বডি গঠন করা যেতে পারে। যেখানে ইউজিসির সদস্যদের রাখা যেতে পারে কারণ তারা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকেই আসেন। তারা জানবেন কোন শিক্ষক কেমন। যে শ্রেণি থেকে উপাচার্য বাছাই করা হবে সেই শ্রেণির ভালো মানুষদের দিয়ে বাছাই করাতে হবে তবেই একজন ভালো উপাচার্য পাওয়া যেতে পারে।'
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুরো সমাজে মুল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও পড়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এর প্রভাব পড়ার কথা ছিল না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো না। যারা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন তারা যদি লোভ-লালসা, অপ্রাপ্তি এগুলোকে বড় করে না দেখে আদর্শ এবং পেশাগত দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করেন তাহলে এই অনিয়মগুলো বন্ধ করা সম্ভব। যারা নীতিনির্ধারণী জায়গায় আছেন তাদের অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদর্শ মূল্যবোধ স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং করাটা বাঞ্ছনীয়।'
তিনি বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম বন্ধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ আমার চোখে পড়ছে না। উজ্জ্বল কোনো দৃষ্টান্ত আমার নজরে আসেনি। অনেক সময় ইউজিসি থেকে তদন্ত হয়। কিন্তু দীর্ঘসূত্রিতার কারণে তা হারিয়ে যায়। কোনো বিচার হয় না। সবার মধ্যে স্বচ্ছতা আনার জন্য উচ্চ শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রস্তাব আজ থেকে ৭-৮ বছর আগে আমি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেটি গ্রহণযোগ্য হয়নি।'
ইউজিসির সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, 'এখন কোন যোগ্যতায় উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয় তা আমার জানা নেই। তবে আমি মনে করি উপাচার্যর দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে এবং আরও যত্নশীল হলে মনে হয় ভালো হতো। যাদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি, তাদের তো নিয়োগ দেওয় হয় না। ৪টি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের যে নিয়ম সেটিও মানা হয় না।'
তিনি আরও বলেন, 'রাজনৈতিক পরিচয় উপাচার্য নিয়োগে প্রধান ভূমিকা হিসেব বিবেচ্য হয় বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। এ কারণেই হয়তো বা আমরা দক্ষ লোকদের উপাচার্য পদে পাচ্ছি না।'
ঢাবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উপাচার্যদের অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধ না হওয়ার বড় কারণ হলো যথাযথ তদারকির অভাব। ইউজিসি বিভিন্ন সময় নানা অনিয়ম তদন্ত করে কিন্তু এর ফলোআপ বা কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তা জানা যায় না। অনিয়ম বা দুর্নীতি কামানোর অন্যতম পদ্ধতি হলো যারা অনিয়ম বা দুর্নীতি করবেন তাদের শনাক্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু আমাদের এখানে এই ব্যবস্থাগুলো নেওয়া হয় না। যারা দুর্নীতি করেন তাদের শাস্তির আওতায় আনা হয় না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধ হয় না।'
তিনি বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার করছে। একজন উপাচার্য হবেন শিক্ষাবিদ, প্রশাসনিক দক্ষতা সম্পন্ন এবং শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাযথ নিয়মে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয় না। এখন তদবির করে অনেকে উপাচার্য হোন।'
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পান তারা সাধারণত অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে একটু বেশি জড়িত হচ্ছেন বলে আমার মনে হয়। তাছাড়া মেয়াদ শেষের দিকের অনিয়মটা একটু বেশি হচ্ছে। মেয়াদ শেষের দিকে রাজনৈতিক নেতা, স্বজনদের খুশি করার জন্য এসব অনিয়ম করা হয়। যাতে তিনি আরেকবার ক্ষমতায় আসতে পারেন।'
তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এতো বেশি যে সে অনুযায়ী দক্ষ উপাচার্য পাওয়াটা কঠিন। একজন উপাচার্য হতে হলে তার একাডেমিক পাণ্ডিত্য, প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা থাকতে হবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক চাপ মোকাবিলার ক্ষমতা থাকতে হবে। আমাদের দেশে এমন লোক উপাচার্য হিসেবে পাওয়াটা অনেক কঠিন। অনেক সময় দেখা যায়, যার হলের প্রভোস্ট হওয়ারও যোগ্যতা নেই তিনি উপাচার্য হচ্ছেন।'
'ইউজিসকে আরও ক্ষমতা দিতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তদারকি বাড়াতে হবে তবেই অনিয়ম দুর্নীতি কমে আসবে,' যোগ করেন তিনি।
Comments