কান্ট্রি ব্রান্ডিংয়ে ভূমিকা রাখতে সক্ষম প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষার্থীরা

একটি জাতির ইতিহাস, অতীত ঐতিহ্য, শৌর্য, বীরত্ব ও আঞ্চলিক সংস্কৃতি একনজরে জানার সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা হলে সেই জাতির জাদুঘর। তাই সাধারণ মানুষের কাছে এর যথাযথ উপস্থাপন ও পরিবেশন দেশের মানুষসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মাঝে জাতির জাতীয় পরিচয় নির্মাণে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে। কারণ কান্ট্রি ব্রান্ডিংয়ে জাদুঘর বর্তমান বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর দেশের সবচেয়ে বড় জাদুঘর ও সংগ্রহশালা। এটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃ-তাত্ত্বিক, শিল্পকলা ও প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কিত নিদর্শনাদি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশের যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ আছে সেখানকার শিক্ষার্থীরা প্রত্ন-শাস্ত্রের উপ-শাস্ত্র হিসেবে জাদুঘর বিদ্যা ও উচ্চতর জাদুঘরবিদ্যার ওপর পড়ালেখা করেন। আমাদের শিক্ষার্থীরা জাদুঘরের কার্যক্রম, সারাবিশ্বে এর অগ্রগতির ইতিহাস, ভারত ও বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে জাদুঘরের অগ্রগতি, সংরক্ষণ পদ্ধতি, সংগৃহীত বস্তুর ব্যাখ্যা ও যথাযথ প্রদর্শন প্রক্রিয়া, প্রাপ্ত বস্তুর নমুনায়ন, সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, জাদুঘরের স্থাপত্যশৈলী, নিরাপত্তা সম্পর্কিত কার্যক্রম, পরিদর্শকদের প্রাপ্য সুবিধা, পরিচালনা পরিষদ গঠন ও তাদের ব্যবস্থাপনা, দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে পড়ালেখা করেন। সর্বোপরি আমাদের শিক্ষার্থীরা জাদুঘরে সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত বস্তু নিয়ে উচ্চতর গবেষণা করেন এবং তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় শিক্ষা পান।

একজন শেকড় সন্ধানী প্রত্নতাত্ত্বিককে ঐতিহাসিকের মতো সম্পূর্ণ ইতিহাস জানতে হয়। ইতিহাসের উৎস যেখানে শেষ হয় সেখানে তাকে প্রত্নবস্তু, বাস্তুবস্তুর বিজ্ঞানভিত্তিক চর্চার মাধ্যমে নতুন ইতিহাস, ইতিহাসের সত্যায়নের অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা দিতে হয়। তাই অতীতের পরিবর্তন, রূপান্তর, উন্নয়ন, হারিয়ে যাওয়ার কারণ ইতিহাস শাস্ত্র, জাদুঘর বিদ্যা, সামাজিক গবেষণা, সাংবাদিকতা, লেখালেখি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষার্থীরা অন্যদের চেয়ে ভালো করেন।

১৯৯১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্ন-গবেষণায় একদল আধুনিক প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী তৈরি ও শাস্ত্রীয় জ্ঞানের গবেষক সৃষ্টির 'বিষয়' হিসেবে বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্ব চর্চার শুরু হয়েছিল। চালু হয়েছিল 'প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ' নামে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ।

জাহাঙ্গীরনগর ছাড়াও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। এ ছাড়াও, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ', রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে 'কালচারাল হেরিটেজ ও বাংলাদেশ স্টাডিজ' বিভাগগুলোতে আংশিকভাবে প্রত্নবিষয়ক জ্ঞানের হাতেখড়ি দেওয়া হয়।

এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রত্নতত্ত্ব শাস্ত্রের অধিভুক্ত 'মাঠপ্রত্নতত্ত্ব'সহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা ও তার সারনির্যাস গবেষণা প্রবন্ধ আকারে প্রকাশ করেন। এখানের শিক্ষার্থীরা তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক উভয় শিক্ষার হাতেখড়ি পান। প্রাচীন, মধ্যযুগ ও আধুনিক বাংলার ইতিহাস, জাদুঘর ও উচ্চতর জাদুঘর বিদ্যা, বিশ্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রাক ও প্রায়-ইতিহাস, বিশ্ব-সভ্যতা, ভূ-প্রত্নতত্ত্ব ছাড়াও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাচীন শিল্প ও স্থাপত্যবিদ্যা, জৈব-প্রত্নতত্ত্ব, পরিবেশ-প্রত্নতত্ত্ব, নৃ-বিদ্যা, সামাজিক গবেষণা পদ্ধতি, তত্ত্বচিন্তা, শিল্পকলা এবং চিত্রশাস্ত্র, এপিগ্রাফি, হেরিটেজ ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষে, ল্যাবে ও সরাসরি উৎখননে যুক্ত থেকে প্রত্নচর্চা করেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ শাস্ত্রের বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার জন্য ইতোমধ্যে ৫টি ল্যাবের কার্যক্রম চলছে। এগুলো হলো- বায়ো-আর্কিওলজি, জিও আর্কিওলজি, সিরামিক, কনজারভেশন ল্যাব, জিআইএস রিমোট সেনসিং ল্যাব, কম্পিউটার ল্যাব।

তবে, শেকড়ের সন্ধানে আগ্রহী হয়ে যেসব শিক্ষার্থী এ শাস্ত্রকে বেছে নেন তারা হাজারো বছরের বাঙালি ও অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর জীবনাচরণ, তাদের রেখে যাওয়া কৃতির অধ্যায়নে ক্রস ডিসিপ্লিন হিসেবে ভূগোল, ইতিহাস, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, দর্শনের মুখোমুখি হন। তারা সংস্কৃতির পরিবর্তন বোঝার চেষ্টা করতেই গোটা জীবন উৎসর্গ করেন। তাদের চলার পথটি মসৃণ নয়। বরং কুসুমাস্তীর্ণ। জাদুঘরে এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে এককভাবে এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা থাকলেও সেখানে অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লড়াই করে প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষার্থীদের জায়গা করে নিতে হয়। আবার জায়গা হয়ও না।

সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর থেকে প্রচারিত একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রত্নতাত্ত্বিকদের নতুন করে হতাশ করেছে। সেখানে সহকারী কিপার পদে জনবল নিয়োগ করা হবে। যোগ্যতা হিসেবে কয়েকটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকার কথা বলা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য সেই তালিকায় 'প্রত্নতত্ত্ব' বিভাগটি অনুপস্থিত। অথচ একটি দেশের জাতীয় যাদুঘরের যে কাজ তা পূরণে প্রত্নতত্ত্বের একজন গ্র্যাজুয়েট বেশি অবদান রাখতে সক্ষম। কিন্তু, যে কোনো কারণেই হোক সাম্প্রতিক এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতক শেষ করা শিক্ষার্থীরা আবেদনের সুযোগ পাচ্ছেন না।

জাতীয় জাদুঘর একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এখানে যারা বিভিন্ন পদে আছেন তাদের অজানা নয় কোন বিষয়ের গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীরা এখানে দায়িত্ব পালনে সক্ষম। জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডেও নেই দেশের কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক। এছাড়া, জাদুঘর কিংবা উচ্চতর জাদুঘর বিদ্যা বিষয়ে অভিজ্ঞ কোনো ব্যক্তি জাদুঘরের জনবলে আছেন বলেও জানা নেই। জাদুঘরের মতো একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠানে সুনির্দিষ্ট নিয়োগ নীতিমালা থাকা দরকার কিংবা থাকার কথা। যদি নীতিমালার আলোকে এই সার্কুলার হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে এই নীতিমালা যারা করেছেন তাদের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ।

আমাদের শিক্ষার্থীরা ইতিহাসের সম্পূর্ণ সিলেবাস পড়েন। তারা উচ্চতর জাদুঘর বিদ্যা, ক্রিটিক্যাল তত্ত্বচিন্তা, ব্যবহারিক জ্ঞান সব কিছুতে বেশি পরিশ্রম করেন। অথচ সামাজিক বিজ্ঞান সম্পর্কিত গবেষণা পদ্ধতির জ্ঞান রেখে ও সনদপত্রে সামাজিক বিজ্ঞানের স্বীকৃতি বহন করেও সমাজ বিজ্ঞান সম্পর্কিত কোনো চাকরিতে আবেদনের সুযোগ পাচ্ছেন না।

বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারেও এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের কোনো আসন নেই। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য সুস্পষ্ট বৈষম্য। মাল্টি ডিসিপ্লিনারি সাবজেক্ট হিসেবে বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনায় এনটিআরসিসহ ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান সম্পর্কিত সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ এ শিক্ষার্থীদের অধিকার। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, করোনাভাইরাস ও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন। দেশের মূল ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে যারা তুলে ধরতে সক্ষম সেই শেকড় সন্ধানী নবীশ শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ ও পরিবেশ দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের পাশে দাঁড়ানোর জরুরি।

লেখক: শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

$14b lost to capital flight a year during AL years

Bangladesh has lost around $14 billion a year on average to capital flight during the Awami League’s 15-year tenure, according to the draft report of the committee preparing a white paper on the economy.

10h ago