ভাষা আন্দোলনের অনন্য সৈনিক নাফিসা কবীর

নাফিসা কবীর। ছবি: সংগৃহীত

ভাষাসৈনিক নাফিসা কবীর চলে গেলেন। কিন্তু রেখে গেলেন তার অবিস্মরণীয় অবদান, রেখে গেলেন তার চিন্তা আর ভাবনার প্রসারতা। নাফিসা কবীর ৫২'র ভাষা আন্দোলনে রাজপথে দাঁড়িয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে দাঁড়িয়েছেন অসহায় শরণার্থী আর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে। দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তিনি শহীদদের স্বজনদের সংগঠিত করেছিলেন।

শহীদ বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সার ও শহীদ জহির রায়হানের বোন নাফিসা কবীর ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করে পেয়েছিলেন স্বর্ণপদক, তাও আবার ফেনী মহকুমার অখ্যাত আমিদাবাদ স্কুল থেকে। বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের মাধ্যমে তার কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিতে হাতেখড়ি। যদিও পরে দুজনের আদর্শিক ভাবনা কিছুটা ভিন্ন হয়ে যায়। কমিউনিস্ট পার্টিতে শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন মস্কোপন্থী আর নাফিসা কবীর পিকিংপন্থী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক করা অবস্থাতেই ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন নাফিসা কবীর। মিছিলে তিনি ছিলেন পরিচিত মুখ। তার স্বামী ভাষাসৈনিক ডা. এম এ কবীর ছিলেন ঢাকা মেডিকেলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। ষাটের দশকে ডা. এম এ কবীর উচ্চশিক্ষার্থে যুক্তরাজ্যে চলে গেলে নাফিসা কবীরও সঙ্গী হয়েছিলেন। পরে তারা চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে গড়ে তোলেন স্থায়ী আবাস। সুদূর প্রবাসে থেকেও নিজের শেকড়কে কখনোই ভোলেননি নাফিসা কবীর। যুক্তরাষ্ট্রে থেকেও দেশের হালচাল, রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবই তার নখদর্পণে ছিল।

অনুজ জহির রায়হানকে ভীষণ ভালোবাসতেন তিনি। ১৯৬৮ সালে জহির রায়হানকে লন্ডন থেকে মরিস অক্সফোর্ড গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন ২ লাখ টাকায়। অথচ তখন গাড়ি পাওয়া যেত ২০ হাজার টাকাতেই। সেই গাড়ি ১৯৭১ সালের মার্চে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর চলাচলের জন্য দিয়ে দিয়েছিলেন জহির রায়হান।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে স্থপতি ফজলুর রহমান খানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রবাসী বাঙালিরা গড়ে তুলেছিলেন দুটি সংগঠন। একটি 'বাংলাদেশ ইমার্জেন্সি ওয়েলফেয়ার আপিল', যার উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিবাহিনীর সমর্থনে প্রচার-প্রচারণা এবং রিলিফ সংগ্রহ; আর অন্যটি 'বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ'। এই সংগঠনটি কূটনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিল। বাংলাদেশ ইমার্জেন্সি ওয়েলফেয়ার আপিলের অন্যতম মুখ ছিলেন নাফিসা কবীর। প্রবাসীদের মাধ্যমে যে চাঁদা উঠানো হতো, তা দেওয়া হতো নাফিসা কবীরকে। নাফিসা কবীর অনুজ জহির রায়হানের কাছে পাঠাতেন সেই অর্থ। এরপর জহির রায়হানের হাত ধরে সেগুলো পৌঁছে যেত মুক্তিসংগ্রাম তহবিলে। জহির রায়হান নির্মিত স্টপ জেনোসাইডের অর্থায়নেও অনেকটা অবদান ছিল নাফিসা কবীরের।

মুক্তিযুদ্ধের ডিসেম্বরে প্রিয় বড়দা শহীদুল্লা কায়সারকে হারিয়েছিলেন নাফিসা কবীর। এরপর জানুয়ারি মাসে হারালেন জহির রায়হানকেও। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি চলে এসেছিলেন ঢাকায়। প্রিয় দুই ভাইকে হারানোর পর তিনি ভেঙে পড়েছিলেন সত্যি, কিন্তু শোককে শক্তিতে পরিণত করে ঘুরেও দাঁড়ালেন। ঠিক করলেন, যেভাবেই হোক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামতে হবে। ঠিক করলেন, এই বিচারের দাবিতে শহীদদের স্বজনদের সর্বপ্রথম সংগঠিত করতে হবে। কিন্তু তারা যেমন ভেঙে পড়েছেন, তেমন ছড়িয়ে রয়েছেন দেশের নানা প্রান্তে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নাফিসা কবীরই প্রথম রাজপথে নামলেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নামলেন নাফিসা কবিরের হাত ধরে।

প্রথমে বেশ কয়েকজন শহীদ স্বজনকে তিনিই এক করলেন। তাদের মধ্যে শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী লিলি চৌধুরী, আনোয়ার পাশার স্ত্রী মহসিনা খাতুন, ডা. আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, শাহরিয়ার কবীর ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। তারা গড়লেন 'নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষুব্ধ পরিবারবর্গ'। এর আহব্বায়ক হলেন নাফিসা কবীর। 'নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষুব্ধ পরিবারবর্গ'ই ছিল স্বাধীন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে প্রথম কোনো মঞ্চ। ১৯৭২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাত্রা শুরু করেছিল এই মঞ্চ।

২৭ ফেব্রুয়ারির সেই সভা নিয়ে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন লিখেছিলেন, '১৯৭২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির কথা মনে পড়ছে। বয়স তখন ২০ বা ২১। শহীদ মিনারে আমাদের বয়সী এবং আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের অনেকে জড়ো হয়েছেন……। আমাদের দাবি যুদ্ধাপরাধের বিচার। সমাবেশের উদ্যোক্তা জহির রায়হান ও শহীদুল্লাহ কায়সারের বোন নাফিসা কবীর। শাহরিয়ার তাদের চাচাতো ভাই। নাফিসা কবির থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে এসেছেন।'

নাফিসা কবির বলা চলে প্রথমদিকে এক হাতেই এই আন্দোলন সামলালেন। তাদের কায়েতটুলির বাসাতেই মূলত সভাগুলো হতো। পরে ন্যাপ নেতা শহীদ সাইদুল হাসানের স্ত্রী ফরিদা হাসানের বাসায় আলোচনা হতো।

শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী লিখেছেন, 'মুক্তিযুদ্ধে স্বামী হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে ১৯৭২ সালে আমি ইস্কাটনে ছিলাম। ওই বাসায় একদিন নাফিসা কবীর এলেন……। নাফিসা কবীর যুদ্ধাপরাধী ও তাদের বিচার সম্পর্কে আমাকে বুঝিয়ে বললেন। পান্নাকেও নিশ্চয়ই বলেছিলেন। নাফিসা আপা দুই ভাইকে হারিয়ে আমার মতোই শোকার্ত ছিলেন। তিনি তাদের কায়েতটুলির বাসায় একটি সভা করেন। শহীদ পরিবারের অনেকে ওখানে ছিলেন। ওখানে কীভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা আমাদের দাবি জানাব, এ সংক্রান্ত আলাপ হয়। ১৭ মার্চ আমরা শহীদ মিনারে সভা করি। অনেকে বক্তৃতা করেন।'

১৭ মার্চ ঠিক হয়েছিল, পরদিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবুর রহমানকে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে। এদিন সকালে শহীদ মিনার থেকে শহীদ স্বজনেরা বঙ্গভবনে গেলে বঙ্গবন্ধুর তাদের দ্রুত বিচারের আশ্বাস দিলেন। সে বছরের স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গটি পুনরায় তুলে ধরেছিলেন।

জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালে ১০১ জন নাগরিক নিয়ে গঠিত হওয়া 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি' গড়ার পেছনেও অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিল নাফিসা কবীরের নেতৃত্বে গঠিত 'নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষুব্ধ পরিবারবর্গ' মঞ্চ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নাফিসা কবীরের হাত ধরে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, সেই আন্দোলনের ফল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাস্তবায়ন। কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই নয়, আমৃত্যু মানবতা, নারী-পুরুষের সমতা, সুশাসন, গণতন্ত্রের উন্নয়নে কাজ করেছেন নাফিসা কবীর।

নাফিসা কবীরের অবদান এ জাতি মনে রাখবে আজীবন। তিনি চিরকাল থাকবেন বাংলাদেশের অনুপ্রেরণা হয়ে।

 

তথ্যসূত্র:

 শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের তিন দশক : নির্মূল কমিটি প্রতিষ্ঠার আগে ও পরে/ শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ২৬ বছর ও আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা/ মুনতাসীর মামুন

 

আহমাদ ইশতিয়াক

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh cement sector 2024 downturn

Cement sector struggles amid political, economic challenges

Cement sales in Bangladesh plunged in 2024 due to political instability, rising production costs, and the deferment of the implementation of government infrastructure projects, leaving the industry operating at less than half its capacity.

16h ago