হুতিদের বিরুদ্ধে সৌদি জোটের যুদ্ধ: কী, কেন, কীভাবে?

সৌদি জোটের একটি সামরিক যান। ছবি: সংগৃহীত

দীর্ঘদিন ধরে ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়ছে সৌদি সামরিক জোট। এতদিন সৌদি জোটের আক্রমণের প্রত্যুত্তরে হুতি বিদ্রোহীরা বিভিন্ন সময় সৌদি আরবে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। কিন্তু গত মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বেশ কয়েকবার আক্রমণ চালিয়ে ইরানের মদদপুষ্ট বলে পরিচিত হুতিরা সব হিসাব পাল্টে দিয়েছে।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে, কেন হুতিরা আরব আমিরাতে আক্রমণ চালাচ্ছে? আরব আমিরাতই কি হতে যাচ্ছে চলমান এই সংঘর্ষের নতুন যুদ্ধক্ষেত্র?

আরব বিশ্বের সবচেয়ে গরিব দেশ ইয়েমেনে গত ৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধ মূলত দেশটির প্রায় ৫৬ শতাংশ সুন্নি ও প্রায় সাড়ে ৪৩ শতাংশ শিয়াদের মধ্যে। তবে ইয়েমেনে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে চলমান সশস্ত্র সংগ্রামের প্রধান বিবদমান পক্ষ জাতিসংঘ সমর্থিত সরকার ও বিরোধী হুতি আন্দোলনকারী।

সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন আরব সামরিক জোটই মূলত হুতিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। তাদের লক্ষ্য, ইয়েমেনে জাতিসংঘ সমর্থিত ও আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। আরব আমিরাত এই জোটের অন্যতম শরীক দেশ।

ইয়েমেনে গত ৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। ছবি: সংগৃহীত

হুতি বিদ্রোহী কারা?

হুতিদের আনুষ্ঠানিক নাম আনসারুল্লাহ। স্থানীয়ভাবে তাদের হুতি বলে ডাকা হয়। তারা মূলত শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী। ধারণা ও অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ করা হয়, হুতিদের সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দেয় শিয়াপ্রধান দেশ ইরান।

২০১৪ সালের শুরুর দিকে ইয়েমেনের সাআদা রাজ্যের দখল নিয়ে সবার নজরে আসে হুতিরা। শিগগির তারা দেশটির রাজধানী সানাও কুক্ষিগত করে নেয়। ফলে ইয়েমেনের রাষ্ট্রপতি আব্দরাব্বুহ মানসুর হাদি স্বেচ্ছা নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন।

২০১৫ সালের মার্চে সৌদি সামরিক জোট হুতিদের দমন করে হাদি সরকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা শুরু করে। তাদের এ উদ্যোগে সহায়তা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

তখন থেকে শুরু হওয়া সংঘাতে এখন পর্যন্ত হাজারো ইয়েমেনি নাগরিক মারা গেছেন এবং জাতিসংঘের ভাষায়, দেশটিতে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে।

হুতিরা গত কয়েক বছরে প্রতিবেশী সৌদি আরবে বেশ কয়েকবার হামলা চালালেও তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতে সর্বশেষ (জানুয়ারির ঘটনা বাদ দিলে) আক্রমণ করেছিল ২০১৮ সালে।

ইয়েমেনে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

ইয়েমেন যুদ্ধে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভূমিকা

২০১৮ সালে লোহিত সাগরের বন্দর নগরী হুদেইদাহের নিয়ন্ত্রণের জন্য হুতিদের সঙ্গে যুদ্ধ করছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের মদদপুষ্ট সামরিক বাহিনী। সে সময় প্রথমবারের মতো আরব আমিরাতে হামলা চালায় হুতিরা।

২০১৯ সালের পর থেকে ইয়েমেনে সামরিক উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে এনেছে আরব আমিরাত। তবে নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখার জন্য তারা বড় আকারের স্থানীয় সামরিক বাহিনী গড়ে তাদের হাতে আধুনিক অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ তুলে দিয়েছে।

আরব আমিরাত ইয়েমেনের সাবেক রাষ্ট্রপতি আলি আব্দুল্লাহ সালেহের ভাতিজা তারিক সালেহের নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী এবং সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিলকে (এসটিসি) সহায়তা দিচ্ছে।

এই দুটি বাহিনী ২০১৮ সালের পর হুতিদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে চলেছে। তবে গত কয়েক সপ্তাহের চিত্র ভিন্ন। ডিসেম্বরের শেষের দিকে আরব আমিরাতে সমর্থনপুষ্ট 'জায়ান্ট ব্রিগেড' নামের সরকারপন্থী দল হুতিদের শাবওয়াহ প্রদেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়। যৌথবাহিনীর পাশাপাশি জায়ান্ট ব্রিগেড এখন আল বায়দা ও মারিব প্রদেশ দখল নেওয়ার জন্য হুতিদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, জায়ান্ট ব্রিগেড, যৌথবাহিনী ও আরব আমিরাতের সামরিক সহায়তা মারিব ও শাবওয়াহতে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে এবং হুতিদেরকে আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ পরিচালনা করতে বাধ্য করেছে।

ইয়েমেনের ৫০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে রয়েছেন এবং আরও ৫০ হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষের কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত

আরব আমিরাত ও হুতিদের সংঘর্ষের ঘটনাপ্রবাহ

গত ২ জানুয়ারি হুতিরা জানায়, তারা আরব আমিরাতের একটি সামরিক পণ্যবাহী নৌযানকে লোহিত সাগর থেকে আটক করেছে।

১৭ জানুয়ারি আবুধাবিতে ড্রোন হামলায় একটি তেলের ট্যাংক বিস্ফোরিত হয়ে ৩ জন নিহত হন। এ ছাড়াও তারা আবুধাবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণাধীন বর্ধিত অংশে হামলা চালায়।

সৌদি সামরিক জোট প্রত্যুত্তরে হুতিদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর বিমান হামলার সংখ্যা বাড়ায়। তবে অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিমান হামলায় হাসপাতাল, টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো, বিমানবন্দর, পানি সরবরাহ কেন্দ্র ও স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

২১ জানুয়ারি উত্তরের সাআদা প্রদেশের একটি অস্থায়ী অপরাধী সংশোধনী কেন্দ্রে বোমা হামলায় প্রায় ৮০ জন মারা যান। পরের সপ্তাহে সানায় ২০ জন মারা যান।

২৪ জানুয়ারি আবুধাবির উদ্দেশে নিক্ষেপিত ২টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মাঝ আকাশে ধ্বংস করার দাবি জানায় আরব আমিরাত। ক্ষেপণাস্ত্র ২টি হুতিরাই ছুঁড়েছিল বলেও তারা দাবি করেন।

৩১ জানুয়ারি আরব আমিরাত আবারও দাবি করে, তারা আরেকটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে। হুতিরাও নিশ্চিত করে যে তারা আবুধাবির উদ্দেশ্যে বেশ কিছু ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুঁড়েছে।

শিশুরাও প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিচ্ছে যুদ্ধে। ছবি: সংগৃহীত

ভবিষ্যৎ

আগামীতে সহিংসতা আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

হুতিরা গত ৩১ জানুয়ারি জানিয়েছে, তাদের পরবর্তী লক্ষ্য হবে আরব আমিরাতে বিভিন্ন বহুজাতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সদর দপ্তর।

হুতিদের এই মনোভাবে বিশেষজ্ঞদের শঙ্কিত করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইয়েমেনের মানবিক সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফপি) সতর্ক করেছে, ইয়েমেনের ৫০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে রয়েছেন এবং আরও ৫০ হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষের কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছেন।

এ ছাড়াও, যুদ্ধের কারণে ৪০ লাখ মানুষ ইতোমধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউটের সিনিয়র ফেলো জেমস ফারওয়েল জানান, ইয়েমেনের সংঘর্ষ এখন একটি অচলাবস্থায় পৌঁছেছে। কারণ কোনো পক্ষই অপরের বিরুদ্ধে সামরিক সংগ্রামে জয়ী হতে পারছে না।

'পরিস্থিতি এখন আরও খারাপ হচ্ছে, কারণ আক্রমণে আরও ভয়াবহ সব মারণাস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে,' যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও জানান, সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের যৌথ সামরিক জোটের ওপর চাপ প্রয়োগ করে সুবিধা আদায় করতে চাইছে হুতিরা।

'সংঘর্ষ মেটানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও হুতিদের এক টেবিলে বসে আলোচনা করে সব সমস্যার সমাধান করা,' যোগ করেন জেমস।

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

1h ago