পদত্যাগ কেন সমাধান হবে না?
মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সানা মারিন। ত্রিশেই মন্ত্রী আর ৩৫ বছর বয়সেই প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিশ্বের কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী হন সানা। সব কাজে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার জন্য তিনি দেশটিতে দারুণ জনপ্রিয়। কিন্তু, গতবছর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে একটা ছোট্ট অভিযোগ ওঠে যেটা নিয়ে তুলকালাম শুরু হয় ফিনল্যান্ডে।
দেশটির স্থানীয় একটি ট্যাবলয়েড একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে বলা হয়, সরকারি বাসভবন কেসারান্টায় থাকলেও নিজ পরিবারের সকালের নাশতার জন্য প্রতি মাসে ৩৬৫ ডলার বিল নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এ নিয়ে দারুণ সমালোচনার মুখে পড়েন প্রধানমন্ত্রী সানা।
ভাবুন একবার! মাত্র ৩৬৫ ডলার, কিন্তু তাই নিয়ে গোটা দেশজুড়ে তুলকালাম! এরপর কী হলো শুনুন!
জনগণের করের টাকা থেকে অবৈধভাবে স্বজনদের জন্য নাশতার বিল নেওয়া হচ্ছে কী তা খতিয়ে দেখার ঘোষণা দিলো দেশটির পুলিশ। এক বিবৃতিতে দেশটির ডিটেকটিভ সুপারিনটেনডেন্ট টিমু জোকিনেন বললেন, 'প্রধানমন্ত্রীকে কিছু খাবারের জন্য অর্থ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, মন্ত্রীদের পারিশ্রমিক আইন অনুসারে এটি বিধিসম্মত নয়। বিষয়টি তদন্ত হবে। তদন্তে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।'
তদন্তের কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী সানা রাগ করেননি, সেখানকার পুলিশকেও বদলি করে বান্দরবানের মতো সেই দেশের কোথাও পাঠানোর চেষ্টা করেননি। বরং পুলিশি তদন্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। নিজের অবস্থানকে পরিষ্কার করতে জনগণকে টুইট করে সানা জানালেন, 'প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি এই সুবিধা চাইনি। আর এ–বিষয়ক কোনো সিদ্ধান্তে আমি জড়িত ছিলাম না। আগের প্রধানমন্ত্রীরাও এমন সুবিধা পেয়েছেন। সেই কারণেই হয়তো আমাকেও দেওয়া হয়েছে।'
ভাবুন একবার! মাত্র কয়েকশ ডলার নিয়ে তুমুল জনপ্রিয় একজন প্রধানমন্ত্রী যিনি সদ্য নির্বাচিত হয়েছেন, যার বিরুদ্ধে একটা দেশের জাতীয় কোনো দৈনিক নয়, স্থানীয় ট্যাবলয়েড ছোট্ট একটা নিউজ করেছে, সেটা নিয়ে আবার পুলিশ তদন্তের ঘোষণা দিচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী স্বাগত জানাচ্ছেন তদন্তকে। নিজের অবস্থান পরিষ্কার করছেন বারবার!
ফিনল্যান্ডের কথাগুলো হঠাৎ করে বলার কারণ দেশের প্রধান জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো গতকাল (২৭ জানুয়ারি) তাদের প্রধান সংবাদের শিরোনাম করেছে, 'মন্ত্রী–ঘনিষ্ঠদের দুর্নীতির জাল'। তাতে বলা হয়েছে, চাঁদপুরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভূমি অধিগ্রহণে কারসাজি করে ৩৫৯ কোটি টাকা বাড়তি নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। তাতে সরাসরি নাম এসেছে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির।
ওই খবরে বলা হয়েছে, চাঁদপুরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের আগেই সেখানকার সাড়ে ৬২ একর জমি মৌজা দরের চেয়ে ২০ গুণ বেশি দাম দেখিয়ে দলিল করে নিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা। এর মধ্যে তার নিকটাত্মীয়ও রয়েছেন। যদিও শিক্ষামন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা বলছে, ওই এলাকার প্রকৃত মৌজা দর ধরে জমি অধিগ্রহণের দাম নির্ধারণ করলে এই সাড়ে ৬২ একরের জন্য (মূল দামের তিন গুণ ধরে) সরকারের ব্যয় হবে প্রায় ১৯৪ কোটি টাকা। কিন্তু, হঠাৎ উচ্চ মূল্য দেখিয়ে যেসব দলিল করা হয়েছে, সেটা আমলে নিলে সরকারকে ৫৫৩ কোটি টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ সরকারকে অতিরিক্ত দিতে হবে ৩৫৯ কোটি টাকা।
এই সংবাদটা যে গতকাল প্রথম আলোই প্রথম প্রকাশ করলো তাই নয়। গত বছরের নভেম্বরেই চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে বিস্তারিত প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। তার মানে সরকারের নীতি নির্ধারকরা অনেক আগেই বিষয়টি জেনেছেন। অবশ্য এ নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে গত কয়েকদিন ধরেই।
এই ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে চাঁদপুর-৪ আসনের (ফরিদগঞ্জ) সরকারি দলের সংসদ এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান সংবাদমাধ্যমে বিস্তারিত আকারে কলাম লিখেছেন। তিনি বলেন, 'প্রস্তাবিত চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ৫০০-৬০০ কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছিল অবাধে। এর পেছনে যেহেতু খোদ শিক্ষামন্ত্রীর ক্ষমতা ও তার ভাই-বেরাদর জড়িত, তাই কেউ মুখ খুলছিল না।'
বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এই খবরগুলো দেখলে খুব কষ্ট হয়। এটা অবশ্য বুঝি যে, এই দেশটা ফিনল্যান্ড নয় যে প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় স্বজনদের কয়েকশ ডলারের নাশতার বিল নিয়ে পুলিশ তদন্তে নামবে! খুব ভালো করেই বুঝি এই দেশটা বাংলাদেশ! এখানে ক্ষমতায় গেলে অনেক মন্ত্রী-এমপি আর জনপ্রতিনিধি কিংবা আমলা অনিয়ম দুর্নীতি করবেন, টাকা পাচার করবেন সেগুলোই বোধহয় স্বাভাবিক ঘটনা।
অনেকক্ষেত্রে এই দুর্নীতিকে তারা তাদের অধিকার মনে করবেন। তাই রাষ্ট্রের টাকা তছরুপ করার পরেও, নানা অনিয়ম ব্যর্থতার পরেও তারা পদত্যাগের কথা ভাবেন না। দুর্নীতির এই রোগ এখন ছড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। উপাচার্য থেকে শুরু করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু, এসব ঘটনায় বা যে কোনো পরিস্থিতির ব্যর্থতায় দেশজুড়ে সমালোচনা হলেও সচারচর কেউ পদত্যাগ করেন না।
এই তো কয়েকদিন আগেই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলে দিলেন, পদত্যাগই সব সমস্যার সমাধান নয়। গতকালের প্রথম আলোর নিউজের পরে নিজের ক্ষেত্রেও তিনি তাই ভাবছেন কী না কে জানে! অথচ এখানে তার আত্মীয় স্বজনের দুর্নীতি অনিয়মের কথা যেমন উঠে এসেছে তেমনি শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণা, এরপর নিজের আত্মীয় স্বজনের জমি কেনা প্রত্যেকটা ঘটনায় স্বার্থের দ্বন্দ্ব (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) আছে। উন্নত কোনো দেশের শিক্ষামন্ত্রী হলে এই ঘটনার পর তিনি এক মুহূর্তও পদে থাকতেন না! কিন্তু, বাংলাদেশে পদত্যাগকে তো তারা সমাধান মনে করে না।
কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই পদত্যাগ সমাধান। তাতে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি বাড়ে। বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে কিংবা সাধারণ মানুষের সমালোচনায় কেউ যখন পদত্যাগ করেন বা করতে বাধ্য হন, তাতে এই বার্তা যায় যে ব্যর্থ হলে, অনিয়ম করলে, পদে থাকা যায় না। কাজেই পদত্যাগের সংস্কৃতি কিন্তু জরুরি।
এই তো গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা পদত্যাগ করলেন। না কেউ তাকে পদত্যাগ করতে বলেননি। কিন্তু, এক জরিপে জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ায় এবং দেশ পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় তিনি দিতে পারছেন না, এমনটা মনে করে নিজেই পদত্যাগের ঘোষণা দেন। অনেকের কাছে এটা অপ্রত্যাশিত মনে হলেও জাপানি রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রথা অনুযায়ী এমন পদত্যাগ অস্বাভাবিক নয়।
করোনা মহামারির সময়ে দায়িত্বে পালনে ব্যর্থতা নিয়ে অনেক দেশেই পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের জানুয়ারিতে করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারার ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করলেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী গিসেপে কন্তে। বহু দেশে নিজেদের ব্যর্থতার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা পদত্যাগ করেছেন।
পদত্যাগের এই তালিকায় ছিলেন ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকু ও অস্ট্রিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুডোল্ফ আনস্কোবারের। স্বাস্থ্যবিধি মানতে কড়াকড়ির সময় পরিবার নিয়ে সৈকতে যাওয়ার ঘটনায় সমালোচনা উঠলে নিউজিল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডেভিড ক্লার্ক পদত্যাগ করেন। ইকুয়েডরে গরিব মানুষ টিকা পাচ্ছে না, বড়লোকেরা পাচ্ছে সহজেই- এই অভিযোগ ওঠার পর দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার ১৯ দিনের মাথায় পদত্যাগ করেন রোদোল্ফ ফারদান।
পাশের দেশ ভারতেও মাঝে মধ্যে পদত্যাগের ঘটনা ঘটে। করোনাকালে ভারতের মন্ত্রিসভার সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন আর প্রতিমন্ত্রী অশ্বিন চৌবেও ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেন। শুধু রাজনীতিবিদরাই নন, দায়িত্বে অবহেলায় বহুজন তাদের সরকারি পদও ছেড়ে দেন। নব্য নাৎসিদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে ব্যর্থতার কারণে জার্মানির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হেইনজ ফ্রম পদত্যাগ করলেন। এমনকি পাশের দেশ মিয়ানমারে গতবছর সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে না পারায় দেশটির প্রেস কাউন্সিলের ২৪ সদস্য পদত্যাগ করেন।
পৃথিবীতে পদত্যাগের এমন বহু ঘটনা আছে। এই তো ২০১৪ সালেরে কথা। দক্ষিণ কোরিয়ার কলেজগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা ছিল। সেই ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ছোট কয়েকটা ভুল হয়েছিল। এ নিয়ে শোরগোল হলে ভুলের দায় নিয়ে দেশটির শিক্ষা বোর্ডের প্রধান পদত্যাগ করেন। তিনি শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কাছে ক্ষমা চান।
অথচ বাংলাদেশে দিনের পর দিন নানা পাবলিক ও নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। কিন্তু, কেউ পদত্যাগ করেন না। এখানে আরেকটা ঘটনা বলতে হয়। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে দেশটিতে একটা ফেরি ডুবে মানুষ মারা গিয়েছিল। ওই ঘটনায় দেশটির প্রেসিডেন্ট উদ্ধারকারী সব বাহিনী ভেঙে দেন। জনগণের কাছে ক্ষমা চান।
আর বাংলাদেশে? প্রায়ই এখানে লঞ্চ ডুবি হয়। সড়ক দুর্ঘটনা, ভবনে আগুন, অনিয়ম-দুর্নীতি এগুলো যেন সাধারণ ঘটনা! এখানে শত শত মানুষ মরলেও পদত্যাগ তো দূরের কথা, কোনোদিন শুনবেন না দায়িত্বশীলরা দুঃখটুকু প্রকাশ করেছেন। আমরা এখানে বলি, পদত্যাগ কোনো কিছুর সমাধান নয়! কারণ জোর করে পদ আঁকড়ে ধরাতেই এখানে সব সফলতা!
সেই অর্থে বাংলাদেশে সবাই সফল! কারণ এখানে কেউ পদত্যাগ করেন না। কথায় কথায় শুনবেন দেশটা সিঙ্গাপুর, ভেনিস, ইউরোপ আমেরিকা হয়ে গেছে! কিন্তু, কখনো শুনবেন না কেই ব্যর্থতার দায়ে পদত্যাগ করেছেন। বরং কিছু ঘটলেই সঙ্গে সঙ্গে দায়ী করা হবে বিরোধীদের আর গণমাধ্যমকে। আর কিছু না পেলে তৃতীয় পক্ষ তো আছেই। শুধু নেই পদত্যাগের সংস্কৃতি আর ক্ষমা চাওয়া।
আমাদের দেশে রাজনীতিবিদ আর পদে থাকা দায়িত্বশীলরা মনে করেন, পদত্যাগ কোনো সমাধান নয়! কিন্তু আগেই বলেছি, অনেকক্ষেত্রেই পদত্যাগ সমাধান। তাতে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি বাড়ে। কাজেই দায়িত্বে ব্যর্থতায় বা অসততায় পদত্যাগের সংস্কৃতি কিন্তু জরুরি।
শরিফুল হাসান, কলামিস্ট
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments