‘দুবেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই’

রুম ভাড়া হবে; সাবলেট ভাড়া হবে; এসি মেরামত করা হয় কিংবা নিখোঁজ সংবাদ—এ রকম বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখা যায় ব্যস্ত মোড়ের দেয়ালে, বৈদ্যুতিক খুঁটি বা গাছের গায়ে। 'দুবেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই', এমন আবেদন সম্ভবত একেবারেই নতুন।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এমনই একটি ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। বগুড়ার জহুরুলনগরের বাসিন্দা মো. আলমগীর কবির নামে এক যুবক এই আবেদন জানিয়েছেন। সেই পোস্টারে রয়েছে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের নম্বর।

সেই নম্বরে যোগাযোগ করা হলে কবির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আমার তো কোনো পরিচয় নেই! আমার পরিচয় 'বেকার'। বেঁচে থাকার জন্য এই আবেদন জানিয়েছি।

মো. আলমগীর কবির। ছবি: সংগৃহীত

১৯৯০ সালের ২০ মে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার বরাইল গ্রামে কবিরের জন্ম হয়। পল্লী চিকিৎসক মো. কফিল উদ্দিন ও আম্বিয়া বেগমের ৫ সন্তানের মধ্যে কবির কনিষ্ঠ। বড় সন্তান রুহুল আমিন শারীরক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। কবিরের বড় ৩ বোন রুপালী, নূরজাহান ও সুরাইয়া। স্বামী সম্পর্ক ছেদ করার পরে নূরজাহান তার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন।

২০০৭ সালে জয়পুরহাটের শরাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের কবির এসএসসি পাস করেন। সে সময়ের স্মৃতি থেকে কবির বলেন, বাবার আয়ে চলতো সংসার। আমাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। এসএসসি পরীক্ষা এসে গেল, পরীক্ষার ফরম পূরণের সামর্থ্য ছিল না। মা তার কানের দুল বিক্রি করে টাকা দিয়েছিল। স্কুলের ব্যাচের সবার মধ্যে আমার রেজাল্ট সবচেয়ে ভালো হলো। মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৪ পয়েন্ট ৫০ পেলাম।

এইচএসসি পরীক্ষাতেও ব্যাচের মধ্যে আমার রেজাল্ট সবচেয়ে ভালো হলো। ২০০৯ সালে শরাইল কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৪ পয়েন্ট ৫০ নিয়ে পাস করলাম। তারপর আমার মনে হলো, আমার শহরে থেকে পড়া উচিত। আমি বাসা থেকে পালিয়ে বগুড়ায় চলে আসি। বগুড়ায় এসে এক বড় ভাইয়ের কাছে মেসে উঠলাম। তিনি বললেন, তুই দুএক মাস আমার এখানেই থাক। আমি তোকে ছাত্র-ছাত্রী জোগাড় করে দিচ্ছি, পড়াতে পারবি। তেমনই হলো। সরকারি আজিজুল হক কলেজে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকে (সম্মান) ভর্তি হলাম। প্রথম বছর মেসেই ছিলাম। পড়াতাম আর পড়তাম। শিক্ষকরা উৎসাহ দিলেন, পড়াশোনা করতে হবে। রেজাল্ট ভালো করতে হবে। মেসের পাশের বাড়ির মালিক সপরিবারে ঢাকায় থাকেন। বাড়িটা বন্ধ থাকে, মাঝে মাঝে তারা আসেন। আমি অনুরোধ করলাম, যেন আমাকে থাকতে দেওয়া হয়। ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে যে টাকা পাই, তা দিয়ে মেসে থাকা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মা হাঁপানীর রোগী, সেই সঙ্গে রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ আছে। বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হয়। এভাবে অনার্স শেষ হয়ে গেল। আউট অব ৪ এর মধ্যে আমার সিজিপিএ ছিল ৩ পয়েন্ট ৪৭। ওই কলেজেই মাস্টার্স করলাম। সিজিপিএ এলো ৩ পয়েন্ট ৪৪। এরপর এলো বেকারত্বের গ্লানি, বলেন কবির।

মো. আলমগীর কবিরের বাবা ও মা। ছবি: সংগৃহীত

'তুমি আর সরকারি চাকরির চিন্তা করো না। এখন যা পাও, তাই করো'

২০১৯ সালের শেষের দিকে চাকরির পরীক্ষা দিতে শুরু করেন কবির। সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞপ্তি দেখলেই পরীক্ষায় অংশ নিতেন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেন। তবে কোনো এক অজানা কারণে মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়ে যেতেন। কবিরের ভাষ্য, বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তবু কারণটা জানা গেল, অভিজ্ঞতা না থাকায় আমার চাকরি হচ্ছে না। ২০২০ সালে করোনার কারণে সব বন্ধ হয়ে গেল। ওই সময় আমার বাবা করোনায় আক্রান্ত হলেন। ছোট একটা চেম্বারের মতো জায়গা ছিল, বাবা সেখানে বসতেন, রোগী দেখতেন। কেউ এলো, প্রেসার মেপে দিলেন। ২০-৩০ টাকা পেতেন, সেই টাকায় মূলত আমাদের সংসার চলতো। বাবার করোনা চিকিৎসার ব্যয় জোগাতে সেটা বিক্রি করতে হলো।

কফিল উদ্দিন এখন পায়ে হেঁটে হাটে-বাজারে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। কবির বলতে থাকেন, এরপর সমস্যা দেখা দিলো প্রায়ই বাবার প্রস্রাব আটকে যাচ্ছিল। সেই চিকিৎসা করাতে আমাদের ছোট একখণ্ড জমিটাও বিক্রি করতে হলো। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, বাবা আগে বাঁচুক। সে সময় ৩টি অপারেশন করাতে হলো। তাতে জমি বিক্রির ৯০ হাজার টাকার পুরোটাই ব্যয় হয়ে গেল। আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম।

তখন বাবা বললেন, 'তুমি আর সরকারি চাকরির চিন্তা করো না। এখন যা পাও, তাই করো।' আমি ঢাকায় চলে গেলাম। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষাগুলোতে পাস করি, পরের দিন যেতে বলে। যাওয়ার পরে বলে, আপনার তো অভিজ্ঞতা নেই। আমি উপায় না দেখে পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করলাম। চাকরি হলো একদম ছোট পদে। কাজের পরিবেশের সঙ্গে মিলছিল না, গালিগালাজ শুনতে পারছিলাম না। বেতনও কম, মাত্র ৮ হাজার টাকা। দেড় থেকে ২ হাজার টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারতাম, বাকি টাকা আমারই লেগে যেত। পড়ার সময় পেতাম না, চাকরির পরীক্ষার দিন ছুটি পেতাম না। শুক্রবারও ছুটি পেতাম না। কাগজে-কলমে ছুটি থাকলেও কাজ করতে হতো। সিদ্ধান্ত নিলাম না খেয়ে থাকতে হলেও বগুড়ায় ফিরে যাব। যে বাসায় থাকতাম, তাদের আবারও অনুরোধ করলাম যেন আমাকে থাকতে দেয়। সব বন্ধুদের বলছিলাম, আমার টিউশনি লাগবে। কেউ তেমন সাড়া দিচ্ছিল না। একটা টিউশনি হলো, দেড় হাজার টাকা বেতন কিন্তু সেই টাকা চলতে পারছিলাম না। এর মধ্যে বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ঢাকায় চাকরির পরীক্ষা দিতে যেতাম, বলেন কবির।

দুঃসময়ের কথা জানিয়ে কবির বলেন, টিউশনি করে রাতের খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে। সকালে-দুপুরে না খেয়ে থাকি। আবার টিউশনি পাচ্ছিও না। ভাবলাম শুধুমাত্র ভাতের বিনিময়ে কেউ যদি পড়ানোর সুযোগ দেয়, তাহলে পড়াবো। তারপর পোস্টার লাগালাম। ৫ দিন আগে পোস্টার লাগালাম। হঠাৎ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লো। আমার উদ্দেশ্য ছিল টিউশনি পাওয়া। টিউশনি করবো, পাশাপাশি চাকরি খুঁজবো। কিন্তু ইন্টারনেটের যুগ, ভাইরাল হয়ে গেছে। সেখানে আমার তো কিছু করার নেই। আমার আপনজন, কাছের মানুষ অনেকের লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। বলছেন, 'তুমি এ রকম এত ছোট একটা কাজ করলে! তুমি ভাত পাচ্ছো না, ভাতের বিনিময়ে পড়াতে হবে!' আসলে যার ঘা, তার ব্যথা।

তিনি আরও বলেন, আমি ৭ মাস মাত্র ১ বেলা খেয়ে কাটাচ্ছি, আমার কাছে কেউ জানতে চায়নি আমি খেয়েছি কি না। কিংবা আমি কোথায় আছি। আমি তাদের পরিষ্কার করে বলেছি, আমার পরিচয় দিতে লজ্জা লাগলে পরিচয় দিও না, আমাকে তো বাঁচতে হবে। আমি নিজে আগে বাঁচি।

আমার বাবা-মা একেবারে বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। একটাই স্বপ্ন, আমার একটা চাকরি হবে। আমি তাদের পুরো দায়িত্ব নিতে পারবো। আমার মায়ের সমুদ্র দেখার ইচ্ছা। একদিন বাবা-মাকে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাব, যোগ করেন কবির।

Comments

The Daily Star  | English

Smaller in size, larger in intent

Finance Adviser Salehuddin Ahmed has offered both empathy and arithmetic in his budget speech, laying out a vision that puts people, not just projects, at the heart of economic policy.

9h ago